ঢাকা, বুধবার   ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪

ভয় : নেতিচিন্তার জননী

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৩, ২১ জুলাই ২০২১

নেতিবাচক চিন্তার জননী হচ্ছে ভয়। ভয় এক অদৃশ্য ভূত। অনেকের জীবনেই ভয় তাড়া করে বেড়ায় ছায়ার মতো। ভয় যে কত ধরনের হতে পারে তার ইয়ত্তা নেই। অবশ্য ভয়কে বিশ্লেষণ করলে আমরা প্রধানত দুধরনের ভয় পাই। একটার প্রভাব ইতিবাচক। অন্যটির প্রভাব নেতিবাচক। ইতিবাচক ভয় অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে পরিণত হয়েছে। তা যুক্তিসঙ্গত ও সার্বজনীন। যেমন আগুন লাগার ভয়। যদি আগুনের ব্যাপারে আপনার কোনো ভয় না থাকে তবে আপনি এমন বেপরোয়া হয়ে যাবেন যে, আজ হোক বা কাল আপনি সম্ভবত আগুন দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। আপনার যদি রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর ব্যাপারে কোনো ভয় না থাকে তাহলে আপনি আজ হোক বা কাল দুর্ঘটনা ঘটাবেনই। আগুন ও দুর্ঘটনার ভয় আপনাকে সতর্ক ও সজাগ রাখে, আপনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করে। এ ধরনের যুক্তিসঙ্গত ইতিবাচক ও কল্যাণকর ভয়ের আরো অনেক উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। 

ভয় অনেক সময় সৃজনশীল শক্তিতে পরিণত হতে পারে। যেমন অজ্ঞানতার ভয়। এ ভয়ই স্কুল ও শিক্ষায়তনের জন্ম দিয়েছে। পচা-বাসি খাবারের ভয়ই পরিচ্ছন্নতা ও বিশুদ্ধতার জন্ম দিয়েছে। 

আমাদের এখানকার মূল আলোচনা হচ্ছে নেতিবাচক ভয় নিয়ে যা আমাদের কুরে কুরে খায়। নেতিবাচক ভয়ের মধ্যে প্রধান কয়েকটি হচ্ছে-
১. রোগ ভয় । ২. লোক ভয় । ৩. বার্ধক্যের ভয় । ৪. প্রিয়জন বিচ্ছেদের ভয় । ৫. নিরাপত্তার ভয় । ৬. ব্যর্থতার ভয় । ৭. দারিদ্রের ভয় । ৮. পোকা মাকড়ের ভয় । ৯. ভুতের ভয় । ১০. মৃত্যুভয়।

ভয়ের মধ্যে সবচেয়ে বড় ভয় মৃত্যুভয়। আমরা সবসময় আতঙ্কিত থাকি যদি মারা যাই! ভাবখানা এমন যে আমার আগে কেউ মারা যায় নি। আমিই প্রথম মারা যাব। অথচ বাস্তব সত্য হচ্ছে পৃথিবীতে আসার পর আপনার জীবনে যদি একটি মাত্র সত্য থাকে তবে তা হচ্ছে মৃত্যু। আপনি যত ভালো কাজ করেন না কেন আপনি মারা যাবেন। যেমন নবী রসুল, দরবেশ, মুনি ঋষি, ধর্মবেত্তা সবারই দৈহিক মৃত্যু হয়েছে। আবার সবচেয়ে খারাপ কাজ যারা করেছে, জুলুম করেছে, অত্যাচার করেছে, মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার জন্যে নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা তৈরি করেছে, তারাও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পায় নি। লৌহ যবনিকার মাঝেই স্টালিন মারা গেছেন। সিআইএ এফবিআই কেনেডিকে বাঁচাতে পারে নি। হিটলার এটম বোমাপ্রুফ বাঙ্কারে আত্মহত্যা করে ভবলীলা সাঙ্গ করেছেন। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। তাই মৃত্যুকে ভয় পাওয়া বোকামি মাত্র। 

মৃত্যুভয় নিয়ে সুন্দরবনের বিখ্যাত বাঘ শিকারী পচাব্দি গাজীর চমৎকার এক গল্প রয়েছে। ৬৫টি বাঘ শিকারকারী পচাব্দি গাজীর বাবা ও দাদাও ছিলেন বাঘ শিকারী। পৃথিবীর সর্বাধিক সংখ্যক বাঘ শিকারকারী পচাব্দি গাজীর এক বন্ধু একদিন বলল, ‘পচা তোর বাঘকে ভয় করে না।’ জবাবে পচাব্দি বললেন, ‘না’। ‘তোর বাবাকে তো বাঘে খেয়েছে! তারপরও তোর বাঘকে ভয় করে না।’ পচাব্দির জবাব, ‘না’। তোর দাদাকেও তো বাঘে খেয়েছে। তারপরও তোর বাঘকে ভয় করে না।’ পচাব্দির সেই একই জবাব ‘না’।

এবার পচাব্দির পালা। পচাব্দি তার বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তোর বাবা কীভাবে মারা গেছে’। বন্ধুর জবাব, ‘রাতে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সকালবেলা সবাই দেখল তিনি মারা গেছেন।’ ‘তোর দাদা’ পচাব্দি জানতে চাইলেন। ‘দাদাও রাতে বিছানায় শুয়ে ছিলেন। সকালবেলা সবাই দেখল তিনি মারা গেছেন’, বন্ধু জানাল। এরপর মুচকি হেসে পচাব্দি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুই কি এখনো রাতে বিছানায় ঘুমাস’!

অর্থাৎ বাঘের হাতে মুত্যু আসুক বা বিছানায়, মারা আপনি যাবেনই। মৃত্যু জীবনের অবধারিত সত্য। তবে যদি আপনি মৃত্যুকে ভয় পান তবে প্রতিদিন আপনি নব নবভাবে মৃত্যুযন্ত্রণা ভোগ করবেন। আর মৃত্যুকে ভয় না পেলে আপনি শুধু একবারই মারা যাবেন। সেই জন্যেই বলা হয়, ভীরু মরে হাজার বার আর বীরের মৃত্যু একবার।

তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে মৃত্যুভয় বা যে-কোনো ভয়ের অবস্থান হচ্ছে আমাদের সচেতন মনে। আপনি যদি এই ভয়গুলো কাগজ-কলমে লিপিবদ্ধ করে ফেলেন, তাহলে এগুলোকে যথাযথভাবে শনাক্ত করতে পারবেন। পারবেন এগুলোর উৎস খুঁজে বের করতে। একবার এগুলোকে যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ করতে পারলে এগুলোর আকৃতি হবে লিখিত অক্ষরের সমান। তখন আপনি এ ভয়গুলোর বিরুদ্ধে সহজে পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন। আমরা যদি আমাদের সচেতনতার সমুদ্রের গভীরে এই ভয়গুলোকে বিচরণ করতে দেই তাহলে আমাদের অজান্তেই এগুলো লালিত পালিত হয়ে নাদুস-নুদুস হয়ে উঠবে। এগুলোর হাত থেকে আমরা কখনো রেহাই পাব না। গভীর সমুদ্রে অনেক বিশাল প্রাণী বাস করে। এগুলোকে যদি কোনোভাবে সমুদ্রের তীরে নিয়ে আসা যায়, তাহলেই এগুলোর মৃত্যু ঘটে। ভয়কেও এই একইভাবে মোকাবেলা করতে হবে। 

ভয় কখনো গভীর পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের আলো সহ্য করতে পারে না। ভয় হচ্ছে অন্ধকারের কীট। আলোয় এলেই তা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। আমাদের জীবনের সবচেয়ে বেশি সমস্যার কারণ হচ্ছে অনির্দিষ্ট ভয়। ‘যদি এমন হয় তবে কী হবে’ এই আতঙ্কই আমাদের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করে। তাই আপনার আশঙ্কাকে কাগজে কলমে স্পষ্ট করে লিখে ফেলুন। লেখার পর জিজ্ঞেস করুন, এরপর কী হবে? সবচেয়ে খারাপটাই লিখুন। কাগজে বড় করে লিখুন। যাতে করে আপনি দেখতে পারেন। ভয়ের হাত থেকে বাঁচার সহজ পথ একটাই। তা হচ্ছে ভয়ের কথা কাগজে লিখে তা পুড়িয়ে ফেলা। এভাবে আপনি পর্বত প্রমাণ ভয়কেও নিষ্ক্রিয় করে দিতে পারেন। কারণ যখনই অজানা জানা হয়ে যায়, তখনই ভয় তার রহস্য ও শক্তি দুই-ই হারিয়ে ফেলে। যেমন অন্ধকারে কাকতাড়ুয়া দেখেও আপনি ভূত ভেবে ভয় পেতে পারেন। কিন্তু একবার টর্চের আলো ফেলুন। ব্যস! সব শেষ। আপনি বুঝতে পারবেন আপনার ভয়ের উৎস সামান্য খড়কুটো, বাঁশ আর একটা হাড়ি ও একটা জামা মাত্র।

ভয় থেকে মুক্তি পাওয়া বা ভয়কে কাবু করার আরেকটা পথ হচ্ছে ভয়কে নিয়ে ঠাট্টা করা। ভয়কে জয় করার জন্যে অবজ্ঞা ও অবহেলার চেয়ে সফল অস্ত্র আর কী হতে পারে। আপনি ক্ষমতা না দিলে আপনার ওপর ভয়ের কোনো ক্ষমতা থাকতে পারে না। 
লেখাটি কোয়ান্টাম মেথডের প্রবক্তা মহাজাতক এর মেডিটেশন বই থেকে সংগ্রহ।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি