ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

‘ভদ্র’ সমাজকে কটাক্ষ করে যৌনকর্মীর আত্মকথন!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:০৩, ৮ মার্চ ২০২২ | আপডেট: ১৯:৩৫, ৮ মার্চ ২০২২

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

আমার কথা কে বা কারা জানতে চাইছে! আমি তো সেই, যার জন্ম যৌনপল্লীর অন্ধকারে। আমি সেই, যে অবশেষে মায়ের পেশা বেছে নিয়েছিলাম মেয়ের দুধ জোগাড় করব বলে। আমি তো সেই, যে ঘর না পেয়ে রাতের পর রাত রাস্তায় রাস্তায় ঠোকর খেয়েছে। আমি সেই, যার ঘরে ভদ্র সমাজের বড় বড় লোকেরা হাজির হয়েছেন। অথচ সমাজ আমাকে মেনে নেয়নি!

আপনারা কি মেনেছেন আমায়? এত যে নারীদিবসের আলো চারদিকে ঠিকরে পড়ছে, আমাদের ঘরে কিন্তু আজও অন্ধকার ঘুঁচল না। অথচ আলোর দেশের মানুষেরা কিন্তু অন্ধকারে আমাদের ঘরেই আসেন। তবুও তারা সকলেই ‘সাধু’। 

আর আমরা! আমরা তো আলোর মতোই পরিষ্কার। আমাদের কাজে কোনও লুকোছাপা নেই। তাইতো যত ঘৃণা আর কালিমা আমাদের ঘিরেই।

তবে বদলের দিনও আসছে। এখন আর সেই ৮০-৯০ দশকের দিন নেই। মেয়েরা একজোট হয়ে নিজেদের চাওয়ার কথা বলতে পারে। সমাজের অনেক মানুষ আমাদের মতো মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান। তাও, আমি যখন লিখছি, সেই তো বলছি ‘আমাদের মতো মানুষ’। আমরাও কি নিজেদের স্বাভাবিক ভাবতে পেরেছি? পারিনি তো!

নারীদিবস উপলক্ষ্যে যখন আমি নিজের জীবন নিয়ে লেখাটা লিখলাম, তাও তো নিজের নামটা গোপন রেখেই লিখলাম। নিজের ছবি ব্যবহার করতে না করলাম। এত বছর পরেও নিজেকে নিয়ে এত সঙ্কোচ আমার। এই সঙ্কোচের কারণ পিছুটান। আমার ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ।

আমার মা একজন যৌনকর্মী ছিলেন। যৌনপল্লীর জীবন থেকে আমায় দূরে রাখতে মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। সব দায়িত্ব ছিল মায়ের। ফলে আমিও মায়ের রোজগারের টাকায় ‘ভদ্র’ সমাজে বড় হতে থাকি। 

মনে আছে, বার বার ছুটে ছুটে মায়ের কাছে গেলে, মা ভীষণ রাগ করত। আমার কষ্ট হত। মা কেন আমায় কাছে টেনে নিচ্ছে না! তখন বুঝিনি, বড় হয়ে বুঝেছি, মা ওই পরিবেশে আমায় রাখতে চাইত না। অথচ বিধাতার তৈরি করা নিয়মে আমিও যৌনপল্লীর সেই মরচে-ধরা ইটপাথরের পাঁজরেই নিজেকে সঁপে দিলাম।

মূলত সর্বনাশটা হয়েছিল প্রেমেই! ১৩ বছর বয়সে আমার প্রেম। তার পরেই বিয়ে। অতঃপর সন্তান। স্বামী প্রথমে ভালবাসলেও পরে মুখ ফিরিয়ে নিল। যৌনপল্লীতেই যাতায়াত শুরু করল। ছোট্ট মেয়ের মুখের খাবার যোগাড় করে দেয়ার দায়িত্ববোধও তৈরি হল না ওর। অগত্যা এক গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হলাম। কিছু কাজও করতে শুরু করলাম। নির্দিষ্ট অঞ্চলে আমাদের মতো মেয়েদের নানা বিষয় নিয়ে সচেতন করতাম। সেই আমার ঘর থেকে বেরোনো শুরু হল।

সংসারটা ভাঙলাম। মা শরীর বিক্রি করেই আমাদের টানতে শুরু করল। কত করবে মা? মায়ের ওখানকার মাসীরা সবাই আমায় বলল, চলে আসতে!

সত্যি কথাই লিখছি। আমার একটুও খারাপ লাগেনি। ছোটবেলা থেকেই এই এলাকার অন্ন খেয়ে বড় হয়েছি। শরীর বিক্রিও এক ধরনের পেশা। যেমনটা- শিক্ষকতা বা চিকিৎসা। আমি মায়ের ওখানেই ঘর নিলাম। কাজ শুরু করলাম। 

কিসের খারাপ? দেখলাম, এ তো সোজা পথেই টাকা রোজগার! এখন তো কলেজে পড়া মেয়ের দলও দেখি এই পেশায় আসছে। দেখেছি, যৌন খিদে মেটাতে বড় ঘরের মহিলারা স্বামীকে লুকিয়ে টাকা দিয়ে আমাদের পাড়ায় ঘরভাড়া করে অন্য পুরুষ নিয়ে রাত কাটায়। আবার রাতেই ফিরে যায়। 

ওরা তো ‘ভদ্র’ সমাজের। তাই লুকিয়ে কাজ করে। তবে আমাদের ‘ভদ্র’ হওয়ার দায় নেই। লজ্জাও নেই। আর তাই আমি কিন্তু আমার মায়ের মতো আমার মেয়েকে আমার থেকে আলাদা করে রাখিনি। ওখানেই বড় করেছি। স্কুলেও পড়িয়েছি।

তবে ঠকেছি। একবার নয়। অজস্র বার ঠকেছি। শরীর পুড়লেও তখনও মন পোড়েনি আমার। আবার এক পুরুষের প্রেমে পড়ি। আবার ঠকি। এই ঠকে যাওয়ার মাঝে জন্ম নেয় আমার ছেলে। জীবন চলতে থাকে।

২০২২-এ এসে মনে হচ্ছে, মেয়েরা কেন বিয়ে করে? ভালোবেসে একসঙ্গে থাকুক না! মা হতে চাইলে দত্তক নিয়ে নিক। বিয়ে কেন? ঘৃণা ধরে গেছে!

এভাবেই মেয়েকে মানুষ করেছি। সে এখন সরকারি চাকরি করে। ছেলে অ্যাপস বানায়। সে-ও চাকরি খুঁজছে। আমিও পেশা ছেড়েছি। বয়স তো অনেক হলো। মোটা হয়ে গেলাম। এখন আর কে এই শরীরের কদর করবে? মা সঙ্গে আছে। আমরা নুন-ভাত খেয়েও বাকি জীবন কাটিয়ে দিতে পারব। 

তবে, কিছু মানুষ আমার চলার পথকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তাদের প্রতি চির কৃতজ্ঞ। অনেক সাহায্য করেছেন, এখনও করে চলেছেন।

দিব্যি আছি এখন। আমাদের মতো স্বনির্ভর, স্বাধীন জীবন কাটানো কতজন নারী আছেন? আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি, সংখ্যাটা খুবই কম।

মেয়ে-জামাই-ছেলে, সবার সঙ্গেই খুব ভালো সম্পর্ক আমার। বন্ধুদের সঙ্গে হৈ-হুল্লোড় করি। যেমন ইচ্ছে তেমন। মাঝে মাঝে পুরনো কিছু চেনা মানুষ বা পুরুষ- যে নামেই ডাকুন না কেন, আমায় ভিডিও কল করেন। আমি মজা করে বলি, “আগে অনলাইনে টাকা পাঠাও, তার পরে গল্প হবে।” মজাই লাগে। হাওয়া খেলে যায়। আনন্দ পাই। মনের আনন্দই সব।

তবে মৃত্যুর ভয় নেই আমার। জানেন তো, মৃত্যুর পরেও যৌনকর্মীরা একা হয় না! তাদের দেহ গলে-পচে পড়ে থাকে না। আমি জানি, আমার ছেলেমেয়ে না দেখলেও আমার মেয়েরা আমার মুখে আগুন দিয়ে দেহটা পুড়িয়ে দেবে।

‘ভদ্র’ সমাজ, শুনছেন তো? ‘বেশ্যা’, ‘পতিতা’, ‘যৌনকর্মী’- যে নামেই ডাকুন আমাদের, লড়াইয়ে আমরা প্রথম থেকেই জিতে আছি। আমরা একা নই। (নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক এক যৌনকর্মী)। সূত্র- আনন্দবাজার।

এনএস//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি