ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

ভাসানচর আন্দোলন এবং বাস্তবতা

কানাই চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ২২:২৩, ৮ নভেম্বর ২০১৯ | আপডেট: ২২:২৬, ৮ নভেম্বর ২০১৯

বর্তমান নাম ভাসানচর এবং স্বর্ণদ্বীপ। পূর্বে এর নাম ছিল ঠ্যাঙ্গারচর ও জাহাজ্জারচর। এরও অনেক দিন আগে নাম ছিল সন্দ্বীপের অংশ ন্যায়ামস্তি বা বিলিন হয়ে যাওয়া আরো কয়েকটি ইউনিয়ন।

নতুন নাম ধারনের আগে এ অঞ্চলের মানুষের প্রত্যাশা ছিল নতুন চরগুলো সন্দ্বীপের অংশ হবে। প্রত্যাশাটার ন্যায্যতা ছিল এবং আছে। পাঁচশ বর্গমাইলের সন্দ্বীপ ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে ৮০ বা নব্বই মাইলে এসেছে। সুতরাং বিলীন হওয়ার পর মূল ভূখন্ডের পাশাপাশি যে চরগুলো উঠেছে তাতো সন্দ্বীপের অংশই হবে। এটাতো সাধারণ লজিক।

কিন্তু না। সন্দ্বীপের মানুষের সেই আশা আকাঙ্খা বা স্বপ্ন চুরি হয়ে গেছে। মামলার মীমাংসা না করে কিংবা সন্দ্বীপের মানুষের দাবির প্রতি কোন রকম কর্ণপাত না করে প্রথমে জাহাজ্জার চর স্বর্ণদ্বীপ এবং পরে ঠ্যাঙ্গার চর, এখন ভাসানচর নাম ধারণ করে নোয়াখালী-হাতিয়ার অংশ করা হয়েছে।

সিদ্ধান্তটা কিন্তু সরকার বা রাষ্ট্রের। এখানে আমরা যতই নোয়াখালীর কোন নেতা বা নেতাদের দায়ী করি না কেন, রাষ্ট্রের পক্ষ হয়ে সরকারই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়া যায়। রাষ্ট্র ইচ্ছে করলে আমার বসত ভিটার সদর রাস্তাটি উপযুক্ত মূল্য পরিশোধ করে মালিকানা নিতে পারে এটাও আমাদের মাথায় থাকতে হবে।

স্বর্ণদ্বীপে সামরিক স্থাপনা এবং ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের জন্য আবাস স্থল নির্মাণে বিনিয়োগও হয়ে গেছে কোটি কোটি টাকার। তারপরও সম্প্রতি ভাসান চরকে হাতিয়ার কিংবা নোয়াখালীর একটি থানা হিসেবে ঘোষণার পর আবারো সন্দ্বীপ, চট্টগ্রাম এবং ঢাকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, যেখানে সন্দ্বীপের লোকজন আছেন তারা এ সিদ্ধান্তের তীব্র বিরোধিতা করে সভা-সমাবেশ করছেন। যা এখনো অব্যাহত আছে। হয়তো আরো কিছুদিন থাকবে।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, সভা-সমাবেশ করে এই দাবি-দাওয়া আদায়ে কতটুকু সাফল্য পাওয়া যাবে? আরো আগে এ আন্দোলন যখন শুরু হয়েছিল, তখন উল্লেখিত দুটি চর ছিল শুধু বিরানভূমি। কোন স্থাপনা কিংবা অবকাঠামো তখন ছিল না।

ভাসান চরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন হবে তা ছিল অকল্পনীয়। এখন বুড়িগঙ্গায় পানি বা জল অনেক যোগ হয়েছে। বর্তমান বাস্তবতায় স্বর্ণদ্বীপ ও ভাসানচর নতুন রূপ পেয়েছে। স্বর্ণদ্বীপে সামরিক স্থাপনা করা হয়েছে এবং যথারীতি নোয়াখালীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আর ভাসান চরে বাংলাদেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্র তৈরি করা হয়েছে। একই ভাবে হাতিয়া বা নোয়াখালীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে নতুন নাম ধারণকারী এ চরকে।

এখন প্রশ্ন, এ অবস্থায় আমাদের দাবির কৌশলটাই বা কি হবে? স্বর্ণদ্বীপ নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য না থাকলেও ভাসান চরটি কিভাবে আমরা সন্দ্বীপের অংশ হিসেবে দাবি করবো। আমরা কি রোহিঙ্গাদের অবস্থান মেনে নিয়েই ভাসান চরের কথা বলবো, নাকি রোহিঙ্গামুক্ত ভাসানচর চাইবো?

বাস্তব অবস্থা বিবেচনায় এ দাবিতে আমরা যতই সোচ্চার হই, সরকার ভাসান চরে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া থেকে সরে আসবে কিংবা সরে আসা সম্ভব কিনা তাও বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ, রোহিঙ্গা ইস্যু একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু। ভাসান চরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক সম্প্রাদায়সহ দেশী-বিদেশী সংগঠন অবগত। জাতিসংঘ থেকে শুরু করে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনগুলোও এ খবরটি জানে। দেশি এবং বিদেশি অনুদানে রোহিঙ্গাদের বসবাসের জন্যও অবকাঠামো তৈরিও শেষ। এমন অবস্থায় যদি আন্তর্জাতিকভাবে বাধা আসে কিংবা রোহিঙ্গারা না যাওয়ার গো ধরে, তাহলেই কেবল ভাসান চর রোহিঙ্গামুক্ত থাকতে পারে। রোহিঙ্গাদের ভাসান চরে পুনর্বাসনের সিদ্ধান্তটি রাষ্ট্র বা সরকারের কৌশলগত কিনা তাও বিবেচনায় নিতে হবে।

বর্তমানে আমাদের দাবি ভাসান চরকে হাতিয়া থেকে বাদ দিয়ে সন্দ্বীপের অন্তর্ভুক্ত করা। এ দাবির সঙ্গে রোহিঙ্গামুক্ত ভাসান চরের কথা নেই। এখন প্রশাসন আমাদের দাবির প্রতি সম্মান জানিয়ে যদি রোহিঙ্গাদের রেখে হাতিয়া কেটে সন্দ্বীপ থানার নাম বসিয়ে দেয়, তাহলে সন্দ্বীপের কি লাভ হবে? অবশ্য আগের অবয়বে ঠ্যাঙ্গার চর বা ভাসান চর সন্দ্বীপের সাথে যোগ হলে তা নিয়ে সন্দ্বীপবাসী বা আন্দোলনকারীদের কোন রূপ রেখা ছিল বলে আমার জানা নেই।

ভাসান চর সন্দ্বীপের হলে, সেখানে কি পুরানো ন্যায়ামস্তির ভূমিহীনদের প্রত্যাবাসন করা হবে নাকি, পুরো সন্দ্বীপের নদী সিকস্তীদের করা হবে, তা নিয়ে কোন আলোচনা বা পরিকল্পনার কথা শুনিনি।

আমরা যারা আন্দোলন করছি কিংবা ছড়িয়ে দিতে চাইছি তাদের এ বাস্তবতা অবশ্যই স্বীকার করতে হবে যে, এর আগে ভাসান চর বা জাহাজ্জার চরের মালিকানা দাবির সাথে সাথে এ চর দুটি নিয়ে আমারা সন্দ্বীপের মানুষ, না প্রশাসন বা সরকারের কাছে কোন পরিকল্পনাই তুলে ধরতে পারিনি। উল্লেখিত চর দুটি সন্দ্বীপের অংশ হলে সাধারণ মানুষ কি পাবে তা তাদের মধ্যে জাগ্রত হতে পারেনি, তা করতে পারলে আন্দোলনটা হয়তো আরো বেগবান হতে পারতো। দুঃখজনক সত্য এখন পর্যন্ত এ আন্দোলনটা এখনো এলিট শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ এবং মূল সন্দ্বীপের ভূখন্ড থেকে উৎসরিত নয়। যা হচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকায়। যে কারণে এর ধারাবাহিকতাও বিঘ্ন হয়েছে। মানুষ রাস্তায় নামে তখন, যখন তার বা সমাজের প্রাপ্যতাটুকু অনুধাবন করতে পারে।

এ দাবি নিয়ে সন্দ্বীপের জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা নিয়ে একটা অসন্তোষ আছে। থাকাটাই স্বাভাবিক। মাননীয় সংসদ সদস্যের বিষয়টি সংসদে উত্থাপন ছাড়া দৃশ্যমান আর কোন কর্মকান্ড উল্লেখ করার মত নেই। তিনি সন্দ্বীপবাসীর নেতা হলেও আন্দোলনকারীদের নেতৃত্ব নিতে দেখা যাচ্ছে না। আবার এটাও ঠিক, একটি ক্ষুদ্র অংশ তাকে দূরেও রাখতে চাইছে। এক্ষেত্রে তাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকটি সহজেই অনুমেয়। তবে এটা আমার ব্যক্তিগত অনুভূতি। আর এখানেই প্রকৃত সংকট বলে আমি মনে করি। এই সংকটের কারণে নেতার সংখ্যা বাড়ছে।

কোন রকম সমন্বয় ছাড়া বিভিন্ন নামে অনেক সংগঠনের ব্যানারে কর্মসূচি পালিত হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় সাত বা আটটি সংগঠনের নামে একটি মানববন্ধন অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে ঢাকায় সন্দ্বীপের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করে ‘সন্দ্বীপ সমিতি’র ব্যানারে কাউকে দেখা যায়নি।

অন্যদিকে, সাত বা আটটি সংগঠনের কোনটির কোনটির নাম দেখে মনে হয়েছে শুধুমাত্র প্রচারের আশায় এসব সংগঠনকে যোগ করা হয়েছে। যেগুলো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কোন সংগঠন নয়। এই আত্মপ্রবঞ্চনা কেন? সন্দ্বীপ সমিতির ব্যানার না থাকা যেমন দুঃখজনক, তেমনি আওয়ামী লীগ বা বিএনপির মত ১৪ দল ও ২০ দলীয় জোটের আদলে এরকম প্লাটফর্ম তৈরির মানসিকতা কোন ভালো বার্তা দিচ্ছে না। কারণ, মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা এসব আন্দোলন একটি ব্যানারের ছায়ায় হোক।

আমি আগেই বলেছি, ভাসান চর বা স্বর্ণদ্বীপ নিয়ে আন্দোলনটা একটি আঞ্চলিক আন্দোলন। এ আন্দোলন কোনভাবেই জাতীয় আন্দোলন নয়। ভাসান চর বা স্বর্ণদ্বীপকে সন্দ্বীপের অংশে না যোগ করে বাংলাদেশেরই অন্য একটি স্থান নোয়াখালীর সাথে যুক্ত করা হয়েছে। এতে করে দেশের কোন স্বার্থ নষ্ট হয়নি। এ দুটি স্থানকে অন্য কোন দেশ দখল করে নিয়ে যায়নি।

সুতরাং এ আন্দোলন কোনভাবেই জাতীয় ইস্যুতে রূপ দেয়া যাবে না। এক্ষেত্রে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন বা জেলা পরিষদ এগিয়ে আসতে পারলেও সিদ্ধান্তটি যেহেতু রাষ্ট্রের জন্য সরকার নিয়েছে, তাই সরকারি দল, সরকারি দলের জনপ্রতিনিধিরা, জেলা পরিষদ ও চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন দৃশ্যমান কোন ভূমিকা রাখতে পারবেনা এটাই স্বাভাবিক এবং বর্তমান রাজনৈতিক বাস্তবতা।

আমার এ লেখা ভাসান চরের দাবিকে ম্লান করা কিংবা দাবি থেকে সরে আসার লক্ষ্য থেকে নয়। বরঞ্চ উল্লেখিত বাস্তবতাকে আমলে নিয়ে আন্দোলনের কৌশল ঠিক করে আমাদের এ দাবিকে আরো বেগবান করা এবং কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে সমর্থ হওয়া। না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের অবস্থান থাকবে প্রশ্নবোধক।

লেখক: উপপ্রধান প্রতিবেদক, বাসস।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি