বিপাকে দেশিয় ব্র্যান্ড, ভরসা প্রণোদনা প্যাকেজ
প্রকাশিত : ১৭:৪১, ১৭ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:২৪, ১৮ মে ২০২০
করোনা সংকটে হারিয়ে যেতে পারে পোশাকের অনেক দেশিয় ব্র্যান্ড। পহেলা বৈশাখে সম্পূর্ণ লকডাউন থাকায় কোন ধরনের কেনাবেচা হয়নি। আর রমজানে দোকানপাট খুললেও কেনাবেচা হচ্ছে নামে মাত্র। ফলে আসছে দিনগুলোতে ব্যবসা বন্ধ, নয়তো সঙ্কুচিত করার কথা ভাবছেন এ খাতের অনেক উদ্যোক্তা।
ব্রান্ডগুলোর দুরবস্থায় বিপাকে পরে তাদের উপর নির্ভরশীল ছোট ছোট সহযোগী শিল্পও। দেশিয় ব্র্যান্ডগুলোর সাথে বর্তমানে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে দেশিয় তাঁত শিল্প, কারুশিল্প এমনকি মৃত শিল্পও। এসব খাতের প্রান্তিক পর্যায়ের ব্যবসায়ী ও কর্মীদের এখন পথে বসার উপক্রম হয়েছে।
তবে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের অর্থ সময়মতো হাতে পেলে অনেকেই টিকে থাকতে পারবে বলে মনে করছে এ খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন ফ্যাশন এন্টারপ্রেইনরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-এফইএবি। এ জন্য এ খাতের ব্যবসায়ীদের বাড়তি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলছেন তারা।
আশির দশক পর্যন্ত দেশিয় ফ্যাশন অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিদেশ নির্ভর ছিল। বিশেষ করে সে সময়ের তরুণ-তরুণীদের কাছে ফ্যাশনেবল পোশাক মানেই ছিল ভারতীয়, পাকিস্তানি বা অন্য কোন দেশের পোশাক। কিন্তু দেশিয় ব্র্যান্ডগুলোর উত্থানে সে চিত্র এখন সম্পূর্ণই পাল্টে গেছে।
যদিও দেশিয় ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রির যাত্রা শুরু ১৯৭৩ সালে রূপায়ণ আর নিপুণের হাত ধরে। এরপর আশির দশকে আড়ং, কারুপল্লী, কুমুদিনী, কারিকা, সেতুলী, জয়া, শুকসারি ও টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের হাত ধরে এ খাত আরেকটু সমৃদ্ধ হয়। তবে সবচেয়ে বড় জোয়ারটা আসে নব্বইয়ের দশকে। বিশেষত ২০০০ সালের আগে একে একে অঞ্জনস, কে ক্রাফট, রঙ, গ্রামীণ, সাদাকালো এ রকম আরো কিছু হাউস আছে।
২০০১-২০১০ দশককে দেশি ফ্যাশনের স্বর্ণযুগ বলা যায়। এই সময়ে অনেক ফ্যাশন হাউস হয়েছে। তৈরি পোশাক রপ্তানি সাথে সংশ্লিষ্ট অনেক ব্যবসায়ীও আসেন বড় বিনিয়োগ নিয়ে। টেক্সমার্ট, ইয়েলো, সেইলরের মতো ব্রান্ডরা তাদের দীর্ঘদিনের রপ্তানি অভিজ্ঞতার পাশাপাশি দেশিয় ফ্যাশন ও ডিজাইনের সমন্বয়ে ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিকে আরও সমৃদ্ধ করেন।
এ সময় ব্যক্তি উদ্যোগে এসেছেন অনেক ডিজাইনার। এর ফলে বিদেশি পোশাকের প্রতি আমাদের যে মোহ ছিল তা থেকে সরে এসে দেশিয় পোশাকের প্রতি আগ্রহ জন্মাতে শুরু করে। ডিজাইনগুলো আমাদের নিজস্ব হওয়াতে মানুষ সেগুলো পছন্দও করতে শুরু করে।
তবে তখন কোনো ফ্যাশন ইনস্টিটিউট ছিল না দেশে। কিন্তু ফ্যাশন হাউসগুলো ভালো করতে শুরু করায় এখন কয়েকটা ফ্যাশন ইনস্টিটিউটও আছে। আগে যেমন হাতে গোনা কয়েকজন ফ্যাশন ডিজাইনার ছিলেন, এখন সেখানে হাজার হাজার ডিজাইনার আছেন। কেউ ফ্যাশন হাউসে কাজ করছেন তো কেউ বাইংয়ে। নিজেরা উদ্যোক্তা হয়ে অনলাইনে বিক্রিও করছেন কেউ কেউ। অল্প কয়েকটি হাউস মিলে যে জোয়ার তৈরি করেছিল, তা এখন আলাদা একটি বৃহৎ খাতে পরিণত হয়েছে।
সারাদেশে ছোট-বড় মিলিয়ে এখন বিভিন্ন ব্রান্ডের ৫ হাজারেরও বেশি আউটলেট আছে বলে জানিয়েছে এফইএবি। সংগঠনটি বলছে, সাধারণ সময়ে শুধুমাত্র রমজানেই তাদের কেনাবেচা চার থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা। পহেলা বৈশাখে হয় আরও দু-হাজার কোটি। দেশিয় ব্রান্ডগুলোর ব্যবসার ৬০ শতাংশই এ দুই উৎসবের উপর নির্ভরশীল।
কিন্তু এ বছর সব হিসাব পাল্টে দিয়েছে করোনা সংকট। প্রায় দু’মাস শো-রুমই খোলা যায়নি। এরপর ১০ মে থেকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সরকার দোকানপাট খোলার অনুমোদন দেয়ার পর ব্র্যান্ড আউটলেটগুলোও খুলেছে। কিন্তু কেনাবেচা নেই বললেই চলে। রাজধানির বেইলি রোডে প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডগুলোর প্রায় সবারই আউটলেট আছে। রোববার সেখানে গিয়ে দেখা যায়, বেলা ১২টা পর্যন্ত অধিকাংশ আউটলেটেই কোন কেনাবেচা হয়নি।
কথা হয় টাঙ্গাইল শাড়ি কুটিরের ব্যবস্থাপক ওয়াহিদুজ্জামানের সাথে। তিনি বলেন, ‘সকাল থেকে এ পর্যন্ত মাত্র দুটি শাড়ি বিক্রি হয়েছে। অথচ গেল রমজানে আমরা দম ফেলার সময় পর্যন্ত পাইনি। এভাবে চললে আমাদের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-বোনাস, তাঁতিদের পাওনা- কোন কিছুই জোগাড় হবে না।’
প্রতিষ্ঠিত ব্রান্ডগুলোই যখন বেকায়দায় সেখানে দু-এক বছর ধরে যারা এ ব্যবসায় নেমেছেন তাদের অবস্থা আরও বেহাল। ২০১৮ সালে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা পুজি নিয়ে এ ব্যবসায় নেমেছিলেন জেসমিন আহমেদ। একটু একটু করে গড়ে তুলেছেন নিজের একটি কারখানা, যেখানে কাজ করছেন ছয়জন কর্মচারী। পাশাপাশি আছে ছোট্ট একটা শো-রুমও, তার ব্রান্ডের নাম বকুল। কিন্তু গেল তিনমাসে কেনাবেচা একদমই হয়নি।
জেসমিন আহমেদ বলেন, ‘আমার ভাড়া, ইউটিলিটি বিল, কর্মচারীদের বেতন মিলিয়ে মাসে খরচ প্রায় দুই লাখ টাকা। গত দুই মাসে এই খরচ জোগাতে যেয়ে জমানো টাকা সব শেষ। ব্যাংক ঋণ না নিলেও ঘনিষ্টজনদের কাছ থেকে কিছু ঋণ নিয়েছিলাম। এখন হয়তো ব্যবসাটাই গুটাতে হবে।’
অনেক প্রতিষ্ঠানই যে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হবে মানছে এফইএবিও। ব্রান্ডগুলোর চাইতে বেশি বিপদে পড়বে তাদের সাথে সংশ্লিষ্ট প্রান্তিক তাঁতি ও সরবরাহকারীও। কম করে হলেও ৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যাদের অনেকেই বেকার হয়ে পড়বেন। তবে ঠিক কতো প্রতিষ্ঠান বন্ধ হতে পারে বা কি পরিমাণে অর্থিক ক্ষতি হতে পারে তার সুনির্দিষ্ট কোন হিসাব এখনো পর্যন্ত নেই এফইএবি’র কাছে।
জানতে চাইলে এফইএবির সভাপতি মো. শাহিন আহমেদ বলেন, ‘আমাদের ব্যবসা মূলত উৎসব কেন্দ্রিক। পরপর দুটি উৎসবে আমরা কোন কেনাবেচাই করতে পারলাম না। এ সংকট যদি দীর্ঘায়িত হয় অনেকেরই টিকে থাকা দায় হবে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা অধিকাংশই হারিয়ে যাবেন, মাঝারি ও বড়রা অনেকই ব্যবসা সংকোচনে যাবেন। আউটলেটের সংখ্যা আগামীতে অনেক কমে যাবে।’
তবে আশার কথা ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সরকার এরই মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। সেখান থেকে দ্রুত অর্থ পেলে অনেক উদ্যোক্তাই হয়তো টিকে থাকতে পারবেন-যোগ করেন তিনি।
এরই মধ্যে এই প্রণোদনা প্যাকেজের জন্য নীতিমালা ঘোষণা করেছে কেন্দ্রিয় ব্যাংক। যেখানে ঋণের সর্বোচ্চ সুদ হার হবে ৯ শতাংশ, যার মধ্যে চার শতাংশ ঋণ গ্রহীতা নিজে পরিশোধ করবেন এবং বাকি পাঁচ শতাংশ সরকার ভর্তুকি দেবে। তবে এ ঋণ সব উদ্যোক্তার কাঠে পৌঁছানো বিশেষ করে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছানই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কারণ বড় উদ্যোক্তারা নিয়মিত ব্যাংকের সাথে লেনদেন করলেও একদম ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সেইভাবে তাদের হিসাব রাখেন না। ফলে ব্যাংকের ঋণের জন্য আবেদন করলে তাতে অনেক অসম্পূর্ণতা থেকে যায়। এ সংকট মোকাবিলার উপায় বের করতে এরইমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে বলে এসএমই ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা গেছে।
কিন্তু এ প্রক্রিয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত সব উদ্যোক্তাদের প্রণোদনা নিয়ে ব্যবসা আগের মতো কতটা চঙ্গা করা যাবে, সে ব্যাপারে সন্দিহান বিশ্লেষকরা।
তৈরি পোশাক রপ্তানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ’র পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল মোমেন বলেন, ‘প্রণোদনা প্যাকেজ আসলে সবটাই স্বল্প সুদে ঋণ। যা বিতরণ হবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে। ঋণ নেয়ার যোগ্যতা যাদের থাকবে না তারা ঋণ পাবেন না। আর যারা ঋণ পাবেন তাদের ব্যবসা করেই সেই ঋণ পরবর্তীতে পরিশোধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, করোনা সংকট গোটা পৃথীবিজুড়েই মানুষের জীবনযাত্রায় বড় ধরনের পরিবর্তন আনবে এবং দীর্ঘমেয়াদি মন্দা মোকাবিলা করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোর অনেক রিটেইল ব্রান্ড এরই মধ্যে দেওলিয়া হয়ে গেছে। সেখানে দেশিয় অনেক ব্রান্ডেরও যে একই পরিণতি হবে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পাশাপাশি করোনার আগে থেকেই অনলাইন বিক্রেতাদের কারণে দেশিয় ব্রান্ডগুলো এক ধরনের সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল।’
অধ্যাপক মোমেন বলেন, অনলাইনে প্রায় তিন লাখ বিক্রেতা আছেন যারা ভারতীয় বা অন্য দেশের পোশাক এনে কোন ধরনের ট্যাক্স-ভ্যাট না দিয়েই ব্যবসা করে যাচ্ছিল। ফলে, দেশিয় ব্রান্ড ও ফ্যাশন ইন্ডস্ট্রিকে আগামীতে টিকিয়ে রাখতে হলে প্রণোদনার পাশাপাশি অনলাইন নির্ভর এ ধরণের অবৈধ ব্যবসার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত নিতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
এআই//