ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪

‘বোলো না সে নাই’

সেলিম জাহান

প্রকাশিত : ১৬:৪৮, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২০

বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম জাহান কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। সর্বশেষ নিউইয়র্কে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তরের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এর আগে বিশ্বব্যাংক, আইএলও, ইউএনডিপি এবং বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনে পরামর্শক ও উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। তার প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য বই- বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি, অর্থনীতি-কড়চা, Freedom for Choice প্রভৃতি।

আজ ২৩ সেপ্টেম্বর- দু’জন মানুষকে বড় মনে পড়ছে। দু’জনের মাঝখানে একটি অভিন্ন যোগসূত্র আছেন। সে যোগসূত্রটি শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী। কারণ ঐ ব্যক্তিদ্বয়ের একজন শহীদ অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর সন্তান ও অন্যজন তাঁর শিক্ষার্থী ও সহকর্মী। একজনের আজ প্রয়াণদিবস, অন্যদিকে  দ্বিতীয়জনের জন্মবার্ষিকী। দু’জনের ব্যাপারেই আমার একটা মুগ্ধতা আছে। 

তেইশে সেপ্টেম্বর অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের প্রয়াণ দিবস। আমাদের ছেড়ে গিয়েছিলেন তিনি ১৯৮৯ সনের ২৩ সেপ্টেম্বর। না, তাঁকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না, কিন্তু তাঁর সম্পর্কে আমার একটি গুণমুগ্ধতা ছিল। তাঁর প্রতিভা, তাঁর লেখা, তাঁর বাচনভঙ্গী, তাঁর রসবোধের ভীষণ ভক্ত ছিলাম আমি। তাঁর কবিতা, গান, গল্প ও প্রবন্ধ আমি ডুবে গিয়ে পড়তাম। ‘ছবির মতো এই দেশে বেড়িয়ে যান’ কবিতাটি বড় প্রিয় আমার। 

খুব সম্ভবত: ১৯৭২ সালে ‘থিয়েটার’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা- শহীদ মুনীর চৌধুরী সংখ্যায়- প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল তাঁর গুরু শহীদ মুনীর চৌধুরীর স্মৃতিতর্পণ করেছিলেন একটি দীর্ঘ খোলা পত্রের মাধ্যমে। অনন্য সাধারণ সেই লেখা। মায়াময় এক আবেশ তিনি ছড়িয়েছিলেন আমার হৃদয়ে। 

আমার খুব ভালো লাগতো যে, সত্যি কথা বলতে তিনি কাউকেই ছাড়তেন না। সোজা-সাপটা কথা বলতেন, সরাসরি তাঁর মতামত ব্যক্ত করতেন। সভা-সমিতি কিংবা লেখা-বলায় আমরা এমনটাই দেখেছি কাছে। অসম্ভব যুক্তিবাদী বলে মনে হতো তাঁকে। জানতাম যে, বয়স নির্বিশেষে সবাইকে তিনি ‘আপনি’ বলে সম্বোধন করতেন। 

প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামালের একটি স্মৃতি আমার মনে এখনও জ্বল জ্বল করে। মৃত্যুর কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশন অনুষ্ঠানে তিনি আলাপচারিতায় মগ্ন ছিলেন বিশিষ্ট সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। আমার মনে আছে, তিনি অনুষ্ঠানটি শেষ করেছিলেন এই রকম বলে, ‘সম্ভবত: এটাই আমার শেষ অনুষ্ঠান’। ক’দিন পরেই অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল আমাদের ছেড়ে চলে যান। তাঁর চলে যাওয়ার ৩ দিন পরেই ২৬ সেপ্টেম্বর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রয়াণ ঘটে। আমার সব সময়েই মনে হয়, অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল কি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা ছিলেন? 

তেইশে সেপ্টেম্বর মিশুক মুনীরের জন্মদিন। বেঁচে থাকলে আজ ওর বয়স হত ৬১ বছর। মিশুর সঙ্গে পারিবারিক একটি সম্পর্ক ছিল- কিন্তু সেটা আসল কথা নয়। ওর বহুমুখী প্রতিভা আমাকে প্রচন্ডভাবে আকর্ষণ করতো। সেটাও বড় কথা নয়। মিশুকে আমার ভালো লাগতো সে ‘মিশু’ বলেই। 

মিশুর সঙ্গে আমার স্মৃতির শেষ নেই। দেখতে পাই, ২০ বছরের মিশু মন্ট্রিয়ালে স্নান শেষে টপ টপ জল-ঝরা চুল নিয়ে আমাদের খাবার টেবিলে খেতে বসেছে। দেখতে পাই, বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ প্রভাষক আশফাক মুনীর শ্রেণিকক্ষে দন্ডায়মান, কখন আমার পড়ানো শেষ হবে আর কখন সে তার ক্লাশ শুরু শুরু করবে। দেখতে পাই, পারিবারিক পুনর্মিলনীতে মিশুর সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছি জমিয়ে। 

কত কি করার পরিকল্পনা ছিল মিশুর! গণমাধ্যমের খোল নলচে বদলে দিতে চেয়েছিলো সে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের শেখানোর কাজে মেতেছিলো মিশু। নিউ ইয়র্কে শেষবার যখন রুজভেল্ট দ্বীপে দেখা হয়েছিল, তখন বলেছিলো মিশু, ‘ঢাকায় আসুন, সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো আপনাকে। সময় রাখবেন আমার জন্যে’। আমি সময় রেখেছিলাম, কিন্তু সে কথা রাখতে পারে নি।

আমার বড় প্রিয় মানুষ ছিল মিশু। বড় অকালে চলে গেলো ও। সাম্প্রতিক সময়ে মিশুর কথা আরো বেশী করে মনে হলো- যখন ক’দিন আগে মঞ্জুলী আর মিশুর একমাত্র সন্তান সুহৃদের বিয়ে হলো। আহা, মিশু যদি আজ আমাদের মাঝে থাকতো।

প্রয়াত অধ্যাপক আবু হেনা মোস্তফা কামাল আর মিশুক মুনীরের কথা যখন ভাবি, তখন রবীন্দ্রনাথের ‘পলাতকা’ কবিতার কথা মনে পড়ে যায়।

‘এই কথা সদা শুনি 
‘গেছে চলে’ ‘গেছে চলে’।
তবু রাখি বলে
বোলো না ‘সে নাই’।
সে কথাটা মিথ্যা, তাই
কিছুতেই সহে না যে,
মর্মে গিয়ে বাজে।
মানুষের কাছে
যাওয়া-আসা ভাগ হয়ে আছে।
তাই তার ভাষা
বহে শুধু আধখানা আশা।
আমি চাই সেইখানে মিলাইতে প্রাণ
যে সমুদ্রে ‘আছে’ ‘নাই’ পূর্ণ হয়ে রয়েছে সমান।’

এনএস/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি