বিভিন্ন ধর্মে উপবাস
প্রকাশিত : ১১:৩৭, ২৬ এপ্রিল ২০২০
ইসলামের আগেও রোজা বা উপবাসের বিধান ছিল পূর্ববর্তী অনেক ধর্মবিশ্বাসে। যেমন, খ্রীষ্টধর্মের একেবারে শুরু থেকেই ফাস্টিং বা উপবাসের বিধান ছিল। আত্মশুদ্ধির মানসে তারা উপবাস করতেন। ৬ষ্ঠ শতকে লেন্টেন ফাস্ট বলে একটি ধর্মীয় বিধি প্রচলিত হয় যাতে ধর্মপ্রাণ খ্রিষ্টানরা ৪০ দিনের উপবাসকাল কাটাতেন যখন দিনে মাত্র একবেলা খাওয়ার অনুমতি ছিল তাদের। খ্রিষ্টানদের প্রোটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক দুই ধারাতেই উপবাসের বিধি আছে।
পেরু ও মেক্সিকোর কিছু জনগোষ্ঠীর মানুষ এখনো পাপের প্রায়শ্চিত্য ও দেবতাকে খুশি করার জন্যে উপবাস করে থাকেন।
ইহুদিদের বছরের সবচেয়ে পবিত্র দিন, ইয়ুম কিপুর পালনের অনুষঙ্গই হলো দীর্ঘ ২৫ ঘণ্টা কোনোরকম খাবার পানীয় গ্রহণ না করে সিনাগগে (ইহুদিদের উপাসনালয়) অবস্থান করা।
কোরআন নাজিলের আগে রমজান ছিল অন্য এগারটি মাসের মতোই একটি সাধারণ মাস। কিন্তু যখন কোরআন নাজিল হলো, রমজান একটি গুরুত্বপূর্ণ মাস হিসেবে বিবেচিত হতে লাগল, এমনকি স্বয়ং আল্লাহর কাছেও।
মানবজাতির ওপর কোরআন নাজিলকে আল্লাহ নিজেও একটি গুরুত্বপূর্ণ গণ্য করেছেন। আর সেজন্যেই রমজান মাসটিকে তিনি শুধু অন্য এগার মাস নয়, হাজার মাসের চেয়েও বেশি মর্যাদাপূর্ণ বলে বলেছেন।
এবার জেনে নিন বিভিন্ন ধর্মের উপবাস সম্পর্কে-
ইসলাম ধর্ম
ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের চতুর্থ স্তম্ভ রোজা বা উপবাস। পবিত্র রমজান মাসে সারা জাহানের মুসলমানগণ রোজাব্রত পালন করে থাকেন। ইসলাম ধর্মে রামাদান মাসে ফজর থেকে মাগরিব পর্যন্ত পূর্নবয়স্ক সুস্থ সবল নারী-পুরুষের জন্য বাধ্যতামুলক। রোজা পালন সময়ে কোন প্রকার খাদ্য গ্রহণ এবং পান সম্পূর্নরূপে নিষিদ্ধ। আল কোরআনে বলা হয়েছে- সাওম বা রোজা পালনের মাধ্যমে মুসলমানগণ তাকওয়া অর্জন করে। বিশ্বাস করা হয় রোজা মানুষকে আত্মশুদ্ধি অর্জনে সাহায্য করে এবং পাপ প্রবৃত্তি থেকে দূরে রাখে। মুসলমানেরা বিশ্বাস করেন রোজা শুধু খাবার ও পানীয় বর্জন নয়। রোজা হচ্ছে কথা ও কর্মে মিথ্যা পরিহার করা, অশোভনীয় ভাষা পরিহার, ঝগড়া ফ্যাসাদ এবং কুপ্রবৃত্তি ও খারাপ চিন্তা থেকে দূরে থাকাই রোজা।
বাহাই ধর্ম
বাহাই ধর্মানুসারীদের জন্য বাহাউল্লাহা কিতাবই আকদাসে বাহাই মাস আলা (২ মার্চ- ২০ মার্চ) এ ১৯ দিনের রোজা রাখার বিধানের কথা উল্লেখ করেছেন। সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত কোনরূপ পানাহার এমনকি ধূম্রপান পর্যন্ত নিষিদ্ধ। ১৫ থেকে ৭০ বয়সী সকল বাহাইকে এই রোজা বা উপবাস পালন করতে হবে। অসুস্থ, গর্ভবতী, ঋতুবতী, পর্যটক, কঠোর পরিশ্রমকারীদের জন্য রোজার বিধান শিথিল করা হয়েছে। তবে যারা কঠোর পরিশ্রম করেন তাদেরকে নির্জনে স্বাভাবিকের তুলনায় কম আহার করতে বলা হয়েছে।
বৌদ্ধ ধর্ম
বৌদ্ধধর্মে বৌদ্ধ ভিক্ষুরা বিনয় নীতি অনুসরণ করে যাতে সাধারনত দুপুরের আহারের পরে সেদিন আর কোন খাবার গ্রহণ করে না। যদিও এটাকে উপবাস বলা চলে না। তবুও শৃংখলিত আহার বিধি ধ্যান এবং সুস্বাস্থ অর্জনে সাহায্য করে। গৌতম বুদ্ধ প্রথম জীবনে অর্থ্যাৎ রাজপুত্র সিদ্ধার্থ দুজন শিক্ষকের তত্বাবধানে শিক্ষাগ্রহণ করেন। এসময়ে তিনি খুবই কম খাদ্য গ্রহণ করতেন। পরবর্তীতে তার উপদেশ মালায় তিনি কম খাদ্য গ্রহণের কথা উল্লেখ করেন। বৌদ্ধ ধর্মানুসারীদের সপ্তাহের একটি দিনে অষ্টবিধান অনুসরন করতে বলা হয়েছে যাতে দুপুর থেকে পরদিন সকাল পর্যন্ত উপবাসের বিধান রয়েছে। বজ্রযান অনুসারীরা নুয়াং নে অনুসরণ করে যা তান্ত্রিক অনুশাসন চেনরেজিগের মত।
খ্রিস্টান ধর্ম
খ্রিস্ট ধর্মের বাইবেল বইয়ের মধ্যে ইসাইয়াহ (৫৮:৬-৭), জাকারিয়াহ (৭:৫-১০), বুক অফ দানিয়েলে উপবাসে কথা বলা হয়েছে। তবে এখানে উপবাসে খাদ্য পানীয় পরিহারের বদলে সৃষ্টিকর্তার আদেশ পূর্ণরূপে প্রতিপালন করতে গরীব এবং দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্যের কথা বলা হয়েছে। বুক অফ দানিয়েলে আংশিক উপবাসের কথা বলা হয়েছে।
খ্রিস্টধর্মের বিভিন্ন শাখা বা চার্চ উপবাস পালন করে থাকে। তবে কিছু শাখা এটাকে পালন করে না। ক্যাথলিক চার্চ এবং ইস্টার্ণ অর্থোডক্স চল্লিশ দিনের আংশিক উপবাস পালন করে থাকে। ইথিওপিয়ান অর্থোডক্স চার্চ বছরে কয়েকবার সপ্তাহব্যাপী আংশিক উপবাস পালন করে। উক্ত সময়ে তারা মাংস এবং দুগ্ধ আহার থেকে বিরত থাকে।
বাইবেলে (লেভিক্টাস ২৩:২৭,৩১) বলা হয়েছে, সবার উচিত সপ্তম মাসের নবম দিনের সন্ধ্যা থেকে দশম দিনের সন্ধ্যা পর্যন্ত কোনরূপ খাদ্য গ্রহণ না করা।
হিন্দু ধর্ম
হিন্দু ধর্মে উপবাস একটি আনুসংগিক অংশ। ব্যক্তিগত বিশ্বাস এবং আঞ্চলিক রীতিনীতি অনুসারে হিন্দু ধর্মে বিভিন্ন ধরনের উপবাস প্রচলিত আছে। অনেক হিন্দু মাসের নির্দিষ্ট কিছু দিন যেমন একাদশী, প্রদোষ অথবা পূর্ণিমাতে উপবাস পালন করেন। সপ্তাহের কয়েকটি দিন নির্দিষ্ট দেবতার জন্য উপবাস পালন করার বিধান আছে অনেক অঞ্চলে। যেমন সোমবার শিবের জন্য, বৃহস্পতিবার বিষ্ণুর জন্য এবং শনিবার আয়াপ্পার জন্য উপবাস পালন করা হয়। মঙ্গলবারে দক্ষিণ ভারত এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে উপবাস পালন করা হয়। দক্ষিণের হিন্দু জনগোষ্ঠী বিশ্বাস করে মঙ্গলবার শক্তির দেবী মারিয়াম্মানের জন্য উৎসর্গ করা হয়েছে। উপবাসকারীরা সূর্যোদয়ের আগে খাবার গ্রহণ করে মুসলিমরা যেমন সেহেরি খায় এবং সূর্যাস্তের পরে তারা উপবাস ভংগ করে। তবে এই উপবাসকালীন সময়ে তারা পানীয় জল পান করে থাকে। উত্তর ভারতে মঙ্গলবার দেবতা হনুমানের জন্য নির্দিষ্ট। উপবাসকারীরা এইদিনে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্তকালীন সময় পর্যন্ত শুধুমাত্র দুধ এবং ফল খেয়ে থাকেন।
উত্তর ভারতের হিন্দু্রা মধ্যে বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে। উপবাসকারী একটি গল্প বা শ্রুতি শ্রবনের মাধ্যমে উপবাস শুরু করে। বৃহস্পতিবারের উপবাসকারীরা বৃহস্পতি মহাদেবের পূজা করে। তারা হলুদ কাপড় পরে এবং হলুদ রঙের খাবার খেতে পছন্দ করে। এদিন মহিলারা কলা গাছের পূজা করে এবং জল ঢালে। হলুদাভ বর্ণের ঘি দিয়ে খাবার প্রস্তুত করা হয়। বৃহস্পতিবার গুরুর জন্য উৎসর্গ করা হয়। যে সকল হিন্দুরা গুরু মন্ত্র গ্রহণ করে তাদের অনেকেই বৃহস্পতিবার উপবাস পালন করে থাকে।
ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যেও উপবাস পালন করা হয়। যেমন মহাশিব রাত্রীতে অধিকাংশ হিন্দু উপবাস পালন করে এবং তারা একবিন্দু জল পর্যন্ত পান করে না। নভরাত্রিতে উপবাস পালন করে। ভারতের অনেক অঞ্চলের বিবাহিত হিন্দু রমনীরা স্বামীর সুস্বাস্থ্য, আয় উন্নতি, দীর্ঘায়ু কামনা করে উপবাস পালন করে থাকে। একটি ঝালরের মাধ্যমে চাঁদ দেখার মধ্য দিয়ে তারা এই উপবাস ভংগ করে। শ্রাবণ মাসে অনেকে শ্রাবন উদযাপন করে। এই সময়ে অনেকেই সপ্তাহের একটি দিন তারা তাদের পছন্দের দেবতার জন্য উপবাস করে। আবার অনেকেই পুরো শ্রাবন মাস উপবাস পালন করেন।
অন্ধ্রপ্রদেশে কার্তিক মাসের শুরুর দিনে অনেক হিন্দু বিশেষ করে রমনীরা উপবাস পালন করে থাকে। এ মাসের সোমবার তারা শিবের জন্য, পূর্ন চন্দ্রের দিন কার্তিকের জন্য উপবাস পালন করে থাকে।
শ্রী বিদ্যায় উপবাস করতে নিষেধ করা হয়েছে। এই তান্ত্রিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে দেবী মানুষের মধ্যে বাস করেন। তাই কেউ যদি ক্ষুধার্ত থাকে তবে দেবীও ক্ষুধার্ত থাকে। শ্রীবিদ্যায় শুধু মাত্র পিতা মাতার মৃত্যু বার্ষিকীতে উপবাসে কথা বলা হয়েছে।
মহাভারতের অনুশাসন পর্বে একাধিকবার উপবাসের কথা বলা হয়েছে। ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে উপদেশ দিয়ে বলেন, ‘উচ্চজ্ঞানের উপবাস প্রথা পালন করো যার কথা সবাই জানে না।’
জৈন ধর্ম
জৈন ধর্মে বিভিন্ন ধরনের উপবাস প্রথা পচলিত আছে। এর একটি হচ্ছে চৌবিহার উপবাস যাতে পরবর্তী দিনের সূর্যোদয় পর্যন্ত কোন প্রকার খাবার বা জল গ্রহণ করা যায় না। আরেকটি উপবাস ব্রত হচ্ছে ত্রিবিহার উপবাস যেখানে কোন খাবার খাওয়া যায় না কিন্তু ফুটানো পানি পান করা যায়। জৈন ধর্মমতে যে কোন উপবাসের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অহিংসা অর্জন। সাধারনত পাজ্জ্যশনে উপবাস পালন করা হয়। কোন ব্যক্তি যদি পাজ্জ্যশনে আটদিন উপবাস পালন করে তবে তাকে বলা হল আত্থাই এবং দশদিন উপবাস করলে বলা হয় দশ লক্ষন। আর মাসব্যাপী উপবাস পালন করলে বলা হয় মশখমন।
জৈনদের মধ্যে উপবাস পালন না করে খুবই কম খাবার আহার করার রীতি অতি সাধারণ দৃশ্য। যে সকল ব্যক্তিরা মসুরের ডাল এবং স্বাদহীন খাবার শুধুমাত্র লবন ও মরিচ দিয়ে খেয়ে থাকেন তাদের বলা হয় আয়ামবলি। জৈনরা দিনে একবার মাত্র খাবার গ্রহণ করে একাসসন নামে উপবাস পালন করে। দিনে দুই বার খাবার খেয়ে বিয়াসন উপবাস পালন করে।
ইহুদি ধর্ম
ইহুদি ধর্মে উপবাস মানে সকল ধরনের খাবার ও পানি গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। ঐতিহ্যগতভাবে ইহুদিরা বছরে ছয়দিন রোজা পালন করে থাকে। ইয়াম কিপ্পুর হচ্ছে ইহুদি বর্ষপঞ্জিকার সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন সকল পূর্ণবয়স্ক নারী পুরুষ উপবাস পালন করে থাকে। এই পবিত্র দিনে তারা উপসনার চেয়ে উপবাসকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে। যদি কেউ উপবাস পালন করে বিছানায় শুয়ে থাকে তবুও সে পূর্ণ ধর্মীয় বিধান পালনের পূণ্য লাভ করবে।
দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপবাসের দিন তিশা বাব। আনুমানিক ২৫০০ বছর আগে এই দিনে ব্যবলনিয়া জেরুজালেমের প্রথম পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয় এবং প্রায় ২০০০ বছর আগে রোমানরা জেরুজালেমের দ্বিতীয় পবিত্র মন্দির ধ্বংস করে দেয়। তিশা বাব এ ইহুদিরা বিভিন্ন ট্রাজেডিতে পতিত হয়েছে। সেই উপলক্ষ্যে তারা এই দিনটিকে পালন করে। এমনকি দ্বিতীয় যুদ্ধে সংঘটিত হলোকাস্টও এই তিশা বাবের সময়ে সংঘটিত হয়।
এসএ/