বেশি বেশি কাজ করাই এ সময়ের দেশপ্রেম
প্রকাশিত : ২১:০০, ২৯ জুলাই ২০২০
ডা. হাসনাইন নান্না
নীলফামারির সৈয়দপুরে রেলওয়ে কারখানা নিয়ে একটি খবর পড়লাম। পড়ে খুব আশাবাদী হলাম, উজ্জীবিত হলাম। কৃতজ্ঞতা বোধ করলাম শ্রমিক ও প্রকৌশলীসহ সকলের প্রতি। তাদের ধন্যবাদ ও অভিনন্দন। তারা দুই মাসের ভেতর তিন মাসের কাজ সম্পন্ন করেছেন। জুন-জুলাই মাসে তারা রেকর্ড পরিমাণ ১০২টি কোচ মেরামত করে দিয়েছেন। ঈদ-উল-আযহার আগে আগে তাদের এই অনবদ্য প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবি রাখে।
করোনার আঘাত থেকে ঘুরে দাঁড়াতে রেলওয়ে কারখানাটির অনন্য কার্যক্রম হতে পারে বাকি সকলের জন্য উদাহরণ। ‘হতে পারে’ নয়, আসলে ‘হওয়া উচিত’। এই উদ্যোগটিকে এখন মডেল হিসেবে নেয়া প্রয়োজন। কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা সকল ক্ষেত্রেই এটি সকল পেশাজীবির জন্য মডেল হওয়া জরুরি। কারণ মার্চের শেষ ভাগ থেকে আমরা বহু ক্ষেত্রে এক ধরনের কর্মহীনতার কাল অতিক্রম করছি। অনেকেরই কাজ নেই। অনেকেই কাজ হারিয়ে বেকার বা অর্ধ বেকার। অনেকেরই কাজ আছে, কিন্তু কাজ করার স্বাধীনতা ও সুযোগ না থাকায় তারা কাজ করছেন না। এরকম এক সময়ে রেলওয়ের সকল পর্যায়ের কর্মীরা আন্তরিকভাবে পরিশ্রম করে দেশসেবার দারুণ উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। দেশপ্রেমের অনন্য অনুপ্রেরণা তৈরি করেছেন।
সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারি সাধারণ ছুটির আওতায় পড়েছিল সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। তবে ৩১ মে থেকে পুনরায় সীমিত পরিসরে চালু করা হয় এর কার্যক্রম। এ অবস্থায় কারখানায় জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসে মেরামতের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা ১০১টি কোচ। কিন্তু শ্রমিক-প্রকৌশলীদের নিষ্ঠার কারণে মাত্র দুই মাসেই ১০২টি কোচ মেরামত হয় কারখানায়, যা এর আগে কখনো সম্ভব হয় নি।
বিষয়টি আরেকটি কারণে উল্লেখযোগ্য। কোনো ধরনের ওভারটাইম (অতিরিক্ত কাজের মজুরি) ছাড়াই টানা কাজ করেছেন সবাই। এবং এই কারখানায় ২৯টি উপকারখানায় (শপ) পদ রয়েছে ২ হাজার ৮৩৩টি, এর বিপরীতে কর্মরত মাত্র ৮৪১ জন শ্রমিক-কর্মচারী। শতকরা ৩০ ভাগের নিচে জনবল নিয়ে এ বিশাল কর্মযজ্ঞ সম্পাদন করা আসলেই বিস্ময়কর। কিন্তু এই বিস্ময় এ দেশেরই মানুষ সৃষ্টি করেছেন। তাই আন্তরিক চেষ্টা ও দেশপ্রেম নিয়ে কাজ করলে অন্যরাও পারবেন বলে ভাবাটাই স্বাভাবিক। প্রকৃত দেশপ্রেমিক হওয়ার এটা একটা বড় সুযোগ- বেশি বেশি কাজ করে দেশকে এগিয়ে নেয়া, কাজের কোন সুযোগকেই হাতছাড়া না করা।
আসলে এখন বেশি বেশি কাজ না করেও কোন উপায় নেই। আমাদের দেশেরও নেই, অন্য কোন দেশেরও নেই। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বলছে, করোনাকালে সারা বিশ্ব জুড়ে কর্ম-ঘন্টা হ্রাস পেয়েছে। এ বছর প্রথম তিন মাসে কর্ম-ঘন্টা হ্রাস পেয়েছে (গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায়) পাঁচ দশমিক চার শতাংশ। যা এক কোটি ৫৫ লাখ মানুষের পূর্ণ দিবস কাজের সম পরিমাণ। এ বছরের এপ্রিল-জুনের হিসেব ধরলে এই ‘কর্মঘন্টা হ্রাসে’র পরিমাণ আরও ব্যাপক। গত বছরের শেষ তিন মাসের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ কম। যা চার কোটি মানুষের পূর্ণ দিবস কাজের সম পরিমাণ। অর্থাৎ সারা বিশ্বেই কর্ম-ঘন্টা কমে গেছে। কাজ কমে গেছে। যার প্রভাব পড়েছে অর্থনীতির ওপর।
আমরা যেহেতু রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের ভেতর দিয়ে একটি স্বাধীন দেশ পেয়েছি; যেহেতু মানবিক ভাবি নিজেদের, সেহেতু এখন অনেক বেশি কাজ করে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়াটাও আমাদের পক্ষে সম্ভব। এক তৃতীয়াংশ লোকবল নিয়ে যদি সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা তিনমাসের কাজ দুই মাসে শেষ করতে পারে, তাহলে অন্যান্য সব সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও পারবে বলে বিশ্বাস করা যায়।
তাই যারা চিকিৎসক তাদেরকে ডা. মশিউর রহমানের দিকে তাকাতে অনুরোধ করি। যিনি করোনা রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য স্বেচ্ছায় বদলির আবেদন করে সিরাজগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জ গিয়েছেন। যারা সরকারি কর্মকর্তা আছেন তাদেরকে টাঙ্গাইলের ইউএনও আসমাউল হুসনার দিকে তাকানোর অনুরোধ করি, যিনি করোনা-পীড়িত পরিবারের কাছে ছুটে গেছেন ‘মমতার দাওয়াই’ নিয়ে; মধ্যরাতে জঙ্গল থেকে বৃদ্ধাকে উদ্ধার করে পাঠিয়েছেন হাসপাতালে।
আর যারা এখনও করোনার ভয়ে ঘরে বসে আছেন, তাদেরকে অনুরোধ করি- দাফন-কর্মীদের দিকে একটু ভালভাবে খেয়াল করার। যে স্বেচ্ছাসেবকরা দিন রাত যখনই যেখানে প্রয়োজন হয়েছে ছুটে গেছেন, করোনায় মারা যাওয়া মৃত ব্যক্তিদের দাফন/সৎকারের জন্য।
অনেকে সমালোচনা করে বলেন, আমাদের নাকি তিন হাত। ডান হাত, বাম হাত আর অজুহাত। যে বলার বলুক। আমরা আপাতত এই তৃতীয় হাতটিকে কোথাও লুকিয়ে রাখতে চাই বা বেঁধে রাখতে চাই। আমাদের মহামূল্যবান ব্রেন আর কর্মঠ দুই হাত দিয়ে কাজের পরিমাণ দ্বিগুণ করতে চাই। আমাদের সামনে পর্যাপ্ত উদাহরণ তো ইতোমধ্যেই সৃষ্টি হয়েছে। এই উদাহরণগুলোই জাতিকে রক্ষা করেছে অমানবিক ও অকর্মন্য হওয়ার হাত থেকে। এই উদাহরণগুলোই আমাদের উজ্জীবনী শক্তি, আমাদের অনুপ্রেরণা। আগামী দিনগুলো আমরা সবাই হতাশা ভয় বিষন্নতা থেকে বেরিয়ে উজ্জীবিত হয়েই কাজ করে যেতে চাই।
লেখক- হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও সহযোগি অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ, খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ, সিরাজগঞ্জ।
এনএস/
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।