ঢাকা, সোমবার   ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪

বিপাকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের মধ্যবিত্তরা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ২০:২৪, ৩ জুলাই ২০২০

গত দুই দশকে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিস্তর পরিবর্তন ঘটেছে। বেড়েছে মধ্যবিত্তের বিস্তৃতি। সেই বদলেছে তাদের চরিত্রও। ঋণ দেয়ার সুবিধার্থে সদস্য দেশগুলোকে আয়ের ভিত্তিতে চারটি ভাগে ভাগ করে বিশ্বব্যাংক। কোনো দেশের জনগণের গড় মাথাপিছু আয় ১০৩৬ ডলারের কম হলে সে দেশটি নিম্ন আয়ের হিসেবে বিবেচিত হয়।

২০১৪ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ ছিল এই কাতারে। মাথাপিছু আয় ১০৩৬ থেকে ৪০৪৫ ডলার হলে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশ, ৪০৪৬ থেকে ১২,০৪৫ ডলার হলে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ। সবশেষটি উচ্চ আয়ের দেশ, এজন্য মাথাপিছু আয় হতে হবে ১২ হাজার ৫৩৫ ডলারের বেশি।

২০১৫ সালের বাংলাদেশ নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে। মধ্যবিত্তের যেমন আত্মসম্মানবোধ প্রবল, বিপদে পড়লেও কারো কাছ থেকে দয়াদাক্ষিণ্য নেয় না, একইভাবে এই ক্যাটাগরিতে থাকা দেশগুলোর জন্য স্বল্প সুদের ঋণসহ অনুদানের সুযোগ সুবিধাগুলো নেই, যেমনটা আছে নিম্ন আয়ের দেশের জন্য।

আর্থিক ও সামাজিক সামর্থের বিচারে দেশগুলোকে স্বল্পোনন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত এই তিন ভাগে ভাগ করে জাতিসংঘ। বাংলাদেশ আছে সবচেয়ে নিচে, স্বল্পোন্নত দেশের তালিকাতে। যদিও সেখান থেকে উত্তরণে যে শর্তগুলো রয়েছে দুই বছর আগেই সেগুলো পূরণ হয়ে গেছে। এই ধারা বজায় থাকলে ২০২৪ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের কাতারে পৌঁছাবে। এতে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছ থেকে এখন যেই সুবিধাগুলো মিলছে, সেগুলো আর পাওয়া যাবে না।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশকে এখন বড়সড় একান্নবর্তী মধ্যবিত্ত এক পরিবারের সঙ্গেই তুলনা করা চলে। পরিবারের সবার আর্থিক স্বচ্ছলতা যে এক রকম, তা নয়। বেশিরভাগের অবস্থাই টানাটানির। তার মধ্যেই দু-একজন, আলাদিনের চেরাগের বদৌলতে অবাক করা সম্পত্তির মালিক হয়ে উঠেছেন। তাদের হাতেই সমস্ত কিছুর নিয়ন্ত্রণ। সব সুযোগ সুবিধাও তারা নিজেরাই ভোগ করতে চান, বাকিদের প্রাপ্যটা নিয়েও টানাটানি করেন। পরিবারের কর্তৃত্ব যার হাতে, তিনিও সমস্ত কিছুতে তাদের পক্ষেই অবস্থান নেন, সিদ্ধান্ত দেন। সদস্যদের যাদের অবস্থা একেবারে নিচে তারা মাঝে মধ্যে প্রতিবাদ করেন, কিছুটা প্রাপ্য আদায় করে নেন। মাঝখানে যারা আছেন তাদের তেমন কোন উচ্চবাচ্য নেই। খারাপ বা ভাল যাই থাকেন না কেন, বাইরে বেশ পরিপাটি এক ভাব নিয়ে চলেন। তাই তাদের প্রকৃত অবস্থা বোঝাটা মুশকিল। আগে মাঝে মধ্যে কোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করতেন এখন তা-ও করেন না, সবার সঙ্গে আপোষ করে চলেন। কখনও কখনও পরিবারে যে তাদের অস্তিত্ব আছে তা টেরই পাওয়া যায় না।

মধ্যবিত্তের হাত ধরেই বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সংগ্রাম সবকিছুতে তারাই নেতৃত্ব দিয়েছেন। সংস্কৃতি বিনির্মাণ করেছেন, নিজেদের শিক্ষিত হিসেবে বিকশিত করেছেন। দেশের রাজনীতিতেও এক সময় তাদেরই আধিপত্য ছিল৷ অথচ এই মধ্যবিত্তকে এখন কর্মসংস্থানের বাজার আর বিনোদন কেন্দ্র ছাড়া অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

নিজেদের তৈরি করা জায়গা তারা ছেড়ে দিয়েছেন উঠতি ধনিক শ্রেণির হাতে। এই উচ্চবিত্তের প্রতিপত্তি দিন দিন এতই বাড়ছে যে, ধনীর সংখ্যা বৃদ্ধিতে গোটা বিশ্বকেই এখন বাংলাদেশ পেছনে ফেলে দিয়েছে। রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে জাতীয় সংসদেও তাদের আধিপত্য। সরকার তাদের সর্বোচ্চ মুনাফা নিশ্চিতেই কাজ করে। দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে শ্রমিকরা লড়াই করে কিছুটা আদায় করে নিতে জানে, কিন্তু মধ্যবিত্ত সেটাও পারে না। না আছে সে নীতি নির্ধারণে, না আছে মাঠে ময়দানে।

আর্থিক স্বচ্ছলতার বিচারে বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত শ্রেণিরও স্ফীতি ঘটেছে তাতে সন্দেহ নেই। গত দুই দশকে দেশের কর্পোরেট ও সেবা খাত বিকশিত হয়েছে, অনেক মানুষের কর্মসংস্থান জুটেছে। বোস্টন কনসালটেন্ট গ্রুপের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল মানুষ রয়েছেন এক কোটি ২০ লাখ। প্রতি বছরই সেখানে আরও ২০ লাখ নতুন যুক্ত হচ্ছেন। ২০২৫ সালে তাদের সংখ্যা বেড়ে হবে তিন কোটি ৪০ লাখ। বোস্টনের প্রতিবেদন অনুযায়ী এরা উচ্চাভিলাষী, কেনাকাটায় বিদেশি ব্র্যান্ডকে গুরুত্ব দেন এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের খরচ বাড়াতে চান। তাদের জন্যই শহরগুলোতে একের পর এক শপিং মল উঠছে, রেস্টুরেন্টের ব্যবসা চাঙা হচ্ছে। মধ্যবিত্তরা কোথায় বুঁদ হয়ে আছেন সেটা এই প্রতিবেদন আর প্রবণতা থেকেই আঁচ করা যেতে পারে।

তবে মধ্যবিত্তের আপাত সুখের এই জগতে হানা দিতে শুরু করেছে করোনা। এরই মধ্যে শহর ছাড়তে শুরু করেছেন নিম্নমধ্যবিত্তরা। বড় অংকের মাইনে পাওয়াদের কপালেও চিন্তার ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। নিয়মিত বেতন পাচ্ছেন না অনেকে, কেউ কেউ চাকরি হারাচ্ছেন। অনিশ্চিত সময় সামনে। উচ্চবিত্ত এরই মধ্যে সরকারের কাছ থেকে প্রণোদনা আদায় করে নিয়েছে। ঠিক মতো দেয়া হচ্ছে কিনা তা নিয়ে আশঙ্কা থাকলেও ৫০ লাখ নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্যেও সরকার খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। অন্যদিকে মধ্যবিত্ত কিছু পায়নি, এতটুকু অভিমান সে করতেই পারে। তার উপর বাজেটে নানামুখী খরচের চাপ বেড়েছে। বাস মালিকদের ক্ষতি পোষাতে পরিবহন ভাড়া বৃদ্ধি আর বিদ্যুতের ভুতূড়ে বিলের মতো উটকো সব বোঝাতো আছেই। তারপরও সব সয়ে যাওয়ার এক অবাক করা শক্তি আছে তার ভিতরে। এই লড়াইয়ে মধ্যবিত্ত কতদিন আর টিকে থাকতে পারবে তাই এখন দেখার বিষয়। (ডয়চে ভেলে)

এমএস/এসি

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি