ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

ব্রিটিশ সম্রাজ্যের উত্থান ও পতনের সাক্ষী কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল

তানভীর সুমন

প্রকাশিত : ২১:০৭, ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪

ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়ার স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য।  তাঁর মৃত্যুর পর ভারতীয় উপনিবেশে তাঁর স্মৃতি সৌধ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন ব্রিটিশ শাসকরা। সিদ্ধান্ত হয় যে সেই স্মৃতি সৌধ হবে তাজমহলের আদলে এবং রানির নামে এই সৌধের  নামকরণ করা হবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল। যদিও তাতে থাকবে ইউরোপীয় সংস্কৃতির স্পর্শ। শ্বেত পাথরের তৈরি এই স্মৃতিসৌধটি বর্তমানে  জাতীয় সংগ্রহশালা এবং কলকাতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন আকর্ষণ।
    ব্রিটিশ শাসন চলাকালীন কলকাতা ছিল ভারতের রাজধানী। ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া তখন আবার ভারতেরও সম্রাজ্ঞী। তাঁর রাজত্বকাল ১৮৫৭ থেকে ১৯০১-এর ২২ জানুয়ারি। কলকাতা শহরের ঐতিহ্যবাহী এই ভবনকে ঘিরে রয়েছে নানা মজাদার ঘটনা।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হয় ১৯০১ সালে এবং  ১৯০১ সালের ২২ জানুয়ারি প্রয়াত হন রানি।  মৃত্যুর সঙ্গে  তাঁর রাজত্বকালও শেষ হয়। রানির প্রয়াণের পর কলকাতায় তড়িঘড়ি এক বৈঠক ডাকেন  লর্ড কার্জন। প্রয়াত রানিকে বিশেষভাবে সম্মান জানানোর প্রস্তাব রাখেন তিনি। প্রস্তাব ওঠে তাক লাগানো এক স্মৃতি সৌধ তৈরির। যেখানে থাকবে প্রচুর গাছ এবং ফুলের বাগান। লর্ড  কার্জনের ইচ্ছে ছিল তাক লাগানো এক স্মৃতি সৌধ নির্মাণের। যা দেখতে লাখো লাখো পর্যটক ভিড় জমাবে কলকাতায়। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল তাজমহলকে টেক্কা দেওয়ার। তবে তাজমহলকে টেক্কা দিতে না পারলেও লাখো পর্যটকের আনাগোনায় মুখর থাকে কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল।

মেমোরিয়ালটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন রাজা পঞ্চম জর্জ। রানির স্মৃতি সৌধ বা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির প্রস্তাব করা হয় ১৯০১ সালে। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তার নকশা তৈরি সহ অন্যান্য কাজ এগোতে থাকে। ১৯০৬ সালে শুরু হয় সৌধ নির্মাণের কাজ। সৌধটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন রাজা পঞ্চম জর্জ। বোন ভিক্টোরিয়ার মৃত্যুর পর তাঁরই রাজা হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাবা সপ্তম এডওয়ার্ড বেঁচে থাকা পর্যন্ত তিনি রাজা হতে পারেননি। তিনি ভারতীয় রাজনীতি এবং প্রশাসনিক কাজে ভারতীয়দের অংশগ্রহণকে উৎসাহ দেন। তাঁর রাজত্বকালেই ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হয়।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরি হতে সময় লাগে প্রায় ২০ বছর। রানি ভিক্টোরিয়া প্রয়াত হন ১৯০১ সালে। তাঁর স্মৃতি সৌধের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপিত হয় ১৯০৬ সালে। অফিশিয়ালি নির্মাণ কাজ শুরু হয় তার প্রায় চার বছর পর অর্থাৎ ১৯১০ সালে। নির্মাণ কাজ শেষ হতে সময় লাগে ১১ বছর। সব মিলিয়ে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল নির্মাণ শেষ হয় ১৯২১ সালে। এর নকশা করেছিলেন স্যার উইলিয়ম এমার্সন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ ইনস্টিটিউট অফ আর্কিটেক্ট-এর প্রেসিডেন্ট। সৌধ-সংলগ্ন বাগানটির নকশা প্রস্তুত করেছিলেন লর্ড রেডেসডেল ও স্যার জন প্রেইন। সৌধ নির্মাণের বরাত দেওয়া হযেছিল কলকাতার মার্টিন অ্যান্ড কোং-কে। এই সংস্থার যুগ্ম মালিক ছিলেন স্যার থমাস অ্যাকুইনাস এবং স্যার রাজেন মুখার্জি। সৌধ নির্মাণের পর রাজেন মুখার্জিকে নাইট উপাধি দিয়েছিল ব্রিটিশ সরকার।

যে জমিতে আজ ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল অবস্থান করছে অতিতে সেটি ছিল প্রেসিডেন্সি জেলের জমি। প্রধানত রাজনৈতিক বন্দিদেরই এই জেলে রাখা হত। তবে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল তৈরির প্রস্তাবের পর প্রেসিডেন্সি জেল সেই জমি থেকে আলিপুরে স্থানান্তরিত করা হয়। এখনও জেলটি সেই স্থানেই রয়েছে।
তাজমহল অনুসরণ করে এই স্মৃতি সৌধটি তৈরি করা হলেও। বেলফাস্ট সিটি হলের স্থাপত্যশৈলীর আদলে ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করেন স্যার উইলিয়াম এমারসন। তাঁকে ইতালীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যশৈলীতে স্মৃতিসৌধের নকশা প্রস্তুত করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শুধুমাত্র ইউরোপীয় স্থাপত্যশৈলীর প্রয়োগ তাঁর পছন্দ ছিল না।

তাই ইন্দো-সারাসেনিক শৈলীর সঙ্গে মুঘল শিল্পকলা যুক্ত করে মূল সৌধের নকশা প্রস্তুত করেন এমারসন। এছাড়াও ভিক্টোরিয়াতে মিশরীয়, ইসলামিক, ভেনেটিয়ান এবং ডেকানি সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্ট। তাজমহলের অনুসরণে মাকরানা শ্বেতপাথরের ভিক্টোরিয়া স্মৃতি সৌধ তৈরি হয়। পাথর আনা হয়েছিল রাজস্থান থেকে। বিশালাকার স্মৃতি সৌধটির উচ্চতা প্রায় ৫৬ মিটার। এর মধ্যভাগে রয়েছে একটি বিশালাকার গম্বুজ এবং চার ধারে রয়েছে চারটি ছোটো গম্বুজ।

দু’পাশে ফুলের বাগান রেখে প্রধান সড়ক ধরে কয়েক শ’ গজ সামনে এগোতে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মূল ভবন। উঁচু লম্বা সিঁড়ি।সিঁড়ি ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকতে মনে হলো এক অজানা জগতে এসে পড়েছি। বিশাল হলঘরের মাঝখানে রানী ভিক্টোরিয়ার আবক্ষ মূর্তি।  মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। মূল হলঘরটি ‘কুইন্স হল’ নামে নামকরণ করা হয়েছে।মেমোরিয়ালটির ভিতরে  বিভিন্ন সময়ে বিদেশ থেকে ভারতবর্ষে আসা বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি রয়েছে। দেশীয় বিখ্যাতদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, তার পিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুর, কেশবচন্দ্র সেন এবং মাইকেল মধুসূদন দত্তসহ আরও কয়েকজন বরেণ্য ব্যক্তির প্রতিকৃতি। আছে নন্দকুমারের কথিত জালিয়াতি সম্পর্কিত দলিল। যাকে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়েছিল। পলাশীর যুদ্ধে ব্যবহৃত কামানটিও এখনে সযত্নে রক্ষিত রয়েছে। কুইন্স হলসহ গ্যালারিগুলোর দেয়ালে দেয়ালে মহারানী ভিক্টোরিয়ার বিভিন্ন ধরনের ঘোষণাসহ তার জীবন ও কর্ম লিপিবদ্ধ করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। আছে তার স্মৃতিবিজড়িত বিভিন্ন ঘটনার চিত্রাবলী। যেমন তার সিংহাসনারোহণ, তার বিয়ে, তার পুত্র ও উত্তরাধিকারীর ব্যাপটিস্টকরণ, রাজপুত্রের বিয়ে প্রভৃতি। আছে রানীর ব্যবহৃত সামগ্রী। যেমন- শৈশবে ব্যবহৃত পিয়ানো, দৈনন্দিন চিঠিপত্র লেখার টেবিল-চেয়ার, ভারতীয় প্রজাদের উদ্দেশ্যে লেখা তার শেষ চিঠি। জাদুঘর বা গ্যালারিগুলোতে ব্রিটিশ আমলে ব্যবহৃত অস্ত্র, নৌজাহাজসহ বিভিন্ন ধরনের এমন আকর্ষণীয় সাড়ে তিন হাজার নিদর্শন রাখা আছে। যেগুলো দেখে অনায়াসে বেশ কয়েকদিন কাটিয়ে দেয়া যেতে পারে। বাইরের ফুল বাগানগুলোতেও অনিন্দসৌন্দর্যের প্রচুর ভাস্কর্য রয়েছে। যার বেশির ভাগ ব্রিটেন থেকে তৈরি করে আনা হয়েছে। যার অন্যতম একটি হচ্ছে- মেমোরিয়ালের উত্তর পাশে সিংহ মস্তক মূর্তি। এ মূর্তি থেকে জলের চারদিকে চারটি ধারা বইছে। যা ভারতের প্রধান চারটি নদী সিন্ধু, গঙ্গা, যমুনা ও কৃষ্ণার প্রতীক। মেমোরিয়ালের পথে পথে এমন নানান নান্দনিকতা যে কাউকে মুগ্ধ করবে, নিয়ে যাবে ভিন্ন জগতে।

রানির স্মৃতি সৌধ তৈরির প্রস্তাব করেছিলেন ব্রিটিশ ভাইস চ্যান্সেলর। অথচ সেটি তৈরির খরচ প্রধানত বহন করতে হয়েছিল দেশের মানুষকে। তুলনায় ব্রিটিশদের খরচ ছিল অনেক কম। স্মৃতি সৌধ তৈরির জন্য লর্ড কার্জন ভারতীয় রাজা, জমিদার, ধনী-অভিজাত ব্যক্তি এবং ব্যবসায়ীদের কাছে অর্থ দানের আবেদন জানান। মূলত আদেশটি ছিল ভাইস চ্যান্সেলর আদেশ। তাই সেই আদেশ খণ্ডন করার সাহস কারও ছিল না। প্রায় ৬৪ একর জায়গার উপর। সেই সময় স্মৃতি সৌধ তৈরি করতে খরচ পড়েছিল প্রায় ১ কোটি ৫ লক্ষ টাকা।

সোমবার ও জাতীয় ছুটি ছাড়া প্রতিদিন  সকাল ১০ টা থেকে বিকেল ৬ টা ভিক্টোরিয়া মিউজিয়াম খোলা থাকে। ভারতীয় নাগরিকদের ৩০ রুপি করে , তবে বিদেশি নাগরিকদের জন্য ৫০০ রুপি করে থাকলেও  সার্কভুক্ত দেশের নাগরিকদের জন্য  কমিয়ে ১০০ রুপি করা হয়েছে।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল কলকাতা শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত অন্যতম পর্যটক স্থান। দেশ বিদেশের লাখো পর্যটক  প্রতিবছর এখানে ঘুরতে আসে । এছাড়াও বিশেষ দিনগুলোতে, দর্শনার্থীদের জন্য দেখানো হয় লেজার শো । যার মাধ্যমে উঠে আসে অতীতের কলকাতার জীবন্ত ছবি। শহর কলকাতার বিবর্তনের  এই ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা এক বিশেষ মাত্রা যোগ করেছে আগত দর্শনার্থীদের কাছে ।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি