ভুল উপায়ে মাছ খেলে শরীরের যে ক্ষতি হয়
প্রকাশিত : ১১:১৩, ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ | আপডেট: ১৭:৫১, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯
নানা রকমের মাছ ও মাছের নানা রান্না আমাদেরকে ভোজনপ্রিয় করে তোলে। কিন্তু প্রতি দিন পাকা মাছ খাওয়া বা নিয়ম না মেনে যথেচ্ছ মাছ ভাজায় বিপদ ঘনাচ্ছে অজান্তেই। কী মাছ কতটা খাবেন, আর কীভাবে তার উপরই নির্ভর করবে শরীরের লাভ-ক্ষতি।
বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণ, সপ্তাহে একাধিকবার বা ঘন ঘন ফিশফ্রাই খেলে হৃদযন্ত্র বিকল হওয়ার আশঙ্কা ৪৫–৪৮ শতাংশ বাড়ে৷ মাঝেমধ্যে খেলে স্ট্রোকের আশঙ্কা বাড়ে প্রায় ৪৪ শতাংশ৷ তা ছাড়া যে সব মাছ দিয়ে মূলত ফিশ ফ্রাই বানানো হয়, তাতে হার্টের জন্য উপকারি ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড কম থাকে। ভাজাভুজি করার ফলে তা আরও কমে যায়৷ সঙ্গে কিছু ক্যালোরিও এসে জোটে৷ উচ্চ তাপে তেল ভেঙে ক্ষতিকর রাসায়নিক তৈরি হয়৷ ব্যবহার করা তেল দিয়ে ভাজলে আরও বিপদ৷ বনস্পতি দিয়ে ভাজলে তো কথাই নেই৷ কোলেস্টেরল বাড়ার পথ আরও প্রশস্থ হয়৷
তাহলে মাছ বন্ধ?
না, মাছ বন্ধ নয়৷ বন্ধ মাছ ভাজা৷ মাছকে বেক, গ্রিল বা ব্রয়েল (আগুনে ঝলসে) করে তো খেতেই পারেন! সপ্তাহে বার পাঁচেক এভাবে খেলে বিপদের আশঙ্কা ৩০ শতাংশ কমে যাবে বলে জানিয়েছেন বিজ্ঞানীরা৷ একান্ত ভাজা খেতে হলে বাড়িতে অল্প তেলে সাঁতলে বা সতে করে খান। ডুবা তেলে কড়কড়ে করে মাছ ভাজলে বিপদ আসন্ন। অনেক সময় চুনা মাছ ক়ড়কড়ে করে ভেজে খান অনেকেই। মাসের মধ্যে দুই-এক বার তা খেলেও মাছ ভেজে তাকে জড়িয়ে রাখুন ব্লটিং পেপারে। বাড়তি তেল শুষে যাবে এতে। এভাবে সামান্য হলেও এড়ানো যায় বিপদ।
পুষ্টি অটুট রাখতে গেলে মাছ ভাজার অভ্যাস বদলাতে হবে৷ রান্না করতে হবে সাঁতলে৷ কারণ শুধু ভাল জাতের প্রোটিন বা ব্রেন ফুড বলে নয়, তৈলাক্ত মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছ সঠিকভাবে রান্না করে খেলে ওজন, রক্তচাপ, কোলেস্টেরল, সুগার, সব মোটামুটি বশে থাকে৷ হার্ট অ্যাটাক ও স্ট্রোকের আশঙ্কা অনেক কমে যায়৷
৪৯ হাজার নারীর উপর পরিচালিত একটি গবেষণা ‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর ‘হাইপারটেনশন’ নামের জার্নালে প্রকাশিত হয়। সেখানে এক প্রবন্ধে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন, যে সমস্ত নারী সপ্তাহে অন্তত একবার মাছ খান, তাদের তুলনায়, যারা মোটে খান না বা ন’মাসে ছ’মাসে খান, তাদের হৃদরোগ হওয়ার আশঙ্কা ৫০ শতাংশ বেড়ে যায়৷ সুতরাং মাছ কিন্তু বাদ দেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
মাছের ম্যাজিক
১. মাছের তেলে আছে পলিআনস্যাচুরেটেড এসেনশিয়াল ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড। প্রচলিত কথায় ওমেগা থ্রি’জ৷ তিন ধরনের ওমেগা থ্রি হয়, এএলএ (আলফা লিনোলেনিক অ্যাসিড), ডিএইচএ (ডোকোসাহেক্সেনোয়িক অ্যাসিড) ও ইপিএ (ইকোস্যাপেনটেনিনোইক অ্যাসিড)৷ সামুদ্রিক মাছে, পুকুর ও নদীর কিছু তৈলাক্ত মাছে ডিএইচএ এবং ইপিএ পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে৷ ফলে নিয়মিত খেলে হার্টও ভাল থাকে৷
২. মাছে ভাল জাতের প্রোটিন প্রচুর থাকে বলে খেলে পেট বহুক্ষণ ভরা থাকে৷ ওজন কমার সুরাহা হয়৷ রক্তে চর্বির মাত্রা কমিয়ে ইসকিমিক হার্ট অ্যাটাক ঠেকাতেও সে সিদ্ধহস্ত৷
৩. ওমেগা থ্রি’র প্রভাবে মন ভাল থাকে৷ মানসিক চাপ–উদ্বেগ কম হয়৷ এমনকি, ডিপ্রেশনের রোগী যদি ওষুধের সঙ্গে পর্যাপ্ত মাছ খান, রোগ সারে দ্রুত৷ আর স্ট্রেস–টেনশন–ডিপ্রেসন কম থাকলে হার্টের স্বাস্থ্যও ভাল থাকে।
৪. তৈলাক্ত মাছ, বিশেষ করে সামুদ্রিক মাছকে বলে ব্রেন ফুড৷ সপ্তাহে মাত্র এক দিন খেলেই স্মৃতিশক্তি, নতুন কিছু শেখা ও চিন্তা–ভাবনার দক্ষতা বাড়ে৷ বিভিন্ন স্টাডি থেকে জানা গেছে যারা নিয়মিত বেকড বা ব্রয়েল্ড মাছ খান, তাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়ে, ফলে বয়সের সঙ্গে অ্যালঝাইমার্স ডিজিজ হওয়ার আশঙ্কা কমে যায়৷
৫. ছোট থেকে তৈলাক্ত মাছ খেলে মস্তিষ্ক উন্নত মানের হয়৷ তবে বাচ্চাদের সামুদ্রিক মাছ খাওয়ানোর আগে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া উচিত৷ সব চেয়ে ভাল হয়, নিয়মিত পুকুর বা নদীর মাছ খাওয়ানোর পাশাপাশি সপ্তাহে এক–আধ দিন সামুদ্রিক মাছ খাওয়ালে৷
৬. ত্বক–চুলের উজ্জ্বলতা বাড়াতে ওমেগা থ্রি–র ভূমিকা আছে৷ সোরিয়াসিস নামে ত্বকের অসুখের প্রকোপ কমাতে ওষুধপত্রের সঙ্গে অনেক সময় তৈলাক্ত মাছ খেতে বলা হয়৷
৭. তিন আউন্সের এক পিস স্যামন খেলেই ভিটামিন ডি–এর যা চাহিদা, তার ৭৫ শতাংশ পূরণ হয়ে যায়৷ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে৷ হাড় সুস্থ থাকে৷
৮. সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে জানা গেছে, সুষম খাবার খাওয়ার পাশাপাশি সপ্তাহে অন্তত দু’বার তৈলাক্ত মাছ খেলে শুক্রাণুর মান ভাল হয়৷
কোন মাছ, কতখানি, কীভাবে
‘ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ’-এর বিজ্ঞানীদের মতে, সারা দিনে যত ক্যালোরি খাওয়া হয়, তার অন্তত দু’শতাংশ আসা উচিত ওমেগা থ্রি থেকে৷ মোটামুটি হিসাবে দিনে ৪ গ্রামের মতো৷ মাছ থেকে এ চাহিদা পূরণ করতে চাইলে, দেখে নিন ‘আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন’-এর গাইডলাইন কী বলছে৷
হার্টের সুরক্ষার খাতিরে সপ্তাহে অন্তত দুই-তিন বার ৩ দশমিক ৫ আউন্সের মতো তৈলাক্ত মাছ খান৷ ক্যালোরি নিয়ে চিন্তা করবেন না৷ ব্যায়াম করলে ও অস্বাস্থ্যকর খাবার না খেলে এটুকু থেকে কোনও সমস্যা হয় না৷ মাঝেমধ্যে চুনা মাছ খান৷ পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম পাবেন৷ হৃদরোগ ঠেকাতে খান কালচে রঙের মাছ৷ যেমন- স্যামন, ম্যাকারেল, ব্লু ফিশ৷ রুই-কাতলা, মৃগেলেও উপকার আছে। তবে খুব পাকা বা দীর্ঘ দিনের বরফ দেওয়া চালানি মাছ হলে সে মাছ এড়িয়ে চলুন।
মাছ কীভাবে রান্না করছেন সেটাও খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়৷ ইসকিমিয়া, হার্ট অ্যাটাক বা হৃদযন্ত্র বিকল হওয়া থেকে বাঁচতে ভাজা মাছ খাবেন না৷ খাবেন বেক, ব্রয়েল বা গ্রিল করে৷ মাছসেদ্ধ বা ফিশ স্টুও খেতে পারেন৷ অসুখবিসুখ না থাকলে মাঝেমধ্যে মাছ ভাজা খেলে তত ক্ষতি নেই৷ তবে ভাজতে হবে নিয়ম মেনে৷
মাছ ভাজার নিয়ম
১. ছাঁকা তেলে না ভেজে প্যান ফ্রাই করুন৷ অর্থাৎ কড়াইতে অল্প তেল দিয়ে, তা হালকা গরম হলে ম্যারিনেট করা মাছ দিন৷ কম আঁচে আস্তে আস্তে এ–পিঠ ও–পিঠ করে ভাজুন৷ ইন্ডাকশন কুকারের সতে করে রান্না করলে সবচেয়ে ভাল৷ কারণ তাতে তাপমাত্রা একটা নির্দিষ্ট সীমায় বাঁধা থাকে৷ তেল গরম হয়ে ধোঁয়া বেরতে শুরু করলে কিন্তু ট্রান্স ফ্যাটের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে বাড়ে ক্ষতির পাল্লা৷
২. অলিভ অয়েল দিয়ে প্যান ফ্রাই বা সতে করতে পারেন৷ ওই তাপমাত্রায় এই তেলই সবচেয়ে নিরাপদ৷
৩. পাউরুটির গুঁড়া দিয়ে বানানো ব্যাটারে ডুবিয়ে মাছ ভাজলে প্রচুর তেল লাগে৷ ভাজা মাছের ক্যালোরি বেড়ে যায়৷
৪. ভাজা করার পর তেল বেঁচে গেলে তা দিয়ে অন্য কোনও রান্না না করে ফেলে দিন৷ না হলে হাই কোলেস্টেরল ও ক্যানসারের আশঙ্কা বাড়বে৷ বাজারের ভাজা খাবারে এই সুবিধা নেই বলাই বাহুল্য৷ কাজেই সে সব খাওয়া কমান৷
সূত্র: আনন্দবাজার
একে//