ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪

বিলুপ্তির পথে ১৪টি ভাষা

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:১৪, ৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ০০:০৬, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৮

বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে যে কয়টি কারণে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে অন্যতম ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষার স্বীকৃতি। কিন্তু সেই বাংলাদেশেই বিপন্ন হয়ে যাচ্ছে অনেকগুলো মাতৃভাষা।

ধারণা করা হচ্ছে ত্রিশ থেকে চল্লিশ বছর পর এসব ভাষার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যাবে না। তেমনি একটি ভাষা হচ্ছে রাঙামাটি সাজেক আঞ্চলের শৌরা ভাষা। এই ভাষায় কথা বলে মাত্র পাঁচ জন মানুষ। পার্বত্য এলাকার রেংমির্চা ভাষা অবস্থাও একই রমক। এ ভাষায় কথা বলে মাত্র জনাচল্লিশেক মানুষ। এদের সবার বয়স পঞ্চাশের ঊর্ধ্বে। ভাষা গবেষকরা মনে করছেন, জীবিত এই মানুষগুলোর মৃত্যুর পরই এই ভাষাগুলোতে কথা বলার মত আর কেউ থাকবে না। ফলে ভাষাগুলো হারিয়ে যাবে চিরতরে।

দিনাজপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় মাত্র ঊনিশটি পরিবারের শখানেক মানুষ কথা বলে ‘কড়া’ ভাষায়। শুধু শৌরা বা রেংমির্চা নয়- এরকম বিপন্ন ভাষার তালিকায় রয়েছে কোদা, মেগাম, পাঙ্গুখুয়া, বম, চাক, আসোচিন, মরু, কুরুক্স, প্নার, সৌরিয়া, খেয়াং, কড়া, খোজী, কন্দু, মুণ্ডা ইত্যাদি ভাষা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক সৌরভ শিকদারের ভাষ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে এরকম বিপন্ন ভাষার পরিমাণ চৌদ্দটি। যার সব কয়টিই আদি ভাষা। এসকল ভাষায় যারা কথা বলেন তাদের উত্তরসূরীরা কেন এ ভাষায় কথা বলছেন না-এমন প্রশ্নের জবাবে সৌরভ শিকদার বলেন, এসব ভাষা শিখে তাদের কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব ভাষার কোনো ব্যবহারিক দিক না থাকায় তারা এসব ভাষা শিখতে আগ্রহী হচ্ছে না।

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে বাংলা সহ মোট ভাষার পরিমাণ ৪১টি। এর মধ্যে আদিবাসী ভাষা ৩৩ টি। যার ১৫ টিকেই বিপন্ন ভাষা হিসেবে দেখছেন গবেষকরা। এ ছাড়াও ইতোমধ্যে দেশে ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর ভাষার মধ্যে পুরোপুরি হারিয়ে গেছে এমন ভাষাগুলো হলো রাজবংশী, রাই, বাগদি, কোচ, হদি ও ভালু ইত্যাদি।

ওঁরাও, মুণ্ডা, মালো, রাউতিয়া, মুশহর ও শবর ভাষাভাষী লোকেরাও নিজেদের ভাষার অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারেনি। গবেষকরা বলছেন, সিং, কর্মকার, গণ্ড, বেদিয়া, বর্মন ও লোহার ভাষাও আগামী কোন এক সময় ঝুঁকির মধ্যে পড়ার সম্ভাবনা আছে।

জাতিসংঘ শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা-ইউনেস্কো মতে, পৃথিবীতে কোনো ভাষায় যদি কথা বলা লোকের পরিমাণ পাঁচ হাজারের কম হয় তবে তা বিপন্ন ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হবে। এই হিসেবে বাংলাদেশে বিপন্ন ভাষার পরিমাণ চৌদ্দটি। ভাষা বিজ্ঞানী সৌরভ শিকদার বলেন, বিশ হাজার লোক কথা বলে এমন ভাষাও আমাদের দেশে আছে। তবে আমরা সেগুলোকেও বিপন্ন ভাষার তালিকায় রেখেছি। কারণ এর পরে এই ভাষাগুলোতে কথা বলা বা চর্চা করার মতো কেউ থাকবে না।

বর্তমানে ইন্টারনেটের যুগে কেন ভাষা সংরক্ষণ করে রাখা হচ্ছেনা-এমন প্রশ্নের জবাবে ভাষাবিজ্ঞানী সৌরভ শিকদার বলেন, ভাষাগুলো সংরক্ষণ করতে হলে প্রথমে ভাষাগুলোর প্রশিক্ষক দরকার। প্রশিক্ষকরা বিলুপ্ত প্রায় ভাষার ওই অঞ্চলগুলোতে গিয়ে প্রথমে ভাষাগুলো লিপিবদ্ধ করতে হবে। পরে তা সংরক্ষণ করতে হবে। আর এটি খুবই ব্যায়বহুল। রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা ছাড়া এ ভাষাগুলো সংরক্ষণ সম্ভব নয়।

তিনি আরও বলেন, সেসব ভাষা লিপিবদ্ধ হলেও সংরক্ষণ সহজ হবে না। কেননা, আগামীতে এসব ভাষা চর্চা করার মতো কেউ নেই। ফলে এখন যারা এসব বিপন্ন ভাষায় কথা বলে তাদের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যাবে এই বিপন্ন ভাষাগুলোর আয়ুষ্কাল। উদাহরণ দিতে গিয়ে তিনি সংস্কৃত ভাষা ও ল্যাটিন ভাষার উদাহরণ টানেন যা কাগজে থাকলেও বাস্তবে কারো চর্চায় নেই।

গবেষকরা বলছেন, পার্শ্ববর্তী শক্তিশালী ভাষার চাপে ক্ষুদ্র ও অবহেলিত ভাষা হারিয়ে যাওয়ার উদাহরণ নতুন নয়। তবে জাতিগত সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষায় এ ভাষাগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ একদিকে যেমন অন্যের মাতৃভাষার প্রতি সম্মান দেখানো হয় তেমনি পুনরুদ্ধার সম্ভব হয় অনেক পুরনো সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য।

 

টিকে/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি