ঢাকা, সোমবার   ০২ ডিসেম্বর ২০২৪

ভস্ম থেকে যেভাবে গড়ে ওঠলো নান্দনিক হিরোশিমা নগরী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৭:১৮, ১৪ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:১৯, ১৪ নভেম্বর ২০১৭

চারদিকে কৃষ্ণচূড়া পেকম মেলে পুরো এলাকা রঞ্জিত করে রেখেছে। সবুজে সবুজে মাঠ ছেঁয়ে গেছে। রাস্তার দু-ধারে ম্যাপল ট্রি শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। পুকুরে-পুকুরে পদ্মফুল ফুটেছে । এ যেন এক নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি।

বলছিলাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ক্ষত-বিক্ষত জাপানের হিরোশিমা শহরের কথা। বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানীরা বলেছিলেন, পরবর্তী ৭০ বছরেও হিরোশিমা শহরে কোনো ব্যক্তি বসবাস করতে পারবে না। এমনকি সেখানে কোনো বীজও অঙ্কুরিত হবে না। বিজ্ঞানীদের ভবিষ্যদ্বাণীকে চ্যালেঞ্জ করে, কিভাবে গড়ে উঠেছে আজকের নান্দনিক হিরোশিমা? আর সেখানকার বর্তমান অবস্থা-ই বা কেমন? এসব নিয়ে এই ফিচার। বিবিসি অবলম্বনে লিখেছেন মোহাম্মদ জুয়েল।

ছেলেমেয়েরা আনন্দে হৈ-হুল্লোর করছে। মন্দিরে পূজো দিচ্ছে একদল পুরোহিত, একটু পর পর ঢঙ্কা বাজছে। একদল আসছে তো আরেকদল মন্দির ত্যাগ করছে। এ যেন এক আনন্দের শহর।এমনই চিত্র সেই বিধ্বস্ত হিরোশিমার। শহরের পুণর্জাগরণ কিভাবে সম্ভব হলো-

১৯৪৫-এর ৬ আগস্টের পর হিরোশিমা শহরের কোথাও কোনো স্থাপনা অবশিষ্ট ছিল না। কোন পার্ক, গাছপালা, উদ্ভিদের লেশমাত্রও পাওয়া যেত না । তখন গবেষকরা বলেন, আমেরিকার ফেলা পারমাণবিক বোমা ‘লিটল বয়’ এর আঘাতে সব ধ্বংস হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, আর কখনো এখানে নগরী গড়ে উঠবে না।

তবে এক বছর না পেরোতেই হিরোশিমার নাগরিকরা দেখতে পান, হিরোশিমার মৃত্তিকা ভেদ করে ছোট ছোট উদ্ভিদ জন্ম নিচ্ছে। গ্রীষ্মকালে দেখা যায়, ধ্বংস হয়ে যাওয়া শত বছরের পুরানো গাছগুলো নতুন কুঁড়ি দিচ্ছে।আর এই চিত্র স্থানীয়দের হৃদয়ে উচ্ছ্বাসের ঢেউ তোলে। মূলত এ দুটি দৃশ্যই জাপানিদের জাতীয় গাছপালা রোপণে উৎসাহিত করে।

এর পর থেকেই তারা সিদ্ধান্ত নেন, গবেষকদের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে হিরোশিমাকে নবজাগরণ দিতে হবে। এদিকে, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সহায়তাও হিরোশিমা পুনর্গঠনে ব্যপক ভূমিকা রাখে। হারিয়ে যাওয়া সবুজ ফিরিয়ে আনতে এরপর রাস্তার ধারে-ধারে গাছ লাগানো শুরু করেন স্থানীয়রা।

ষোড়শ শতাব্দীতে ওয়াইকামাতে নির্মিত মিথাকাই মন্দিরকে এখন পর্য্টন কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। মন্দিরটি গড়ে উঠেছে ম্যাপল গাছের সঙ্গে । মনে হবে যেন, ম্যাপল গাছের উপর বেড়ে উঠছে মন্দিরটি। আবার কোথাও কোথাও ম্যাপল গাছ যেন মন্দিরটিকে লাল শাড়িতে সাজিয়েছে।

এগুলো একদিনে হয়নি । ১৯৪৯ সালের ৬ আগস্ট সরকারিভাবে শহরটিকে সাজানোর জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ঐ দিন ‘হিরোশিমা পিস মেমোরিয়্যাল সিটি কন্সট্রাকশন ল’ নামের একটি আইন কার্য্করের মধ্য দিয়ে শুরু হয় হিরোশিমার নবযাত্রা। এই আইনটি ছিল মেয়র শিনজো হামাই ও স্থানীয়দের স্বপ্নের একটি প্রতিফলন।

১৯৪৭ সালে যখন হিরোশিমা প্রথম শান্তি মেলা (পিস ফেস্টিভাল)অনুষ্ঠিত হয়, তখন শিনজো হামাই বলেন, ‘যুদ্ধের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে চলো আমরা একসঙ্গে হয়, এবং শান্তি প্রতিষ্ঠিত করি’ । কেবল এই আইন-ই হিরোশিমা পুণর্গঠনে একমাত্র ভূমিকা রাখেনি। এত সহজেই হিরাশিমার পুণর্জাগরণ হয়নি।শান্তি স্থাপনে প্রথমবারের মতো বিশ্বের কোন এক শহরের সব নাগরিক একত্রে কাজ শুরু করার নজির এটাই প্রথম।এটাও সত্য যে, তারা এখনো একত্রে কাজ করে যাচ্ছে। এবং তারা এটাই করে যেতে চায়।

তাদের চেষ্টার অন্যতম ফসল পিস মেমোরিয়্যাল পার্ক । জাপানের মটইসাও নদীর তীরে গড়ে উঠেছে পার্কটি । এর আয়তন ১ লাখ ২০ হাজার বর্গ মিটার।৪৫’ এর পূর্বে এলাকাটি ব্যবসা বাণিজ্য ও আবাসিক এলাকা হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে।

নদীর অপর তীরে ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল এলাকায় নির্মিত স্কেলিটাল ফর্ম অস্ত্র ও মরণবিধ্বংসী প্রচারণার অংশ হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। এটি ৪৫’র পূর্বে স্থাপন করা হলেও এর ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করা হয়েছে।এটা হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল নামে পরিচিত। তবে স্থানীয়রা এটাকে জানে গেনবাকু ডমু।বছরে ১০ লাখেরও বেশি ট্যুরিস্ট এখানে আসে বলে বিবিসিকে জানায় এক কর্মকর্তা।

জাপানে বর্তমানে পিস শব্দটি সবচে’ বেশি ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিভিন্ন রাস্তা, মোড়, পার্কের নামের সাথে পিস শব্দটি জুড়ে দিতে পছন্দ করছে জাপানিরা। জাপানের স্থানীয় ৪৯টি ভাষায় পিস শব্দটি লেখা হয়েছে।

স্থানীয় মোটরচালিত বাইসাইকেলকে পিস বলে ডাকে। হিরোশিমার গভর্নর এবং পিস আর্ক চেয়ারম্যান হিদেহিকো উজাকি বলেন, আমরা শান্তির বাণী পুরো বিশ্বে পৌছে দিতে চাই, যাতে পুরো বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে এগিয়ে আসে।

শান্তি স্থাপন সংক্রান্ত বিষয়টি শুধু নামকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা হিরোশিমার প্রশাসকগণ। ১৯৮০ সালে তারা প্রতিষ্ঠা করে ‘মেয়রস ফর পিস প্রজেক্ট’ (শান্তি প্রকল্পের জন্য নগরপিতা) নামের একটি সংগঠন।তৎকালীন হিরোশিমার মেয়র তাকেশি আরাকি এ উদ্যোগ গ্রহণ করেন।বর্তমানে সংগঠনটিতে ১৬২টি দেশের ৭ হাজার ৪৬৯টি শহর সংযুক্ত রয়েছে। ২০১৭ সালে ১৬টি শহর এই উদ্যোগের সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছে।

শুরু থেকেই শান্তি স্থাপন বিষয়টি প্রাথমিকে পৌছে দেন নগরীর কর্তাব্যক্তিরা। সেখানে হিরোশিমার অতীত ও বর্তমান এবং শান্তি স্থাপনের গুরুত্ব নিয়ে পড়ানো হয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে সেখানকার শিক্ষার্থীরা পিস মেমোরিয়ার পার্কে ট্যুরিস্ট গাইড হিসেবে কাজ করে থাকেন। হিরোশিমা শুধু নিজেদের মধ্যেই শান্তি স্থাপন করতে চায় না, হিরোশিমা চায় বিশ্বের সবার মধ্যে শান্তি স্থাপন।

‘যেখানে দেখিবে ছাঁই, কুঁড়াইয়্যা দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পার, অমূল্য রতন” এই প্রবাদটির যথাযথ উদাহরণ আজকের হিরোশিমা। তাই আসুন শান্তি স্থাপনে, বিশ্বজনমত তৈরি করি, পরমাণু অস্ত্রসহ সব ধরণের সংঘাতকে না বলি।’     

 / এআর /

 

 

 


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি