বিলুপ্তির পথে মেটাল ক্রাফট শিল্প
প্রকাশিত : ১৮:৩৮, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ১৯:৩৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
আধুনিকতার ছোয়াঁয় হারিয়ে যেতে বসেছে অনেক পুরানো শিল্প। যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাতে আসছে পরিবর্তন। ধাতুর তৈরি পণ্য থেকে বেরিয়ে মানুষ এখন প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের পণ্যে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে। ফলে শতাব্দীর পুরানো অনেক শিল্পের মতোই হারিয়ে যেতে বসেছে মেটাল ক্রাফট শিল্প।
ঢাকার অদূরে ধামরাই বাসস্ট্যান্ড থেকে রিকশা যোগে ভুলিভিটাতে যেতেই চোখে পড়ে বিশাল রথ। পূজায় ব্যবহার করার পর সারা বছর এখানেই ফেলে রাখা হয় বিশাল এই রথটি। রথ পার হতেই দেখা যায় মেটাল ক্রাফট তৈরির কারখানাগুলো। কারখানাগুলো চোখে পড়লেও খুজে পাওয়া যায়নি কারিগরদের। অনেকে কারখানার মাল সড়িয়ে ঘরে আবার বসবাসও শুরু করেছে। বিদায় জানিয়েছে ২০০ বছরের পুরানো এ শিল্পকে। ফলে মেটাল ক্রাফট কারখানা এলাকাতে আসার পরও ধামরাই মেটাল ক্রাফট থেকে দুই থেকে তিনটি কাসার থালা তৈরির আওয়াজ কানে আসলেও আর কোন শব্দ শোনা যায়নি।
ধামরাই মেটাল ক্রাফটের মালিক সুকান্ত ভূষণ বণিক বলেন, ২০০ বছরের পুরানো শিল্প এটা। ১৯৭৩ সালে জন্মের পর থেকেই দেখে আসছি বাবা-দাদারা এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাবা ফণি ভূষণ বণিকের পর আমিই এ ব্যবসা পরিচালনা করছি। বাবা যখন জীবিত ছিলেন তখন কারখানায় দৈনিক ২২/২৫ জন শ্রমিক কাজ করতো। পণ্যের চাহিদা দিন দিন কমে যাওয়ায় ব্যবসা পরিচালনা করে শ্রমিকের মজুরির টাকা পর্যন্ত আয় করা সম্ভব না হওয়ায় শ্রমিকের সংখ্যা কমিয়ে বর্তমানে পাঁচজন করা হয়েছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এ এলাকায় দুই শতাধিক কারখানা ছিল। বন্ধ হতে হতে যার সংখ্যা বর্তমানে ১০টিতে এসে দাড়িয়েছে। পূর্বে ধামরাই ছাড়াও সাভারের শিমুলিয়াতেও বেশ কয়েকটি কারখানা ছিল কিন্তু বর্তমানে সেগুলোর সবগুলোই বন্ধ রয়েছে।
মেটাল ক্রাফট প্রবীণ নকশাকারী রঞ্জন দাশ জানান, স্বাধীনতা যুদ্ধের পর এই ব্যবসা রমরমা ছিল। সপ্তাহে শুক্র ও সোমবার স্থানীয় হাটের দিন শ্রমিকদের মজুরির সব বকেয়া টাকা পরিশোধ করা হতো। মজুরির টাকা পেয়ে হাটে গিয়ে কেনাকাটা করতাম আমরা অনেকেই। ব্লাস মেটাল সমবায় নামে এই শিল্পের একটি সমিতির কার্যক্রমও শুরু হয় সে সময়। কিন্তু কালক্রমে তা বন্ধ হয়ে যায়। এখন আমাদের মত প্রবীণ নকশাকারীরা সারাদিন নকশা কেঁটে ২০০-২৫০ টাকা আয় করতে পারে না। অথচ একজন সারা দিন রিকশা চালিয়ে ৫০০ টাকা আয় করে। ফলে নতুন করে কেউই এ শিল্পের সঙ্গে জড়াতে চাচ্ছে না। শুধু রঞ্জন দাশ নয় সব কারখানার শ্রমিকই একই সুরে সরকারকে এ শিল্প রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
ধামরাই মেটাল ক্রাফটের মালিক সুকান্ত ভূষণ বণিকের কাছে মেটাল ক্রাফট তৈরির পদ্ধতি জানতে চাইলে তিনি জানান, পূর্বে বিদেশ থেকে কাঁচামাল হিসেবে তামা, কাসা, পিতল ও বোঞ্জ নিয়ে এসে কাজ করা হলেও এখন ব্যবসার অবস্থা খারাপ হওয়ায় রাজধানীর মিডফোর্ড ও বন্দন নগরী চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ড এলাকা থেকেই কিনে পানিপথে ধামরাই আনার পর ভ্যানযোগে কারখানায় নিয়ে আসা হয়।
কাঁচামালের দাম সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আমরা রাজধানীর মিডফোর্ড থেকেই কাঁচামাল নিয়ে আসি। সেখানে প্রতি কেজি পিতল ৩৫০-৪০০ টাকা, প্রতি কেজি তামা ৫৫০-৬০০ টাকা, প্রতি কেজি কাসা ৯০০ টাকা ও প্রতি কেজি এক হাজার ৫০০ থেকে এক হাজার ৬০০ টাকা। তবে বর্তমানে কেউই বোঞ্জ কিনে না সেক্ষেত্রে নির্দিষ্ট পরিমানে কাসা ও কপার মিশিয়ে বোঞ্জ তৈরি করে ব্যবহার করে থাকে। এছাড়াও মিডফোর্ড থেকে ধামরাই পর্যন্ত কাঁচামাল নৌকা প্রতি ৮০০ থেকে এক হাজার টাকা খরচ হয়। তারপর ধামরাই থেকে কারখানা পর্যন্ত ভ্যানে করে কাঁচামাল আনতেও কিছু খরচ করতে হয়।
কাঁচামাল আনার পর মোম, কাদা ঢালাই, বালি কাস্টিং ও হ্যামারিং এ চার পদ্ধতিতে মেটাল ক্রাফটগুলো তৈরি করা হয়। তবে পদ্ধতিগুলোর মধ্যে মোম পদ্ধতি অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময় সাপেক্ষ হওয়ায় এ পদ্ধতিতে তৈরিকৃত ক্রাফটের দাম অনেক বেশি হয়। বর্তমানে মাসে ১০/১২টা কাসার থালার অর্ডার ছাড়া আর কোন অর্ডার না থাকায় হ্যামারিং ছাড়া অন্য তিন পদ্ধতিতে ক্রাফট তৈরি নেই বললেই চলে। মাঝে মধ্যে কিছু ক্রেতা ছোট ছোট মেটাল হাতি-ঘোড়া কিনতে আসলে কাঁদা ঢালাই ও বালি কাস্টিং পদ্ধতিতে তৈরি করা হয়। এছাড়াও লোহার তৈরি কলমের ওপর হাতুরি পিটিয়ে মেটাল ক্রাফটের বাইরের গায়ে বিভিন্ন নকশা কাটা হয়।
এ শিল্পের সহায়ক জলবায়ু সম্পর্কে তিনি বলেন, মোম পদ্ধতির জন্য গরমের সময়টা ভালো, কারণ শীতে মোম দ্রুত জমাট বেঁধে যায়। আবার কাঁদা ঢালাই ও বালি কাস্টিং পদ্ধতির জন্য শীতের সময়টা ভালো তাতে ঢালাই দ্রুত জমাট বাঁধে। ব্যবসার জন্য সবচেয়ে খারাপ হলো বর্ষাকাল। এসময় এ শিল্পের প্রয়োজনীয় অন্যান্য উপকরণ যেমন ধানের তুষ, খড়, পাটের আঁশ ইত্যাদি ভিজা থাকে। তাছাড়া কাদা ঢালাই ও বালি কাস্টিং এর পণ্য শুকানোর জন্য রোদ অবশ্যই দরকার। বৃষ্টির মধ্যে এগুলো শুকানো কষ্টকর ব্যাপার।
এ সব পণ্যেও ক্রেতাদের সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি জানান, আগে এ সব পণ্য বিদেশে রফতানি করা সহজ ছিল। বর্তমানে কাস্টমস কর্মকর্তারা মাসের পর মাস ফেলে রাখার পরও পণ্য রফতানি করতে দিতে চায় না। বিদেশি ক্রেতারা অধৈর্য হয়ে আমাদের পণ্য কেনা বন্ধ করে দিয়েছে। ফলে বর্তমানে আমাদের একমাত্র ভরসা দেশীয় ক্রেতারা। এখন দেশি বাজারে সস্তায় প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়ামের সব পণ্যই হাতের নাগালেই পাওয়া যায় বলে দুএকজ কাসার থালার ক্রেতা ছাড়া তেমন কোন ক্রেতাই নেই।
তিনি আরও জানান, কাঁচামালের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদিত পণ্যের সর্বনিম্ন মূল্য এক হাজার ৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত।
এ শিল্প সম্পর্কে তিনি আরও জানান, আমার পাঁচ পুরুষ এ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। পূর্বে এটা অবৈধ ব্যবসা না হলেও বর্তমানে মাঝে মাঝে প্রশাসনের লোক এসে আমাদের ব্যবসা বন্ধ করার কথা বলে। জানতে চাইলে বলে এ ব্যবসা অবৈধ। এ রকম হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স, ট্যাক্স দেওয়ার রসিদসহ সব কাগজপত্র নিয়ে জেলা প্রশাসকের কাছে গেলে তিনি এ ব্যবসাকে অবৈধ উল্লেখ করে বলেন, আগে কিভাবে ট্যাক্স নিতো জানি না। এ ব্যবসার মাধ্যমে দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ বিদেশে রফতানি হয়ে যায়। এ ব্যবসা অবৈধ। সেক্ষেত্রে আমাদের বাবা-দাদার পুরানো ব্যবসা বুঝি আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে না।
তবে বাণিজ্য মেলায় এ পণ্যের সুবিধা তুলে ধরাসহ ব্যাংক হতে এ ব্যবসার জন্য সুদমুক্ত ঋণের ব্যবস্থা করা, পণ্য উৎপাদনে প্রশাসনের বাধা বন্ধ করা, রফতানি ক্ষেত্রে কাস্টমস এর হয়রানি বন্ধ করা ও বিশ্বের দরবারে এ সব পণ্যের সুবিধা তুলে ধরলে মৃত প্রায় শিল্পটি পুনজীবিত হতে পারে।
আরএ /এসএইচ/
আরও পড়ুন