ভুট্টো বললেন, ‘রইল নিরাপত্তা পরিষদ, আমি চললাম’
প্রকাশিত : ০০:০৯, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১ | আপডেট: ০০:১১, ১৫ ডিসেম্বর ২০২১
১৫ ডিসেম্বরের সন্ধ্যা। জেনারেল নিয়াজি ‘আত্মসমর্পণ‘ সম্মতি জানিয়ে জেনারেল মানেকশকে বার্তা পাঠান। আমেরিকার সময় বিকেল চারটায় নিউইয়র্কে নিরাপত্তা পরিষদের ১৬১৪ নম্বর কক্ষে শুরু হলো বৈঠক।
ততক্ষণে নিয়াজির আত্মসমর্পণ বার্তা জেনারেল মানেকশর হাতে। হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে বৈঠক শুরু হলো।
হেনরি কিসিঞ্জার প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে বললেন, রাশানরা নিশ্চয়তা দিয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানে হামলার ঘটনা ঘটবে না। নিক্সন জানতে চাইলেন, আমাদের সঙ্গে সোভিয়েতের বোঝাপড়ার বিষয়টি চীন কিভাবে দেখবে?
কিসিঞ্জার বললেন, যদি পশ্চিম পাকিস্তান রক্ষা পায়, তা হলে চীনারা আনন্দে লাফিয়ে উঠবে।
উত্তেজিত ভুট্টো। উত্তেজনায় নিজেকে সামাল দিতে পারছেন না। নিরাপত্তা পরিষদের ভাষণে বললেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদ আমাদের ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত করেছে। সদস্যরা যদি ভেবে থাকেন, তাদের তৈরি আত্মসমর্পণ দলিলে আমি সই করব তা হলে তারা ভুল করেছেন।’
এরপর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংয়ের দিকে আঙুল তুললেন ভুট্টো। বললেন, ‘‘তাকে মাননীয় বলা হয়েছে, এই মাননীয় বলার কী মানে? লোকটি যদি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে পারেন, তা হলে আমি অখণ্ড ভারতের প্রধানমন্ত্রী হতে পারি। কিন্তু না, এর বদলে আমি মুক্ত দেশের ঝাড়ুদার হওয়া পছন্দ করি। আমি আমার দেশের অকৃত্রিম ও অবিসংবাদিত নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনে যে বিজয় অর্জন করেছি, তা পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবুর রহমানের বিজয়ের চেয়ে চমকপ্রদ।’
‘আমার দেশ যোদ্ধার দেশ। বিশ্বের সেরা পদাতিক পাকিস্তানে। আমরা যুদ্ধ করব। হাজার বছর ধরে যুদ্ধ করব। অল্প সময়ের বিজয়ে আমাদের আগ্রহ নেই।’’
এসব বলে এবার সোভিয়েত প্রতিনিধি ইয়াকভ মালিকের দিকে আঙুল তুললেন ভুট্টো, ‘আমি জানি, আপনি একটি মহান দেশের প্রতিনিধি, আপনাকে দেখে তাই মনে হয়। বিশেষ করে যেভাবে আপনি বুক উঁচু করে চলেন, যেভাবে টেবিল চাপড়ান তা দেখে মনে হয় আপনি কমরেড মালিকের মতো কথা বলেন না। কথা বলেন জার মালিকের মতো। আমরা চাই, আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক কিন্তু আপনারা আমার দেশকে নিশ্চিহ্ন করতে চান।’
বক্তৃতার শেষ প্রান্তে ভুট্টো বললেন, ‘ইঁদুরের মতো পালিয়ে যাইনি কখনো। এই পরিষদ ছেড়ে চলে যাচ্ছি। এখানে এক মিনিট থাকাও অপমানজনক মনে করি। যুদ্ধবিরতির যে প্রস্তাব, তা ভার্সাই চুক্তির চেয়ে অপমানজনক, এই চুক্তি সমর্থন করতে পারি না। আমরা যুদ্ধ করব। আমার দেশ আমাকে ডাকছে, সময় নষ্ট করা যাবে না, রইল পড়ে আপনাদের নিরাপত্তা পরিষদ, আমি চললাম এসব বলে কয়েকটা কাগজ টুকরো টুকরো করে বেরিয়ে গেলেন।’
২
চারদিক থেকে শত্রুমুক্ত হওয়ার খবর আসছে।
বিভিন্ন জায়গায় উড়ছে লাল-সবুজের পতাকা। বিজয়ীর উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসছে, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ শ্লোগান। পাকিস্তানি সেনাদের এখন একটাই দাবি, ‘আত্মসমর্পণের পর আমাদের হত্যা করবেন না।
এদিকে পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে বঙ্গোপসাগরে রওনা দেয়া যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর থেকে মাত্র ২৪ ঘণ্টার দূরত্বে। পাল্টা আক্রমণ করতে ভারতীয় নৌবাহিনীর সহায়তায় ১৫ ডিসেম্বর সোভিয়েত ইউনিয়নের রণতরীর ২০টি জাহাজ ভারত মহাসাগরে অবস্থান নেয়। থেমে যায় সপ্তম নৌবহর। পাকিস্তানি সেনাদের নিজেদের রক্ষা করার নিভে যায় শেষ প্রদীপ। পাকিস্তানি সেনারা চট্টগ্রামের ঘাঁটি ছেড়ে রাউজান হয়ে পালিয়ে যায়। শত্রুমুক্ত হয় রাঙ্গুনিয়া।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা সন্ধ্যার দিকে চট্টগ্রামের ভাটিয়ারীতে হানাদার বাহিনীর উপর আক্রমণ চালায়। সারারাত ধরে চলতে থাকে যুদ্ধ। অন্যদিকে বগুড়া জেলা ও পার্বত্য জেলার খাগড়াছড়ি শত্রুমুক্ত হয়। শত্রুমুক্ত হয় পার্বতীপুর, নীলফামারী, গোয়ালন্দ।
লেখক: গবেষক
এসি