ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪

মধ্যরাতে কুপি হাতে খুঁজছে মা

আউয়াল চৌধুরী

প্রকাশিত : ১৬:৩৪, ১০ মে ২০২০ | আপডেট: ১৭:১৫, ১০ মে ২০২০

যখন মায়ের মৃত্যু সংবাদটি শুনি তখন এতটাই বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম যে আর কোনো হুঁস জ্ঞানই ছিল না। ব্যাথায় বেদনায় মনে হয়েছিল আমিও বোধ হয় মারা গেছি। এক সপ্তাহ খাওয়া দাওয়া ঘুম কিছুতেই মন ছিল না। কারণ ক্লাস সেভেনে থাকতে আব্বা মারা যান। এরপর মাকে কেন্দ্র করেই একটা জগত তৈরি হয়েছিল।

সবকিছুতেই মা। আর মায়েরও আমার জন্য যেন অন্তপ্রাণ অবস্থা। সবার ছোট হওয়ায় আগলে রাখার একটা মানসিকতা। লুকিয়ে সবার অলক্ষে একটু বেশি কিছু খাওয়াতে পারলে যেন মনে শান্তি। এই প্রিয় মুখটি আমার কাছ থেকে চলে গেছে, কতঘণ্টা মাস বছর পার হয়ে গেল। যে কোনো কিছু শেয়ারিং এর একটা জায়গা ছিল মা। মাকে বলতাম পড়াশোনা শেষ করে যখন ইনকাম করবো সব তোমাকে দেব। শুনে মা শুধু হাসতেন। চোখের আড়াল হতে দিতেন না। একটু খেলার জন্য দূরে কোথাও গেলে খোঁজা খুঁজি শুরু করে দিতেন। কখনো মারেননি। মারলে তার কলিজাটা ছিঁড়ে যাবে। 

একবার বাহিরে খেলতে গিয়ে মারামারি লেগে একজনের মুখের উপর একটা মেরে দিলাম। ঝির ঝির করে মুখ থেকে রক্ত বের হয়ে গেল। আর সে ওই মুখ নিয়ে আব্বাকে এসে বললো- ‘আন্নের গো আউয়াল আমাকে মারছে’। আব্বা তার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন- ঠিক আছে তুমি যাও আমি ওরে শাস্তি দেব। এরপর আব্বা বাঁশের একটি ছিপ নিয়ে ঘরের সামনে গেঁথে রাখলেন। সন্ধ্যায় আমি বাড়িতে ঢুকার সঙ্গে সঙ্গে কয়েকজন এসে বললো আজকে তোমাকে খাবে। এরপর আমি পালিয়ে গেলাম। রাত ১২টা তখনও ঘরে আসি নাই। এদিকে আম্মা সারা বাড়ি খুঁজে খুঁজে হয়রান। আমার সহ-পাঠি রাসেল-রাশেদ ওদের কাছে কতবার যে গেছেন কিন্তু আমার কোনো হদিস নেই। আমাদের বাড়ির ঘাটায় কুপি হাতে যে কতবার গেছেন। এদিকে আব্বাও কয়েকবার খুঁজে গেছেন। জোরে জোরে বলে গেছেন আর মারবেন না। আমি অন্ধকারে ঝোপের মধ্যে বসে আছি। রাত ১২টার দিকে মা আবার আসলেন। নাম ধরে ডাকলেন আর বললেন- মারবে না বলেছে, চলে আয়। হাতের কুপি বাতিটা নিয়ে গাছের নিচে দাঁড়িয়ে আছেন। আমার কোনো সাড়া শব্দ না দেখে কুপি ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন। বললেন- আমি এখনো খাই নাই। তুই আয়। ওই সময়ে গ্রামে রাত ১২টা মানে মধ্য রাত। পুরো বাড়ির সবাই গভীর ঘুমে। আমি অবশেষে নিন্দা গাছের ঝোপের ভেতর থেকে যখন বের হলাম মা তখন আমাকে দেখে চমকে উঠলেন। বললেন, ওখানেতো সাপ থাকে সেখানে কেন গেলি। তাড়াতাড়ি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ঘরে গিয়ে একসঙ্গে খেয়ে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে যাই। আব্বাও আর কিছুই বলেননি।

এভাবে কত ঘটনা কত স্মৃতি যে আছে সেটা হয়ত এখন শেষ করতে পারবো না। মায়ের ভালোবাসার চাদর শরীরের উপর এতটাই বেশি ছিল যে তার শূন্যতায় সবকিছুই থেমে যায়। স্বাভাবিক হতে বহু সময় লেগে গেল। হঠাৎ ঘুম থেকে চমকে উঠে যেতাম। নিরবে চোখ দিয়ে পানি ঝরতো। একটা শুন্যতা, একটা আকুল পাথারে যেন হাবুডুবু খেতে লাগলাম। এটাই জীবনের নিয়ম। কিছুই করার নেই। সৃষ্টিকর্তা কাউকে নিয়ে গেলে কারো পক্ষে ধরে রাখার উপায় নেই। আজকের এই করোনাকালে মা থাকলে ভীষণ উদ্বিগ্ন থাকতেন। বার বার ফোন দিতেন। ব্যাকুল হয়ে যেতেন। বলতেন চাকরির দরকার নেই বাড়ি চলে আস।

বাড়ি থেকে বের হয়ে কোথায়ও গেলে বাড়ির কাছারির কোনায় এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। যতক্ষণ অদৃশ্য না হচ্ছি মুখে আচল গুঁজে অপলক চোখে তাকিয়ে থাকতেন। হাত নাড়তেন। আমি মাঝে মাঝে বাহিরে থেকে আম্মার জন্য চকলেট নিয়ে আসতাম, কেক নিয়ে আসতাম, কোকের বোতল নিয়ে আসতাম। মনে করতেন এটা আমার পাগলামি। তিনি হাসতেন। আমি বলতাম তুমি যদি মরে যাও তখনতো আমি খাওয়ানোর সুযোগ পাবো না। তখন জড়িয়ে ধরতেন। বলতেন কেউ তো সারাজীবন পৃথিবীতে থাকবে না। একদিন সবাইকেই যেতে হবে। এ জন্য ভালো ভালো কাজ করতে হবে। খারাপ কাজে যাবি না।

আজকে যখন দেখি কোনো সন্তান মাকে বাড়ি থেকে নির্যাতন করে বের করে দিয়েছে। তখন মনটা হু হু করে উঠে। কোনো সন্তান কি পারে এমনটা করতে। গতকালকে খবরে দেখলাম খুশবানু নামে আমার মায়ের বয়সী এক মাকে তার সন্তান নির্যাতন করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। হবিগঞ্জের চুনারুঘাট এলাকায় এটা ঘটে। পরে পুলিশ সেই অসহায় মাকে আবার বাড়িতে তুলে দিয়ে আসে। ওহ! কি নির্মমতা। কত কষ্ট, কত ব্যাথা বেদনা বুকে আগলে মা এই সন্তানটাকে মানুষ করেছে। আর সে কি না মা’টাকে গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল! এই করোনাকালে আরও কত ঘটনা দেখছি আর শিহরিত হয়ে উঠছি। আমাদের বুঝি মানবিকতা একবারেই শেষ হয়ে গেল! 

আরও একটি ঘটনা এমন দেখেছি এক অসহায় মা যিনি হাঁটতেও পারেননা ওই বৃদ্ধা মাকে সন্তান বাঁশ ঝোপের মধ্যে ফেলে দিয়েছে। আরেক আশিতিপর অন্ধ বৃদ্ধা মাকে সন্তানরা রেখেছেন গোয়াল ঘরে। এমন অমানবিক দৃশ্য দেখছি আর ভাবছি এই করোনাকালে আমার মায়ের যদি করোনা হতো আমি কি তাকে ফেলে দিতাম? না, কখনো না। জীবন মৃত্যু যিনি সৃষ্টি করেছেন তার হাতেই রয়েছে। ভুমিষ্ঠ হওয়ার আগ থেকে সন্তানের জন্য মায়ের ফোঁটা ফোঁটা যে ঘাম ঝরেছে শতবার মারা গেলেও সে ঘামের ঋণ শোধ হবে না। যে সন্তানটি মাকে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন সেই সন্তানকে যদি ছোটবেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিতেন তাহলে কী হতো। এই সুন্দর পৃথিবীর আলোর মুখ দেখতেন না। নিজের সন্তানের পিতা হওয়ার সৌভাগ্য হতো না। সুতরাং প্রশ্নহীনভাবে মায়ের সেবা করতে হবে। মাকে দূরে সরিয়ে করোনা হয়েছে বলে বাঁশ বাগানে ফেলে আসবে এটা কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এমন অমানবিক বাংলাদেশ হয়ত আমরা কামনা করি নাই। কিন্তু আমাদের চোখের সামনে এসব ঘটছে। এরচেয়ে মানবিকতার বিপর্যয় আর কি হতে পারে। 

আমি মনে করি পৃথিবীর সব মায়েরাই আমার মায়ের মতো। যাদের অন্তর ভালোবাসায় ভরপুর। কিন্তু সব সন্তানেরা মায়ের উপযুক্ত নয়। যদি হতো তাহলে তারা মাকে অবহেলা করতো না। মায়ের জন্য নিজের পিঠটা বিছিয়ে দিত যাতে মা সেই পিঠের উপর দিয়ে খাট থেকে নামতে পারে। করোনার চেয়েও ভয়ঙ্কর কিছু আসলেও কেউ মাকে ফেলে দিতে পারে না। কারণ যে শরীরটা নিয়ে চলাফেরা করছে, মায়ের গায়ে হাত তুলছে সে দেহটা মায়েরই দেওয়া। সুতরাং দান করা জিনিষ নিয়ে বাহাদুরি করা শুধু অন্যায় নয়, অনেক বড় একটা অপরাধ। সুতরাং বলবো যারা মায়ের গায়ে হাত তুলে, ঘর থেকে বের করে দেয় তাদের সমাজ থেকে বয়কট করা উচিত। আজকের বিশ্ব মা দিবসের অঙ্গীকার হোক অবহেলা নয় মা’ই হবে ভালোবাসার প্রতিক।

এসি
 


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি