বুদ্ধের শিক্ষা ও বিশ্বমানবতা
প্রকাশিত : ১২:৩৩, ৬ মে ২০২৩
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে যারা প্রতিবাদী ধর্মকে ভারত তথা বিশ্বে সর্বাধিক জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন গৌতম বুদ্ধ ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম। গৌতম বুদ্ধের এই কৃতিত্বের জন্য ইতিহাসবিদ ড. এ. এল. বাসাম বলেছেন যে, বুদ্ধ ছিলেন এযাবৎকালের ভারতের শ্রেষ্ঠ সন্তান।"
বৌদ্ধ ধর্মের প্রবর্তক গৌতম বুদ্ধ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে নেপালের তরাই অঞ্চলের কপিলাবস্তুর লুম্বিনী উদ্যানে শাক্য নামে এক ক্ষত্রিয় রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শুদ্ধোধন ছিলেন কপিলাবস্তুর রাজা। তার মায়ের নাম ছিল মায়াদেবী। বুদ্ধের জন্ম তারিখ সম্পর্কে বিতর্ক থাকলেও অধিকাংশ ইতিহাসবিদ ৫৬৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দকে গৌতম বুদ্ধের জন্মকাল হিসাবে মেনে নিয়েছেন।
রাজকীয় বিলাস-বৈভব গৌতম বুদ্ধের মনকে মোটেই আকৃষ্ট করতে পারেনি। মানবজীবনের হতাশা, দুঃখ, জরা-ব্যাধি প্রভৃতির চিন্তা তাকে আকুল করে তোলে। তিনি সংসার সম্পর্কে ক্রমে উদাসীন হয়ে পড়লে পিতা শুদ্ধোধন মাত্র ১৬ বছর বয়সে তাকে গোপা বা যশোধরা নামে সুন্দরী রাজকন্যার সঙ্গে বিবাহ দেন। ক্রমে সংসার জীবনে দুঃখ, জরা-ব্যাধি এবং মৃত্যুর বিষয়গুলো গৌতম বুদ্ধকে খুব ভাবিয়ে তোলে। বৌদ্ধধর্মে এই তিনটি বিষয়কে "ত্রিতাপ" বলে।
মানবজীবন থেকে "ত্রিতাপের যন্ত্রণা" মোচনের জন্য তিনি উদ্গ্রীব হয়ে ওঠেন। ২৯ বছর বয়সে রাহুল নামে তার এক পুত্রসন্তান জন্মগ্রহণ করে। গৌতম সংসারের মায়ার বন্ধন ছিন্ন করতে রাজকীয় ঐশ্বর্য, পুত্র রাহুল ও স্ত্রী যশোধরাকে ত্যাগ করে একদিন গভীর রাতে তিনি গোপনে গৃহত্যাগ করেন। তার এই গৃহত্যাগের ঘটনা "মহাভিনিস্ক্রমণ" নামে পরিচিত।
গৃহত্যাগের পর গৌতম বুদ্ধ দীর্ঘদিন কঠোর কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যার পর দিব্যজ্ঞান লাভ করেন এবং "বুদ্ধ" বা "মহাজ্ঞানী" হয়ে ওঠেন। এসময় থেকে তিনি "গৌতম বুদ্ধ" বা 'তথাগত' নামে পরিচিত হন।
দিব্যজ্ঞান লাভের পর গৌতম বুদ্ধ মানবকল্যাণের কথা ভেবে তার মতাদর্শ প্রচার করেন।
তিনি সর্বপ্রথম সারানাথের মৃগদাবে তার পাঁচজন অনুরাগীর মধ্যে তার ধর্মমত প্রচার করেন এবং তাদের বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করেন। এরা হলেন কৌন্ডিণ্য, ভদ্রিক, অশ্বজিৎ, বাষ্প এবং মহানাম। এই ধর্মপ্রচারের ঘটনা বৌদ্ধধর্মে "ধর্মচক্রপ্রবর্তন" নামে পরিচিত।
এরপর দীর্ঘ ৪৫ বছর ধরে তিনি উত্তর ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বিভিন্ন স্থানে তার ধর্মমত প্রচার করেন। মগধের রাজা বিম্বিসার ও অজাতশত্রূ, কোশল-রাজ প্রসেনজিত ও তার স্ত্রী মল্লিকা, পন্ডিত সারিপুত্ত, ব্যবসায়ী অনাথপিন্ডক, পতিতা আম্রপালি, নাপিত উপালি প্রমুখ তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।
বুদ্ধের জন্ম ও ধর্ম প্রচারের মধ্য দিয়েই পৃথিবীর বুকে এমন একটি সর্বজনীন ধর্ম প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার বাণী ছিল আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ এবং অন্তে কল্যাণ; যা সম্পূর্ণ অহিংস ও মানবতাবাদী। সর্ব জীব ও সর্ব মানুষের সুখ-শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধর্ম। অতএব, বিশ্বের সব জীবের মুক্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়েছে এ ধর্মে এবং সব মানুষের মানবিক মূল্যবোধ ও অধিকারের সুযোগও দেওয়া হয়েছে। এ জন্যই মহামানব বুদ্ধের বাণীগুলো চিরন্তন, শাশ্বত এবং মানবিক আবেদনে পরিপূর্ণ।
গৌতম বুদ্ধের শিক্ষা হলো বিশ্ব মানবতার এবং ইহজাগতিক পারমার্থিক জীবনের। বৌদ্ধমতে, শীল সমাধি প্রজ্ঞাময় জীবনের মধ্য দিয়েই একজন মানুষের সর্বোত্তম জীবন গড়ে ওঠে, যেখানে তিনি হন সত্য, সুন্দর ও নীতিবান এবং মানবজীবনের সর্বোচ্চ দুঃখ মুক্তিমার্গ লাভ করতে সক্ষম হন। তাই শীল সমাধি প্রজ্ঞা সাধনাই বৌদ্ধ ধর্মের প্রধান ব্রত। অন্যদিকে মানুষের নৈতিক ও চারিত্রিক সাধনার বিষয়টিকে বৌদ্ধ ধর্ম বিশেষভাবে গুরুত্ব দিয়েছে। বৌদ্ধমতে, শীলময় জীবন, সমাধি এবং প্রজ্ঞাময় জীবনই মানুষকে সৎ পথে পরিচালিত করে এবং বিশ্ব মানবতাকে আলোকিত করতে পারে। তাই বৌদ্ধশাস্ত্র বলে, যে মানুষ যত বেশি শীলাচারণসম্পন্ন, সমাধিপরায়ণ ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন, তিনি তত বেশি জীবনে সুখী, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ অবস্থানে বসবাস করতে পারেন এবং বিশ্ব মানবতার সেবা দিতে পারেন।
তাই বৌদ্ধ জীবন পদ্ধতিতে এবং বৌদ্ধ মানস গঠনের লক্ষ্যে প্রথমে পঞ্চশীল বা পঞ্চনীতির কথা বলা হয়েছে, যেখানে একজন ব্যক্তি তার জীবনের প্রথম থেকেই এই সৎগুণ চর্চার মাধ্যমে তার জীবনকে আদর্শায়িত করতে পারেন। এ পঞ্চনীতিতে ব্যক্তি শুধু নিজেই যে নীতিপরায়ণ হয় তা নয়, সমাজ ও রাষ্ট্রের অন্যকেও নীতিবোধে উদ্বুদ্ধ করে। এ জন্যই আমাদের ব্যবহারিক জীবনের সব পর্যায়ে বৌদ্ধ পঞ্চনীতির শিক্ষা সার্থকভাবে অনুশীলন করা উচিত।
বৌদ্ধ পঞ্চনীতিতে বলা হচ্ছে-১. কোনো ধরনের প্রাণীকে বধ কিংবা আঘাত না করা, ২. কোনো ধরনের চৌর্যবৃত্তি না করা, ৩. কোনো ধরনের কামাচার কিংবা অবৈধ ব্যভিচার না করা, ৪. কোনো ধরনের মিথ্যা না বলা এবং সর্বশেষ ৫. কোনো ধরনের নেশা বা মাদকদ্রব্য সেবন না করা।
এখন নিজকে প্রশ্ন করুন, এ নীতিগুলো যদি আমি এবং আমরা সবাই পালন করি, তাহলে কখনো কি আমরা অন্যের ক্ষতির কারণ হতে পারি? আমরা কি কখনো জীবনে সহিংসতা, যুদ্ধ কিংবা কোনো ধরনের আঘাত বা সংঘাত করতে পারি? আমরা কি পারি অনৈতিক, অসামাজিক ও অমানবিক কাজ করতে? শীল পালনের গুরুত্বকে তাই বুদ্ধ সবিশেষ মর্যাদা দিয়েছেন। জীবনের সব ক্ষেত্রে এ পাঁচটি নীতি অনুশীলন করলে ‘শ্রেষ্ঠ জীবন’ গঠন করা যায়-যেখানে কোনো ধরনের পাপাচার ও অকল্যাণ থাকবে না।
আবার সৎ জীবন গঠন ও সৎ জীবন পরিচালনার জন্য বৌদ্ধ ধর্মে আটটি বিশুদ্ধ পথের কথা বলা হয়েছে, যাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা হয় ‘আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ’; যেমন-সৎ দৃষ্টি, সৎ বাক্য, সৎ কর্ম, সৎ জীবিকা, সৎ সংকল্প, সৎ প্রচেষ্টা, সৎ স্মৃতি এবং সৎ সমাধি। এগুলো ব্যক্তির ব্যবহারিক ও পারিবারিক জীবনে যেমন অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, তেমনি সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেও এর প্রয়োজনীয়তা অত্যধিক। এর প্রতিটি নীতি দিয়েই যদি আমাদের জীবন গঠন করা যায়, তাহলে আমরা কখনো পারি না সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বিশ্বের কোনো ধরনের ক্ষতি বা সংঘাত সৃষ্টি করতে।
বৌদ্ধ মতে, সামাজিক অস্থিরতা ও অসাম্য কখনো সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তি-শৃঙ্খলা নিয়ে আসতে পারে না। মানুষ সততার সঙ্গে চেষ্টা করলে তা দূর করতে পারে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান তৈরি করতে পারে। হিংসার ব্যবহারে প্রতিহিংসা ও সংঘাত সৃষ্টি হয় এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতিকর অবস্থা তৈরি হয়, যা পরে ধংসাত্মক যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্ম দেয়। তাই বুদ্ধ ও বৌদ্ধ ধর্ম জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে অহিংসা ও বিশ্ব মানবতার কথা বলেছেন।
বৌদ্ধ মতে ‘আত্মশক্তি’ জীবনের এক পরম সম্পদ। মানবজীবনে এ শক্তি উদ্বোধনের জন্য প্রত্যেক মানুষকে শ্রেষ্ঠত্বের সম্মানে ভূষিত করেছে। মানুষ হিসাবে আমি যেমন শ্রেষ্ঠ, আত্মশক্তিতেও আমি শ্রেষ্ঠ। সুতরাং আমি যদি উত্তম হই, সর্বশ্রেষ্ঠ হই, তাহলে আমার প্রতিটি কর্ম ও চিন্তাও হবে উত্তম ও সর্বশ্রেষ্ঠ। কারণ উত্তম মানুষ কখনো অধম কাজ করতে পারে না। শাস্ত্র বলছে, ‘হীনধম্ম ন সেবেয়্য, পমাদেন ন সংবসে, মিচ্ছাদিটইঠং ন সেবেয্য ন সিয়া লোকবন্ধনো।’ অর্থাৎ কখনো হীন আচরণ করো না, প্রমত্ত হয়োনা। এ জন্য ধর্মপদে বলা হয়েছে ‘কায়িক সংযম সাধুকর, বাচনিক সংযম সাধুকর, আর মানসিক সংযম সাধুকর; যিনি ত্রিবিধ দ্বারে সংযত তিনিই সর্বোত্তম সাধুকর।’
কী অসাধারণ বাণী বৌদ্ধ ধর্মের! এগুলো নিয়ে চিন্তা করলে সমাজের প্রত্যেক মানুষ হবে সৎ, সুন্দর ও নীতিবান। নীতিবান জীবনই একজন ব্যক্তির আদর্শ জীবন ও মহৎ জীবন। তাই বুদ্ধ বলেছেন, মন সব ধর্মের ঊর্ধ্বে। প্রদুষ্ট মনে কেউ যদি কিছু বলে বা করে তখন দুঃখের উৎপত্তি হয়, আর ভালো মনে কিছু বললে বা করলে সুখ ছায়ার মতো তার অনুগামী হয়।
‘ধর্ম’ হলো মানবজাতির সামগ্রিক কল্যাণের জন্য একটি উপাদানবিশেষ, যেখানে মানুষের সর্বাঙ্গীন কল্যাণ, মঙ্গল ও সুখ-শান্তি বিদ্যমান। ধর্ম মানুষের নীতিবোধ ও আদর্শকে গড়ে তোলে। এ জন্যই ধর্মের সঙ্গে ব্যক্তির, পরিবার ও সমাজের সম্পর্ক গভীর ও অবিচ্ছেদ্য। সুতরাং যেসব কর্মে ন্যায়-নীতি বা সদাচার থাকবে, তাকে বলা হয় সধর্ম। আর যেসব কর্মে এ গুণাবলির অভাব সেটি হলো ‘অধর্ম’।
অতএব, মানুষ যদি জীবনাচরণে, কর্মে ও চিন্তায় এবং জ্ঞান ও মননশীলতায় বড় না হয়, তাহলে সে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে পারে না। এ জন্যই বৌদ্ধ ধর্মে শীলাচার জীবন এবং নৈতিকতার কথা বারবার বলা হয়েছে। বৌদ্ধ ধর্ম শুধু আধ্যাত্ম সাধনার জন্য মুক্তি বা নির্বাণ লাভের কথা বলেনি, বরং এতে জীবনের সব ক্ষেত্রে মন্দ বা অসৎ প্রবণতা থেকে মুক্তি এবং জীবনের সব কার্যকলাপে সৎ, নির্লোভ, নির্মোহ এবং বিত্ত-বৈভবে অনাসক্ত ও তৃষ্ণাবিমুক্ত নির্বাণ লাভের কথা বলা হয়েছে।
মহামতি গৌতম বুদ্ধ শুধু জীবনের অনিত্যতা, জীবনের দুঃখ-দুর্দশা এবং পারমার্থিক জীবনদর্শন নিয়ে ভাবেননি, তিনি ভেবেছিলেন ব্যক্তিগত, সমাজ বা রাষ্ট্রীয় জীবনদর্শন নিয়ে, যা আমাদের প্রত্যেক মানুষের জন্য আজ অত্যন্ত অপরিহার্য। এমনকি ইহজাগতিক মানবতার সামগ্রিক কল্যাণের জন্যও। এ জন্যই বুদ্ধ তার নবধর্ম প্রচারের প্রথম বাণীতেই পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের নির্দেশ দিয়ে বলেছিলেন-‘হে ভিক্ষুগণ! তোমরা বহুজনের হিত ও বহুজনের সুখের জন্য এবং সামগ্রিক কল্যাণের জন্যই চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ো।’
৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে আশি বছর বয়সে উত্তরপ্রদেশর গোরক্ষপুর জেলার কুশীনগরে তিনি দেহত্যাগ করেন। বুদ্ধের দেহত্যাগের ঘটনা "মহাপরিনির্বাণ" নামে পরিচিত।
এমএম/