ঢাকা, শনিবার   ২১ ডিসেম্বর ২০২৪

মধুসূদনের নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন শবদেহ

স্বপন সেন

প্রকাশিত : ১৭:০৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩ | আপডেট: ১৭:০৩, ২৯ জানুয়ারি ২০২৩

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত।

এনেছিলে সাথে করে মৃত্যুহীন প্রাণ ,........
আষাঢ় মাসের ভেপসা গরমের মধ্যে মধু কবি মাইকেল

মধুসূদনের নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন শবদেহ হাসপাতালের মর্গেই পচতে থাকে। কোন মধুসূদন? যিনি ১৮৬১ সালে, রবীন্দ্রনাথের জন্মের মাস কয়েক আগে প্রথম পাঁচটি সর্গ নিয়ে মেঘনাদবধ কাব্যের রচয়িতা। বাংলা ভাষা তখন পেয়ে গিয়েছিল সে সময়ের শ্রেষ্ঠ কবিকে। 

যিনি বাংলা ভাষা, বিশেষত তার কাব্য ও ছন্দকে মোড় ফিরিয়ে দেওয়ার অসামান্য কীর্তি স্থাপন করেছিলেন৷ অথচ তাঁর শবদেহ মর্গে পড়ে আছে....৷ মৃত্যুশয্যাতেই তাঁকে শুনে যেতে হয়েছিল..

১৮৭৩ সালে ২৯ জুন আলিপুর জেনারেল হাসপাতালে প্রয়াত হলেন কবি মাইকেল মমধুসূদন। কলকাতার বিশপ রবার্ট মিলম্যান মৃত্যুর পরের দিন সকালেও কবির মৃতদেহ খ্রিস্টানদের গোরস্থানে সমাহিত করার অনুমতি দিলেন না! 

অন্যদিকে, মাইকেলের স্বদেশবাসী, সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজও তাকে গঙ্গার ঘাটে অন্তিম সংস্কারে আগ্রহী হলো না। 

স্বধর্ম ও স্বজাতির কাছে ‘সিদ্ধান্তহীন ও আগ্রহরহিত’ মাইকেলের নিঃসঙ্গ ও অভিভাবকহীন শবদেহ তৎকালীন কলিকাতার বাঙালি সমাজের কাছে কলঙ্কচি‎হ্ন স্বরূপ অপাঙতেয় ছিলো, যদিও সেই ঐতিহাসিক মৃতদেহটি বস্তুতপক্ষে তৎকালীন সমাজের পশ্চাৎপদতা ও সংস্কারের প্রতি কার্যত বোধহয় কটাক্ষই করছিল!

মাইকেলের শবদেহ সমস্যার সমাধান হয়েছিল, যখন সাহস নিয়ে এগিয়ে আসেন একজন ব্যাপটিস্ট ধর্মযাজক। তিনি কবির মরদেহ সমাধিস্থ করার সংকল্প প্রকাশ করেন। প্রায় একই সময়ে অ্যাংলিকান চার্চের একজন সিনিয়র চ্যাপেলেইন, যার নাম রেভারেন্ড পিটার জন জার্বো, বিশপের অনুমতি ছাড়াই তার মৃতদেহ সমাধিস্থ করার উদ্যোগ নেন।

৩০ জুন বিকেলে, মৃত্যুর ২৪ ঘণ্টারও পরে, কবির মৃতদেহ নিয়ে তার ভক্ত এবং বন্ধু-বান্ধবসহ প্রায় হাজার খানেক মানুষ এগিয়ে যান লোয়ার সার্কুলার রোডের খ্রিস্টান গোরস্থানের দিকে। সেকালের বিবেচনায় এই লোক সংখ্যা খুব কম নয়। শবানুগমনে কলকাতার বাইরের বহু লোক অংশ নেন; অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল নানা ধর্ম ও বর্ণের মানুষ। 

তবে একদা শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার নিদর্শনস্বরূপ নিজের গ্রন্থ উৎসর্গ করে কবি যাদের বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিখ্যাত করেছিলেন, তাদের কেউ এই ভিড়ের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন না। মাইকেল যেখানে চলেছেন, সেই লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে মাত্র চার দিন আগে হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করা হয়েছিল। সেই হেনরিয়েটা যিনি অবর্ণনীয় দুঃখ ও দারিদ্র্য যাপন করেছেন, বিদেশ-বিভুঁইয়ে বা এ শহরেও কপর্দকশূন্য দিন কাটিয়েছেন। তবু কোনও দিন ছেড়ে যাননি মধুসূদনকে।

কবির জন্যে কবর খোঁড়া হয় হেনরিয়েটার কবরের পাশে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া যখন নিশ্চিতভাবে হতে চলেছে, তেমন সময়ে লর্ড বিশপের অনুমতি এসে পেছন-পেছন হাজির হলো। 

রেভারেন্ড পিটার জন জার্বোই কবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সমাধা করেন। চার্চের ব্যুরিয়াল রেজিস্টারে তাঁর নাম পর্যন্ত ওঠানো হলো না। এমনকি লন্ডনের ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরিতে রক্ষিত চার্চের রেজিস্টারে কবিকে এবং হেনরিয়েটাকে সমাধিস্থ করার কোনো তথ্য নেই। লোয়ার সার্কুলার রোডের পাশাপাশি সমাধিতে শুয়ে আছেন মধুসূদন-হেনরিয়েটা। 

আজ মাইকেল মধুসূদনের জন্মদিনে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি।

এসি

 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি