মন চলো রূপের নগরে
প্রকাশিত : ১৬:৪৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১২:০৪, ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭
বাংলাদেশের মানুষের কাছে সাহিত্য ও সংস্কৃতির রাজধানী হিসেবে পরিচিত কুষ্টিয়া জেলা। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত কুষ্টিয়া জেলা শিল্প সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে বাংলাদেশকে করেছে সমৃদ্ধ। এখানে জন্ম গ্রহণ করেছেন বাউল সম্রাট লালন, সুরকার ও কবি আজিজুর রহমান, কবি দাদ আলী, লেখিকা মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, আবু জাফরসহ বহু বিখ্যাত ব্যাক্তিত্ব। প্রতিবছর ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এখানে ছুটে আসেন হাজারো পর্যটক।
ভ্রমণ পিপাসুদের কাছে কুষ্টিয়ার বিশেষ আকর্ষণ বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের মাজার। তিনি এই কুষ্টিয়া জেলায়-ই জীবন কাটিয়েছেন। তার মাজার বর্তমানে বাউলদের আখড়া হিসেবে পরিচিত। লালন ভক্তের কাছে তাই অঞ্চলটি পুণ্যভূমি হিসেবে পরিচিত।
শিলাইদহ কুঠিবাড়ি
বহুদিন ধরেই মনে বড় ইচ্ছে ছিল রূপের নগর কুষ্টিয়া ভ্রমণের। তাই ঢাকা থেকে রওয়ানা হলাম। আমরা প্রথমে যাই শিলাইদহের কুঠিবাড়ি। কুঠিবাড়ি রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত স্থান। এখানে কবিগুরু অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। কবিপ্রেমীরা এখানে এসে কবির বহু স্মৃতি সম্পর্কে জানতে পারবেন। এটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
কুষ্টিয়া শহরের একপাশে অবস্থিত ঘোড়ার ঘাট পার হয়ে রিক্সা/ভ্যান/অটোযোগে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি পৌছানো যায়। ঘোড়ার ঘাটের অন্য পাড় হতে কুঠিবাড়ি পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ৩৫ মিনিট।
৩২ বিঘা জমি নিয়ে শিলাইদহ কুঠিবাড়ি আঙিনা। আড়াইতলা এ বাড়িটিতে রয়েছে ১৭টি কক্ষ। বাড়িটির কক্ষ ও বারান্দাজুড়ে প্রদর্শনীর জন্য রয়েছে কবির ব্যবহৃত ১টি পালঙ্ক, লেখার টেবিল, ইজি চেয়ার, নদীতে চলাচলের দুটি বোট `চঞ্চল`-`চপলা`, ৬ বিহারা ও ৮ বিহারার ২টি পালকি, লোহার সিন্দুক ১টি, খাজনা আদায়ের টেবিল ১টি, রোলার ১টি, আটকোনা টেবিল ১টি, গদি চেয়ার ২টি, সোফা ২টি, আলনা ১টি, কাঠের আলমিরা ৪টি, ফাইল কেবিনেট ১টি ঘাষকাটা যন্ত্র, পানি শোধন যন্ত্র ১টি, বিভিন্ন সময়ে কবিকে ঘিরে তোলা আলোকচিত্র, কবির নিজের আকা ছবি ইত্যাদি।
মশাররফের বাস্তুভিটা
আমরা সেখান থেকে গেলাম মীর মশাররফ হেসেনের বাস্তুভিটায়। কুষ্টিয়া শহরের অদূরে লাহিনীপাড়াতে মীর মশাররফ হেসেনের বাস্তুভিটা অবস্থিত। মীর মশাররফ হেসেনের ঘর-বাড়ি কিছুই নেই, আছে শুধু পৈত্রিক ভিটে। কুষ্টিয়া শহর থেকে রিক্সাযোগে সেখানে যাওয়া যায়। সময় লাগে প্রায় ৩০ মিনিট। আমরা কুঠিরবাড়ি হয়ে সেখানে গিয়েছি ব্যাটারিচালিত অটোতে করে।
লালন শাহের মাজার
মশরারফ হোসেনের বাস্তুভিটা থেকে গেলাম বাউল সম্রাট মরমি সাধক গুরু লালন ফকিরের মাজারে। ১৭ শতকের দ্বিতীয় ভাগ থেকে বাউল মতের উন্মেষ ঘটলেও এই মত ও পথকে জনপ্রিয় করে তোলেন মরমি সাধক গুরু লালন ফকির। বাউল সম্রাট লালন ফকিরই বাউল ধারণার একটি স্বতন্ত্র ধর্ম সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কথা ছিল কুষ্টিয়া নেমে প্রথমে হোটেল যাবো। তারপর বিশ্রাম ও খাওয়া-দাওয়া। এরপর ঘুম। পরদিন সকালে সোজা সাঁইজীর মাজারে যাবো। কিন্তু কিছু অনিবার্য বাস্তবতায় সেটি আর হয়ে উঠেনি। এর একটি কারণ হচ্ছে আমরা ট্রেনে গিয়েছি। রাতের ট্রেনে গেলে পোড়াদহ নামিয়ে দিবে রাত ২টায়। তখন কুষ্টিয়া শহরে যাওয়া কষ্টকর। তাই ওখানেই রাত্রি যাপন করতে হয়েছে। অপরদিকে লালন উৎসবের সময় এ এলাকায় পর্যটকের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। তাই হোটেলও পাওয়া কষ্টকর। তবে আমরা পেয়েছিলাম কিন্তু সে জন্য ভাড়া গুনতে হয়েছে বেশি। সাধারণ সময় হোটেল দুই বেড পাওয়া যায় চারশ’ টাকার মধ্যে। এ সময় তা আটশ’ নেওয়া হয়।
যাই হোক- ফিরে আসি লালন শাহর মাজারে। তার মাজার প্রাঙ্গণে যাওয়ার আগেই মনে মনে বেজে উঠল লালনের গান। তারপর তো একের পর এক গান চলে। গলা ছেড়ে না গেয়ে থাকতে পারলাম না। ভ্যানে করে গান গাইতে গাইতে চলে আসি সাইজির আখড়ায়।
মাজার গেটের সামনে নেমেই ডানপাশে ছোট্ট একটা বাজার লক্ষ্য করলাম। প্রায় সব দোকানেই একতারা, দোতারা, লোকজ বাদ্যযন্ত্রের সমাহার। ভাবছিলাম আগে কিছু কিনব কিনা। শেষে ঠিক করলাম আগে গুরুর মাজার দেখা তারপর কেনাকাটা।
গেট দিয়ে মাজার প্রাঙ্গণে প্রবেশ করতেই আপনা-আপনিই একটা শ্রদ্ধাবোধ কাজ করছিল নিজের মধ্যে। চারদিক পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বেশ গোছালো। সামনে মাজার যেখানে চিরনিদ্রায় শায়িত আছে মরমী সাধক গুরু লালন সাঁইজী। আরও কিছু সমাধী। বেশকিছু লালনভক্ত চেখে পড়ল। দর্শনার্থীদের কাছ থেকে যে বকশিস পায় তা দিয়েই তাদের চলে।
মাজারের পাশে রয়েছে অডিটরিয়াম। বেশ উন্নত। পাশে একটা পাঠাগার ও জাদুঘরও রয়েছে। জাদুঘরে বেশকিছু লোকজ সংগ্রহশালার নিদর্শনসহ রয়েছে লালন ফকিরের ব্যবহৃত একটি একতারা।
আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন লালন উৎসব চলছিলো। সমাধির বাইরে বিশাল জায়গা নিয়ে চলছে লালন মেলা। ভক্তদের উপস্থিতি প্রচুর। স্টেজে চলছে গান। আমরা রাতে সেখানে গান শুনে আবার ফিরে আসলাম হোটেলে।
রাতেই টিকেট কেটে রাখলাম বাসের। ঢাকায় আসার অসংখ্য গাড়ি আছে মজমপুর নামক স্থানে। সেখানেই আবাসিক হোটেলগুলো গড়ে উঠেছে।
হার্ডিঞ্জ ব্রিজ
তবে যারা কুষ্টিয়া বেড়াতে আসবেন তারা একটু সময় হাতে নিয়ে আসবেন। কারণ বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু, পাকশী রেল সেতু কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় অবস্থিত। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সেতুর একটি স্প্যান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানের গোলায় ধ্বংস হয়ে যায়। কুষ্টিয়া এলে ইতিহাসের সাক্ষী এই রেলসেতুটি একবার স্বচক্ষে দেখে যেতে ভুলবেন না।
রয়েছে লালন শাহ সেতু। বাংলাদেশের একটি গুরত্বপূর্ণ সেতু। সেতুটি কুষ্টিয়া জেলার পদ্মা নদীর উপর অবস্থিত। সেতুটি বাংলাদেশ ও জাপান যৌথভাবে নির্মাণ করে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়
বাংলাদেশের ইসলামী শিক্ষার সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। স্বাধীনতার পর মুক্ত বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত প্রথম সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্ত বাংলা ভাষ্কর্যটি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে-ই অবস্থিত। কুষ্টিয়া শহর থেকে যশোর/খুলনা অভিমুখী যেকোন বাসে উঠলেই ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে নামা যাবে। পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা। বিশাল জায়গা নিয়ে প্রতিষ্ঠিত বিশ্ববিদ্যালয়টি একবার ঘুরে দেখতে দেখলাম। শিক্ষাঙ্গনের পরিবেশ আমাদের মুগ্ধ করে।
শাহী মসজিদ
কুষ্টিয়ার আরও একটি দৃষ্টিনন্দন ঐতিহ্য শাহী মসজিদ। মোঘল আমলে নির্মিত এ মসজিদটি এই অঞ্চলের ধর্মীয় ঐতিহ্যের প্রতীক। কুষ্টিয়া শহর থেকে ঝাউদিয়া অভিমুখী মিনিবাস চলাচল করে। মিনিবাস থেকে ঝাউদিয়া বাজারে নেমে পাঁচ-সাত মিনিট পথ হাঁটলেই শাহী মসজিদ। পৌছাতে সময় লাগে প্রায় ১ ঘন্টা।
পাঠক কুষ্টিয়া আসলে এসব স্থানগুলো দেখতে ভুল করবেন না। সেই সঙ্গে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফি মালাইতো আছেই। অসাধারণ স্বাদের এ মালাই একটি খেলে আরও খেতে ইচ্ছে জাগবে। আসার সময় বাড়ির সবার জন্য নিয়ে আসতে পারেন কুষ্টিয়ার বিখ্যাত তিলের খাজা।
আরও বলে রাখি। কুষ্টিয়ায় বেশকিছু মিষ্টির দোকান আছে। মজাদার এসব মিষ্টির দোকানে ঢুকে মিষ্টির স্বাদটাও নিতে পারেন। স্থানীয়দের মুখে শোনা যায়, লালন একটি মিষ্টি খেতে পছন্দ করতেন। নাম ‘প্যারা’। যা এখনও পাওয়া যায়। খেয়ে দেখতে পারেন। তবে ভালো মিষ্টির দোকান থেকে চিনে খেতে হবে। এজন্য স্থানীদের কাছ থেকে শুনে নিতে পারেন কোন দোকানের মিষ্টি বেশি ভালো।
আমরা খুব সকালে নাস্তা খেয়ে বাসে উঠে বসলাম। ঠিক সময় বাস ছেড়ে দিলো। দুই পাশের প্রকৃতি আমাদের বিদায় জানালো। অপরূপ সবুজের এই প্রকৃতি আপনার চেখের কোন ক্লান্তি আনবে না। দুপুরের মধ্যে পৌছে গেলাম ঢাকায়।
কীভাবে যাবেন
ঢাকার কমলাপুর রেলষ্টেশন থেকে যমুনা সেতু হয়ে কুষ্টিয়া ট্রেনযোগে ভ্রমণ করা যায়। এই রুটের ট্রেনগুলোর মধ্যে চিত্রা, তূর্ণা ও সুন্দরবন এক্সপ্রেস এর মধ্যে অন্যতম। ঢাকা থেকে ট্রেনে পোড়াদহ। সেখান থেকে অটো বা সিএনজিতে কুষ্টিয়া শহর। এরপর রিক্সাযোগে যাওয়া যায় লালনের মাজারে। সময় লাগে প্রায় ১৫ মিনিট। তবে বাসেও যাওয়া যায়।
//এস//এআর
আরও পড়ুন