ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪

ভাষা আন্দোলনের গোড়ার কথা (প্রথম পর্ব)

বিচারপতি মোঃ আবু জাফর সিদ্দিকী

প্রকাশিত : ১৯:২০, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২

১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলায় ভাষা আন্দোলন ছিল একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। মূলত: এ অঞ্চলে ভাষা নিয়ে বিরোধ শুরু হয় ১৯৩৭ সাল থেকে। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ সম্রাজ্যবাদের শাসন থেকে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (মায়ানমার), সিংহল (শ্রীলঙ্কা) এবং পাকিস্তান, যার মধ্যে পূর্ব বাংলা অন্তর্ভুক্ত ছিল। 

এ অঞ্চলের মানুষের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণের জন্য বাংলা ভাষাকে ঘিরে সৃষ্ট এ আন্দোলনের মাধ্যমে তদানীন্তন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠার জন্য পূর্ব বাংলার ছাত্র-জনতা দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সু-সংগঠিত হতে থাকে। ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান ও ভারত নামক দুটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়। ভারতের পূর্ব ও পশ্চিমে দুই প্রান্তে অবস্থিত পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে দুই হাজার কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ব্যবধানে অদ্ভুত ধরনের গঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানের দুটি অংশের সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক অবস্থান ও ভাষাগত মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও তৎকালীন নেতারা অজানা কারনে অসামঞ্জস্যপূর্ণ এই বিভাজন মেনে নেয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান কে তাদের কলোনী হিসাবে শোষণ ও শাসনের পথ সুগম করার লক্ষ্যে উভয় অংশেই উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠার একপেশে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলা ভাষাভাষীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার লাগাতার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। একইসাথে তারা আরবি হরফে বাংলা লেখা অথবা সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব করে। এ প্রেক্ষাপটে পূর্ব বাংলায় অবস্থানকারী বাংলা ভাষাভাষী সাধারণ জনগণের মধ্যে তীব্র ক্ষোভের জন্ম হয়। কার্যত: পূর্ব বাংলার মানুষ এ সিদ্ধান্তকে কোন অবস্থায় মেনে নিতে পারেনি, অনুরূপ অবস্থায় বাংলা ভাষাকে সম-মর্যাদায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে পূর্ব বাংলায় ছাত্র-জনতার আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে।

ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনার পূর্বে এ অঞ্চলের ভাষার ক্রমবিকাশ সংক্রান্ত ইতিহাস সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রাসঙ্গিক। ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষাবিদদের গবেষণা থেকে পাওয়া যায়, উর্দু ভাষা কিছু সংখ্যক মুসলিম রাজনৈতিক ব্যক্তি ও ধর্মীয় নেতা যেমন: স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান, মৌলভী নবাব ওয়াকার-উল-মুলক এবং মৌলভী আব্দুল হক প্রমুখদের প্রচেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কায় (ইতালীয় ভাষায়) উন্নীত হয়। মূলত: উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষা গোষ্ঠির সদস্য। একই সাথে উর্দু ভাষা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারেরও অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষার অশুদ্ধ রূপের উপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কি ভাষা প্রভাবিত হয়ে দিল্লির সুলতানাত ও মুঘল সম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় উহা বিকশিত হয়। উর্দু ভাষায় পারসিক আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানরা ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসাবে বিবেচনা করতো, অন্য দিকে হিন্দি ও দেব নাগরী লিপিকে হিন্দু ধর্মের উপাদান হিসাবে বিবেচনা করা হতো। উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু পূর্ব বাংলার মুসলমান ও হিন্দুরা বাংলা ভাষাকে প্রধান ভাষা হিসাবে ব্যবহারে অভ্যস্ত ছিল। বাংলা ভাষা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য-ইন্দো ভাষাসমূহ থেকে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা, যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল ভাবে বিকাশ লাভ করে। উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রগূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিস্তার তখন থেকেই বিকশিত হয়। 

বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে তৎকালীন মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের জন্যও লিঙ্গুয়া-ফ্রাঙ্কা (ইতালীয় ভাষা) মনোনয়নের প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখান করেন। মুসলিম লীগ ছিল তৎকালীন ব্রিটিশ-ভারতের একটি রাজনৈতিক দল, মুসলিম লীগের উপরের সারির নেতারা ভারত বিভাজনের সময় পাকিস্তানকে একটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯৩৭ সালে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে মুসলিম লীগের দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ব্যবহারের প্রস্তাব করলে এ অঞ্চলের নেতা শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক জিন্না সাহেবের উক্ত প্রস্তাবের সরাসরি বিরোধিতা করেন। পাকিস্তানীদের সাথে ভাষা নিয়ে বিরোধ চলছে সেই ১৯৩৭ সাল থেকেই। ১৯৪৭ সালে খলীকুজ্জমান ও আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ডক্টর জিয়াউদ্দিন আহমেদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হকসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা প্রবন্ধ লিখে ওই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে শক্তভাবে প্রতিবাদ শুরু করেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের বাংলা ভাষাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ পশ্চিম পাকিস্তানের ২ কোটি ৫০ লাখ মানুষের সাথে মিশে ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যা বিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তখন থেকেই এই অঞ্চলের মানুষকে শোষণ ও শাসনের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। তারা সরকারী চাকুরীতে দৃশ্যত বৈষম্যসহ সর্বক্ষেত্রে বাঙালীদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার অপতৎপরতা অব্যাহত রেখেছিল। 

১৯৪৭ সালে করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশসহ প্রচার মাধ্যম ও সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। বাংলার ছাত্র-জনতা তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করে প্রতিবাদ কর্মসূচী থেকে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবি উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার পাবলিক সার্ভিস কমিশন থেকে বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাদ দেয় এবং একই সাথে পাকিস্তানের প্রচলিত মুদ্রা এবং ডাকটিকেট থেকেও বাংলা অক্ষর বিলুপ্ত করে দেয়। পাশাপাশি পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান মালিক উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। অনুরূপ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালীদের ভিতরে দারুন ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে বাংলার ছাত্র-জনতা ওই সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবি উত্থাপন করে এবং দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্র জনতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ রাজপথে মিছিল নিয়ে নেমে পড়ে। পূর্ববাংলার নেতৃস্থানীয় বাঙালি পণ্ডিতগণ উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার বিপক্ষে মত দেন। উল্লেখ্য যে, ওই সময় পাকিস্তানের কোন অংশেই উর্দু স্থানীয় ভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল না বলে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ তাঁর বক্তব্যে উল্লেখ করেন। তিনি বলেন যে, “আমাদের যদি একটি দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা নির্ধারণ করার প্রয়োজন হয়, তবে আমরা উর্দুর কথা বিবেচনা করতে পারি।" সাহিত্যিক আবুল মনসুর আহমেদ বলেন, “উর্দুকে যদি রাষ্ট্রভাষা করা হয় তবে পূর্বপাকিস্তানের শিক্ষিত সমাজ নিরক্ষর হয়ে পড়বে এবং সকল সরকারি চাকুরীর ক্ষেত্রে অনুপযুক্ত হয়ে যাবে।” এ সকল দিক বিবেচনায় ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে পূর্ব বাংলায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।

১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে গণপরিষদ সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দু ভাষার পাশাপাশি গণপরিষদ সদস্যদের বাংলায় বক্তৃতা প্রদান এবং সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের জন্য একটি সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ইংরেজিতে প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতিগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার জোর দাবি তোলেন। এছাড়াও সরকারি কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তিনি বক্তব্য রাখেন, তার এ সকল দাবি গণপরিষদে কণ্ঠ ভোটে নাকোচ করা হয়। একই বছরে ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ" পুনর্গঠিত হয়। ১১ মার্চের কর্মসূচী নির্ধারণের জন্য ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ ভোরে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল থেকে ছাত্ররা বেরিয়ে আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণাঙ্গ ধর্মঘট পালিত হয়। এই কর্মসূচী সফল করার লক্ষ্যে ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত মুসলিম ছাত্রলীগ মূখ্য ভূমিকা পালন করে। সকালে ছাত্রদের একটি দল কর্মসূচী পালনের উদ্দেশ্যে রমনা ডাকঘরে উপস্থিত হলে পুলিশ তাদের গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। ছাত্রদের অন্য একটি দল রাজনৈতিক নেতাদের সাথে সচিবালয়ের সামনে নবাব আবদুল গণি রোডে পিকেটিংয়ে অংশ নেয়। তারা গণপরিষদ ভবন (জগন্নাথ হলের মিলনায়তন), প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউস (বাংলা একাডেমী ভবন), হাইকোর্ট ও সচিবালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সকলকে অফিস বর্জনের জন্য আহব্বান করে, ফলে বিভিন্নস্থানে পিকেটারদের পুলিশের লাঠিচার্জের সম্মুখীন হতে হয়। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীরা খাদ্যমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল ও শিক্ষামন্ত্রী আবদুল হামিদকে পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করে। এ বিক্ষোভ দমনের জন্য সরকার সেনাবাহিনী তলব করে। 

পূর্ব পাকিস্তানের জেনারেল কম্যান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার আইয়ুব খান (পাকিস্তানের সামরিক শাসক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি) মেজর পীরজাদার অধীনে একদল পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেন এবং তারা গণপরিষদে গিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিনকে বাবুর্চিখানার ভেতর দিয়ে বের করে আনে। বিকেলে এর প্রতিবাদে সভা অনুষ্ঠিত হলে পুলিশ সমাবেশ পন্ড করে দেয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (আমাদের জাতির পিতা), শামসুল হক, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, আব্দুল লতিফ তালুকদার, শাহ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ নেতা কর্মীকে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করে কারাগারে নিক্ষেপ করে। নেতাদের মুক্তির দাবিতে ১২ থেকে ১৫ মার্চ ঢাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট পালিত হয়। আন্দোলনের তীব্রতার মুখে ১৫ মার্চ খাজা নাজিম উদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের সাথে বৈঠকে মিলিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমেদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করেছিলেন। এ অবস্থায় বাধ্য হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমমুদ্দিন ১৫ই মার্চ রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সাথে ৮ দফা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। (১) ভাষার প্রশ্নে গ্রেপ্তার করা সবাইকে মুক্তি প্রদান করা হবে। (২) পুলিশি অত্যাচারের বিষয়ে তদন্ত করে একটি বিবৃতি প্রদান করা হবে। (৩) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব বাংলার আইন পরিষদে একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে। (৪) সংবাদপত্রের উপর হতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে। (৫) আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে না। (৬) ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে। (৭) পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠে যাবার পর বাংলাকে সরকারি ভাষা হিসাবে প্রবর্তন করা হবে। (৮) রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন “রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই” এই মর্মে মুখ্যমন্ত্রী ভুল স্বীকার করে বক্তব্য দিবেন।

প্রিয় পাঠক, বিস্ময়ের বিষয় যে, ১৫ই মার্চ মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমমুদ্দিন স্বাক্ষরিত ৮ দফা চুক্তির প্রতি পাকিস্তান সরকার কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে ১৯ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। ভারত বিভাগের পর এটাই ছিল তার প্রথম পূর্বপাকিস্তান সফর। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে দেয়া ভাষণে তিনি বাঙালীদের ভাষা আন্দোলনকে পাকিস্তানের মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ষড়যন্ত্র হিসেবে কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। যদিও তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী; কিন্তু সমাবেশে তিনি দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন-“উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোনো ভাষা নয়।” তিনি বাঙালীদের সতর্ক করে দিয়ে বলেন, “জনগণের মধ্যে যারা ষড়যন্ত্রকারী রয়েছে, তারা পাকিস্তানের শত্রু এবং তাদের কখনোই ক্ষমা করা হবে না”। মিঃ জিন্নাহ'র বিরূপ মন্তব্যে তাৎক্ষণিকভাবে ছাত্র-জনতার একাংশ বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা এ ধরনের একপেশে উক্তিতে আন্দোলনকারীরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। 

২৪ মার্চ পাকিস্তানের গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে ছাত্রদের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে একই ধরনের বক্তবে তিনি পুনরায় বলেন যে, ভাষা নিয়ে আন্দোলনে নামা সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ। তিনি অভিযোগ করেন, কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করতে চাইছে। তিনি বলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা' জিন্নাহ সাহেবের এরূপ বক্তব্যে, উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে নো, নো বলে চিৎকার করে প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। ১৭ নভেম্বর তারিখে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক সভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আজিজ আহমদ, আবুল কাশেম, কামরুদ্দীন আহমদ, আবদুল মান্নান, তাজউদ্দিন আহমদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে একটি স্মারকলিপি প্রণয়ন করে। ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খান পূর্বপাকিস্তান সফরে এলে স্মারক লিপিটি প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হলে তিনি কোন সাড়া দেয়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে প্রধানমন্ত্রীর সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র ইউনিয়নের তরফ থেকে প্রদত্ত মানপত্রে বাংলা ভাষার দাবি পুনরায় উত্থাপন করা হলে লিয়াকত আলী খান বাংলা ভাষা সম্পর্কে মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকেন। (চলবে)

লেখক: বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি এবং জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার আপীল বিভাগের সরকারী কৌশুলী।

এসি
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি