ব্যাংকার থেকে গ্রুপ অব কোম্পানির মালিক
প্রকাশিত : ২০:৪৪, ১৭ মে ২০১৯ | আপডেট: ২০:৫৩, ১৭ মে ২০১৯
পিএইচপি গ্রুপের স্বপ্নপুরুষ সুফী মিজানুর রহমান
উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করার পর বি.কম পড়া অবস্থায় ১০০ টাকা মাইনে চাকুরী নেন জুট ভ্যালি কোম্পানিতে। এর পর পড়াশুনা শেষ করে জুনিয়র ক্লার্ক পদে চাকুরী নেন বর্তমান সোনালী ব্যাংকে। কিন্তু বেশিদিন চাকুরীতে মন বসেনি তার। ৩ বছর চাকুরী করে যোগ দেন ব্যবসায়। বাবুই পাখির মতো নিজের স্বপ্ন বুননেই মন পড়ে থাকতো মিজানুর রহমানের।
তাই নিজস্ব ব্যবসায় না জড়ালে স্বস্তি পাচ্ছিলেন না তিনি। কিন্তু ব্যবসার মূলধন যোগানোটাই ছিল বড়ো চ্যালেঞ্জ। তাও তিনি অনেক কষ্টে সংগ্রহ করেন। এর পর থেকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে। আর সেই ১০০ টাকার মাইনে বেতনের চাকুরীজীবি বর্তমানে পিএইচপি কোম্পানির মালিক। বলছিলাম সুফী মিজানুর রহমানের কথা।
১৯৪৩ সালের ১২ মার্চ নারায়ণগঞ্জ জেলায় রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পিতা মরহুম সুফি মুহাম্মদ দায়েম উদ্দিন। মাতা রাহেতুন্নেছা। অতি সাধারণ পরিবারের সন্তান সুফি মিজানুর রহমান ছোটবেলায় মাকে হারান। বেড়ে উঠেন বাবার কঠিন অনুশাসনের মধ্যে। গ্রামের পাঠশালায় তার প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয়। গ্রামেরই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ভারত চন্দ্র স্কুল থেকে ১৯৬১ সালে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৬৩ সালে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণিতে ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জের তোলারাম কলেজে। পরবর্তী সময়ে ওই কলেজে বি.কম ক্লাসে ভর্তি হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে স্নাতক পাশ করেন।
মিজানুর রহমানের নিজস্ব প্রথম আমদানি পণ্য ছিল ‘ব্রিজস্টোন টায়ার’। সদ্য স্বাধীন দেশ, সময়কাল ১৯৭২। ব্রিজস্টোন টায়ার আমদানিতে বিনিয়োগ করেন তৎকালীন ৪ হাজার ডলার (প্রতি ডলারের বিনিময় হার ১১ টাকা)। আমদানিকৃত ব্রিজস্টোন টায়ারে প্রথম চালানে তার মুনাফা হয়েছিল ১ লাখ টাকা; যা তার ব্যবসায়ের ভিত গড়ে দেয়। এরপর শুরু হলো প্রতিযোগিতার বাজারে নাম লেখানো। এবার পুরোদমে ব্যবসায়ী হিসেবে কার্যক্রম চালাতে লাগলেন মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।
পিএইচপি গ্রুপের স্বপ্নপুরুষ সুফী মিজানুর রহমান ও তার ৭ পুত্র
কয়েক বছরের ব্যবসায় মিজানুর রহমানের হাতে জমে বেশ কয়েক লাখ টাকা। যা বড় বিনিয়োগের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য ছিল যথেষ্ট। এবার তিনি বঙ্গোপসাগর উপকূলে সীতাকুন্ডে প্রতিষ্ঠা করলেন শিপইয়ার্ড। পুরনো জাহাজ কেটে আসবাবপত্র বিক্রি করা হতো সেই শিপইয়ার্ড থেকে। এখান থেকে অর্জিত আয় দিয়ে ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠা করলেন রি-রোলিং মিল। তারপর ১৯৮৪ সালে, মংলা ইঞ্জিনিয়ার্স ওয়ার্কস নামে বিলেট তৈরির কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন, ওটাই ছিল দেশের প্রথম বিলেট কারখানা। এভাবেই পুরোদস্তুর বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠেন সুফি মিজান।
সুফি মিজানকে নিয়ে ব্যবসায়ীমহলে প্রচলিত একটি প্রবাদ আছে। তিনি যেখানে হাত দেন তা সোনা হয়ে যায়। যে কাজে হাত দিয়েছেন, সফল হয়েছেন। ১৯৮৬ সালে ঢাকায় ঢেউটিনের কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন এবং তার কারখানায় উৎপাদিত ‘পিএইচপি রানী মার্কা ঢেউটিন’ ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। এরপর সীতাকুন্ডের কুমিরায় দেন ‘সিআর কয়েল কারখানা’। এভাবে একের পর এক বিভিন্ন ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন এবং প্রভূত সাফল্য লাভ করেন সুফি মিজানুর রহমান।
এর পর প্রতিষ্ঠা করেন পিএইচপি গ্রুপ। তার গড়া পিএইচপি দেশে ২৩টির বেশি খাতে বিনিয়োগ করছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে- কোল্ড, স্টিল, ফিশারিজ, স্টকস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ, পাওয়ার জেনারেশন প্লান্ট, কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস, শিপিং অ্যাজেন্সি, ফোট গ্লাস, লেটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্টশন, টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন, প্রপার্টিজ, রোটারি ক্লাব, পেট্রো রিফাইনারি, এগ্রো প্রোডাক্ট, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্স, কোল্ড স্টোরেজ, শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রিসাইকিং, ওভারসিজ, হাসপাতাল, এয়ারলাইন্স ও ইলেকট্রিক খাত।
বর্তমানে পিএইচপি ফ্যামিলি’র অঙ্গ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৯টি। এগুলো হলো: পিএইচপি কোল্ড রোলিং মিলস লিমিটেড, পিএইচপি স্টিলস লিমিটেড, পিএইচপি ইস্পাত লিমিটেড, পিএইচপি কন্টিনিউয়াস গ্যালাভাইজিং মিলস লিমিটেড, পিএইচপি এনওএফ কন্টিনিউয়াস গ্যালভানাইজিং মিলস লিমিটেড, পিএইচপি শিপ ব্রেকিং অ্যান্ড রি-সাইকিং ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পিএইচপি পাওয়ার জেনারেশন প্লান্ট লিমিটেড, পিএইচপি পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড, পিএইচপি ফোট গ্লাস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, পিএইচপি এগ্রো প্রোডাক্টস লিমিটেড, পিএইচপি কর্পোরেশন লিমিটেড, পিএইচপি ওভারসিজ লিমিটেড, বে টার্মিনাল অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড, পিএইচপি পেট্রো রিফাইনারি লিমিটেড, পিএইচপি স্টকস অ্যান্ড সিকিউরিটিজ লিমিটেড, পিএইচপি কটন মিলস লিমিটেড, পিএইচপি স্পিনিং মিলস লিমিটেড, পিএইচপি রোটর স্পিনিং মিলস লিমিটেড, প্যালিকেন প্রোপার্টিজ লিমিটেড, ডিনা কোল্ড স্টোরেজ লিমিটেড, পিএইচপি ল্যাটেক্স অ্যান্ড রাবার প্রোডাক্টস লিমিটেড, পিএইচপি ফিসারিজ লিমিটেড, ইউনিভার্সিটি অব ইনফরমেশন টেকনোলজি অ্যান্ড সায়েন্সেস (ইউআইটিএস) এবং আলহাজ সুফি মোহাম্মদ দায়েম উদ্দিন হসপিটাল। এছাড়া পিএইচপি ফ্যামিলি যৌথ বিনিয়োগে গড়ে তুলেছে আরও বেশ ক’টি প্রতিষ্ঠান। এগুলো হলো : এটিএন বাংলা, আমাদের সময় ও দৈনিক সুপ্রভাত, বাংলা ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্স লিমিটেড, পিপলস ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড এবং পপুলার লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড।
এ প্রসঙ্গে সুফি মিজানুর রহমান বলেন, মানুষের কাছে পিএইচপি এখন একটি আস্থার নাম। তবে একদিনে হয়নি এই গ্রুপ। ২২ বছরে এই গ্রুপ ডালপালা বিস্তার করে পরিণত হয়েছে এক মহীরুহে। অনেক প্রতিষ্ঠান হয়েছে এখান থেকে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন অনেক মানুষ।
ভবিষ্যৎ স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে গ্রুপের এই কর্ণধার বলেন, ‘যতদিন বেঁচে থাকব, মানুষের জন্য, দেশের জন্য সেবা করে যেতে চাই। যদি কখনো শুনি সুফি মিজানের জন্য আমার ভাগ্য বদল হয়েছে সেদিন আমার অনেক আনন্দ হবে। বিশ্বাসটাকে পুঁজি করে সামনে এগিয়ে যাওয়াই আমার কাজ।
ব্যক্তিজীবনে সাত ছেলে এক মেয়ের গর্বিত পিতা সুফি মিজানুর রহমান। বড় সন্তান মো. মোহসিন পিতার মতোই দেশসেরা একজন শিল্পোদ্যোক্তা। তার অন্য ভাইবোনেরা হলেন ইকবাল হোসেন, আনোয়ারুল হক, আলী হোসেন, আমির হোসেন, জহিরুল ইসলাম ও আক্তার পারভেজ হিরু ও ফাতেমা তুজ-জোহরা। তাদের মা তাহমিনা রহমান।
বাবার প্রসঙ্গে জ্যেষ্ঠ সন্তান মো. মোহসিন বলেন, জানি না তার মতো হতে পারবো কি না। তবে বাবা সবসময় একটি কথা বলেন, যখন যে কাজই করি না কেন তা যেন সম্মানের সঙ্গে করি। কোনো কাজকে অবহেলা বা খাটো করে দেখতে চাই না। বাবার স্বপ্ন আছে অনেক। তিনি মুখে না বললেও আমরা অনেক কিছু বুঝতে পারি।
আরকে//
আরও পড়ুন