ভালো নেই ব্যক্তিগত গাড়ি চালকরা
প্রকাশিত : ২২:১৪, ১২ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৭:১৬, ২১ নভেম্বর ২০১৭
দেশে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বর্তমানে ৫ লাখের বেশি। এর অধিকাংশই রয়েছে রাজধানী ঢাকায়। এসব গাড়ির মালিকানা প্রধানত দু’ধরণের। ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক। গাড়ি অনুযায়ী চালকের সংখ্যাও প্রায় সমান সংখ্যক। কেমন আছেন এসব গাড়ির চালকরা? যার হাতে গাড়ির স্টিয়ারিং তু্লে দিয়ে আমি- আমরা নিশ্চিন্তে ফেসবুকিং করতে করতে, কখনো বা লতা মুঙ্গেশকরের গান শুনতে শুনতে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নিরাপদে বাড়ি কিংবা কর্মক্ষেত্রে পৌঁছাই।
দামী গাড়ির কাচের মত তাদের জীবন ঝকঝকে নয়, গাড়ির সিটের মত নরম বা শীতল নয়। বরং রাস্তার উত্তপ্ত রোদ বা ইট কংক্রিটের রাস্তার মত খটখটে।
কথা বলছিলাম কাওরান বাজারে গাড়ি রেখে মালিকের অপেক্ষায় থাকা মো. রাসেলের সাথে। রাসেলের বয়স বাইশ। বাড়ি মাদারীপুর। বাবা ছিলেন রিক্সাচালক। সড়ক র্দূঘটনায় আহত হয়ে এখন বিছানায় পড়ে আছেন। ডাক্তাররা বলেছেন চিকিৎসা করলে সুস্থ হবেন। তবে সেই চিকিৎসা করানোর সামর্থ নেই। রাসেল ভাইদের মধ্যে বড়। রাসেলের বড় ভাই বিয়ে করে শ্বশুরের টাকা দিয়ে ও বেশ কিছু ধার দেনা করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছেন। যাওয়ার পরে প্রথম কয়েকমাস যোগাযোগ থাকলেও তারপর থেকে নিরুদ্দেশ। বেঁচে আছেন নাকি নেই, কোথায় আছেন কী সমস্যা খবর নেওয়ার কোনো উপায় নেই।
রাসেলকে তার মালিক বেতন দেন ১২,০০০ টাকা। অবশ্য দুপুরের খাওয়ার খরচটাও মালিক বহন করেন। রাসেল রাতে ফকিরাপু্লের একটি মেসে থাকেন। সব মিলিয়ে তার খরচ হয় আট হাজার টাকা। নিজের হাত খরচের জন্য এক হাজার টাকা রেখে বাকি টাকা বাড়িতে মায়ের কাছে পাঠান। তিন হাজার টাকায় মায়ের বাজার খরচই হয় না। সেখানে বাবার চিকিৎসা তো অনেক দূরের ব্যাপার।
রাসেলের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ভবিষ্যত নিয়ে তিনি কী ভাবছেন? রাসেল অনেকটা স্বাপ্নিক চোখেই জানালেন, তিনি গ্রামে তার স্বজনদের নিয়ে একটি স্বাভাবিক জীবন চান। যেখানে বাবার চিকিৎসা হবে। তার বাবা ও তিনি যে লড়াইটা করছেন, তাদের আগামী প্রজন্মকে যেন এমন কষ্ট না করতে হয়।
প্রাইভেট কার চালকদের কোনো ব্যক্তিগত জীবন নেই। নেই কোনো কাজের রুটিন। মালিকের হুকুমেই তার কাজ শুরু হয়। মালিকের কাজের উপর বা মালিকের নিজের সুবিধার উপর নির্ভর করে তাদের অবসর। এমনটাই জানালেন গাইবান্ধা থেকে আসা গাড়ি চালক রেজাউল।
কয়েকমাস আগে বিয়ে করেছেন। ঢাকায় এনে রাখার মত সামর্থ নেই। মাসে মাত্র দু’একবার গ্রামে যান তাও একরাতের জন্য। বাড়িতে মন টানে। বউটা মন খারাপ করে থাকে। কিন্তু রেজাউল নিরুপায়।
একই সমস্যা চট্টগ্রামের সুজনের। তিনি অবশ্য চট্টগ্রাম শহরে গাড়ি চালান। গ্রামের বাড়ি মিরসরাই। সুজন জানান, গত কয়েক বছর তিনি ঈদের ছুটি পান না। তিনি জানান, বেতন বোনাস পান মোটামুটি। কিন্তু ঈদে কোনো ছুটি পান না। সুজনের ছোট ভাই বোন আছে। তাদের মন খারাপ করে থাকে। ছুটি পান না কারণ, ঈদের দিন তাকে মালিকের ছেলে মেয়েদের নিয়ে ঘুরতে হয়। সুজন কষ্টের একটা সংক্ষিপ্ত হাসি দিয়ে বলেন, মানুষের আনন্দই বড় কথা! আমাদের আনন্দের মূল্য কী!
যদিও ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় কাজ করেন গাড়ি চালকরা তথাপি তাদের চিকিৎসা বা ঝুঁকির দায় বহন করে না কেউ। গাড়ি এক্সিডেন্ট করলে মালিক গাড়ির ক্ষতিপুরণ পান। আবার অনেক ক্ষেত্রে পান বীমার মোটা অংকের অর্থ। কিন্তু চালক হাত পা ভেঙ্গে পঙ্গু হলে সামান্য কিছু খরচ দিয়েই দায় সারেন মালিকেরা। এরকম ক্ষেত্রে জীবনহানির সংখ্যাও কম নয়। সেরকম ক্ষেত্রে গাড়ীচালকের পরিবার সামান্য কিছু এককালীন খরচ পান। যা দিয়ে এই কঠিন বাজারে কিছুই হয় না।
গত বছর চট্টগ্রামের অলংকারের মোড়ে দুটি গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষে প্রাণ দিয়েছিলেন মো. ইমরান। তার দুটি শিশু সন্তান নিয়ে তার স্ত্রী এখন অসহায় জীবন যাপন করছেন। আত্মীয় স্বজনের অনুগ্রহের মুখাপেক্ষী এখন তিনি। ইমরান মারা যাওয়ার পর গাড়ির মালিক তাকে দশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন। উল্টো যুক্তি দেখিয়েছিলেন যেহেতু ইমরানের অসতর্কতার জন্য গাড়ির ক্ষতি হয়েছে, তাই এক টাকাও দেওয়া উচিত নয়।
রাজধানীর মধ্য বাড্ডায় গাড়ি রেখে বিশ্রাম করছিলেন মো. শাহজাহান (৩৬)। বাড়ি ভোলা জেলায়। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে তার অবস্থান দ্বিতীয়। ঢাকায় স্ত্রী সন্তান নিয়েই থাকেন। তিনি জানালেন বেতন পান তের হাজার টাকা। দুপুরের খাবার বিল মালিক দেন। দুই সন্তানের বড়টির বয়স তের বছর। ছোটটি পাঁচ বছরে পড়ল মাত্র। দেশের বাড়িতে বাবা মা আছেন। কিন্তু এই তের হাজার টাকা থেকে ঢাকার কঠিন খরচ চালিয়ে গ্রামে টাকা পাঠানো হয়ে উঠে না। বাবা মা হয়তো মুখ ফুটে টাকা চান না। কিন্ত বাবা মায়ের কষ্ট প্রতিনিয়ত পীড়া দেয় শাহজাহানকে।
গাড়ি চালকদের নামে অনেক অভিযোগ পাওয়া যায়। গাড়ির তেল চুরি বা মালিককে ঠকানোর মত অপবাদও তাদের সইতে হয়।
এ প্রসঙ্গে মাদারীপুর থেকে আসা গাড়ি চালক মো. জহির জানালেন, সব গাড়ির চালক এক রকম নন। ভালো খারাপ নিয়েই মানুষ। আবার এটাও সত্য। অভাবে স্বভাব নষ্ট।
গাড়ি চালকদের একটা স্বাভাবিক জীবনের লক্ষ্যে তাদের বেতন ও ছুটিসহ অন্য সুযোগ বাড়ানো যায় কি না তা নিয়েই কথা বলছিলাম গাড়ি মালিকদের একজন ব্যবসায়ী অভিজিত দে-এর সাথে। তিনি বলেন, একজন মানুষ তার সামর্থ্যের যে পর্যায়ে গিয়ে গাড়ি কিনে, সে পর্যায়ে গিয়ে গাড়ি কেনার আগে তার একটা নির্দিষ্ট বাজেট থাকে। গাড়ি কেনার আগেই সে ঠিক করে কত টাকা বেতন দিয়ে সে পোষাবে। গাড়ি চালকদের বাজার দর অনুযায়ীই বেতন দেওয়া হয়।
অনেকটা তার সাথে সুর মিলালেন ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম। তিনি জানালেন, গাড়ি চালকদের ছুটি দেওয়া হয় না বা মালিকের ব্যবহার খারাপ এ অভিযোগ সব ক্ষেত্রেই সত্য নয়। বরং সব মানুষ যেমন সমান নয়, তেমনি সব মালিকের কাছে ভালো আচরণ বা ভালো সুযোগ সুবিধা আশা করা যায় না এটাই সত্যি।
রামপুরার গাড়ি চালক মো. বাবুল জানালেন, গাড়ি চালকের চাকরি চলে যেতে পারে যে কোনো মুহূর্তে। এক্ষেত্রে কোনো নিয়ম নেই। যে কোনো মুহূর্তে একজন গাড়ি চালক হয়ে যেতে পারেন বেকার। মালিক তার সুবিধা অনুযায়ী বা নিজের মর্জি মত যে কাউকে বাদ দিতে পারেন। এক্ষেত্রে একটি নিয়ম আসা দরকার বলে মনে করেন তিনি।
এদেশে অনেক প্রাইভেট কার চালক ড্রাইভিং শিখার সময় বা লাইসেন্স করার সময় স্বপ্ন দেখেন একদিন তিনি ড্রাইভং ভিসায় বিদেশ যাবেন। টাকা আয় করবেন, ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনা শেখাবেন। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই স্বপ্ন পূরণ হয় না।
এএ/ডব্লিউএন