মশক নিয়ন্ত্রণে একজন হবীবুল্লাহ বাহার
প্রকাশিত : ১৩:৪৬, ১৮ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১১:৩৫, ১৯ আগস্ট ২০২১
করোনা মহামারির মধ্যে দেশে আরেকটি আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। যা দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ ধারণ করছে। এমন পরিস্থিতিতে একজন হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর কথা মনে পড়ছে।
তৎকালীন নোয়াখালী তথা এখনকার ফেনী জেলায় ১৯০৬ সালে জন্মগ্রহণকারী প্রয়াত হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী পাকিস্তান আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলনসহ ক্রীড়া ক্ষেত্রে যথেষ্ট সক্রিয় থাকায় ফেনীর পরশুরাম আসন থেকে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন। ভারত বিভাগের পর ১৯৪৭ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বাস্থ্যমন্ত্রী হয়ে মশক নিয়ন্ত্রণের কাজকে পৌরসভা থেকে আলাদা করে মশক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করেন।
ঢাকার বকশীবাজারের ঢাকেশ্বরী মন্দিরের উল্টো দিকের পুকুরপাড়ে (দৈনিক আজাদ পত্রিকার পূর্ব পাশে) মশক নিয়ন্ত্রণের মূল অফিসটি অবস্থিত ছিল। দৈনিক কম-বেশি ১০০-১২৫ জন মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মীর মাধ্যমে সেখান থেকে স্প্রে মেশিন ও জারে করে মশা নিয়ন্ত্রণের তৈলাক্ত ওষুধ সংগ্রহ করে নগরীর প্রতিটি ইউনিয়নে (বর্তমানে ওয়ার্ড) ছিটানো হতো। তৎকালীন ১২-১৫ লাখ মানুষের বসবাসের প্রাদেশিক রাজধানী ঢাকা তথা আজকের পুরান ঢাকার অলিগলির নর্দমা আর বাসা-বাড়িতে প্রবেশ করে সপ্তাহে ন্যূনপক্ষে একবার করে ওষুধ দিত। ময়লা-আবর্জনার ভাগাড়ে ব্লিচিং পাউডার ছিটিয়ে মশা উৎপাদন বন্ধে কাজ করত। অনেক সময় বিমানের মাধ্যমে পূর্ব সতর্কতা রেডিওতে প্রচার করে মশার ওষুধও ছিটিয়ে দিত। সেই সময় মশাবাহিত মরণব্যাধির অস্তিত্বও ছিল না। ফলে মশারি ব্যবহারে অনভ্যস্ত পুরান ঢাকায় মানুষ স্বস্তি পেত। আশ্চর্যজনকভাবে প্রাদেশিক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান ক্রীড়া ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী নগরী থেকে মশাতঙ্ক দূর করেছিলেন।
যক্ষ্মা বিরোধী অভিযান ও মশক নিবারণী আন্দোলন সফলতার জন্য মুহম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার চিরদিন ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। কোলকাতা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের সাবেক অধিনায়ক এই মানুষটি কথা কম বলতেন, কাজ করতেন বেশি।
আসলে ঐতিহাসিকভাবেই ঢাকা মশার জন্য পরিচিত ছিল। মশার যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ হয়ে মুঘলরা বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ সরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এছাড়া, ইংরেজ শাসনামলে ঢাকার পুরানা পল্টন এলাকায় তাদের যে ক্যান্টনমেন্টে ছিল সেটি মূলত ব্যবহৃত হত বেয়ারা সৈনিকদের পানিশমেন্ট পোস্টিং হিসেবে। ওই সময় সমগ্র ভারতবর্ষে যত বেয়াড়া সৈনিক ছিল, তাদেরকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেয়া হত এবং তারা মশার কামড় খেয়ে সোজা হয়ে যেত।
যাই হোক, কালক্রমে ব্রিটিশরা চলে গেল, পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি হল, ঢাকা হলো পূর্ব বাংলার রাজধানী। নতুন দেশের নতুন রাজধানীতে লোকজন বসতবাড়ি করতে শুরু করল। ভারত থেকে লাখ লাখ মুসলমান এসে ঢাকাতেই উঠল। কিন্তু মশার যন্ত্রণা কমল না বিন্দুমাত্র।
আর সেই সময় পূর্ব বাংলার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ পেলেন ফেনী জেলার কৃতিসন্তান হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরী। তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশ হাজারের মতো মশার ওষুধ ছিটানোর মেশিন আনালেন (ব্রাশের তৈরি এই মশার ওষুধ ছেটানোর লম্বা টিউব আকৃতির যন্ত্রগুলো ১৯৮০-৯০ সাল পর্যন্ত ঢাকা শহরে দেখা যেত)।
শুধু তাই নয়; রাস্তার পাশে গভীর ড্রেন খনন করলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিক করলেন, শহরের সবগুলো পুকুর, খাল, ডোবা পরিষ্কারের ব্যবস্থা করলেন। আর সবচেয়ে বড় কথা হলো, ইস্পাহানীর সহায়তায় মশার ওষুধ ছিটানোর উপযোগী দুইটি বিমান পর্যন্ত ক্রয় করার ব্যবস্থা নিলেন।
ওই সময় প্রত্যেকদিন ঢাকা শহরকে অন্ততঃ একবার ধুঁয়ে পরিষ্কার করা হত। পঞ্চাশের দশকে মাত্র দুই বছরের মধ্যে তিনি ঢাকার মশাকে এমনভাবে নিধন করতে সক্ষম হলেন, তার মৃত্যুর পর আরও ১০ বছর পর্যন্ত ১৯৭৫/৭৬ সালেও ঢাকা শহরের মানুষ মশারি না টানিয়ে ঘুমাতে পারত।
বর্তমানে ডেঙ্গু মশার এই উদ্বেগজনক আক্রমণে প্রয়াত হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর অনুসৃত পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে পৃথক মশক নিধন অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে সিটি করপোরেশনকে এই ভারমুক্ত করা গেলে সার্বিকভাবে মশক নিধন গতিশীল হতে পারে। জনমনে মশাতঙ্ক দূর করা সিটি করপোরেশন ও তদীয় ওয়ার্ড কমিশনারদের মাধ্যমে অর্থ ব্যয় ছাড়া ইতিবাচক ফল লাভ করা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিষয়টি জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিধায় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করে, মশা নিয়ন্ত্রণ বা নিধনের জন্য হবীবুল্লাহ বাহার চৌধুরীর নীতি অনুসরণ করে পৃথক অধিদপ্তর সৃষ্টি করে ক্র্যাশ প্রোগ্রাম গ্রহণ যুক্তিযুক্ত হতে পারে। এক্ষেত্রে দুই সিটি করপোরেশনে কর্মরত প্রায় ৭০০ স্প্রে ম্যানকে উক্ত অধিদপ্তরে সংযুক্ত করাও সহজতর। জনসংখ্যা বৃদ্ধি, বৈষ্ণিক আবহাওয়ার পরিবর্তন, নতুন নতুন মরণব্যাধির উন্মেষ এবং জনস্বাস্থ্যের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনায় এনে এখন থেকেই কার্যকর ও আধুনিক ফলপ্রসূ উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। না হলে আগামীতে মশাবাহিত বিভিন্ন মরণব্যাধি মহামারি আকারে দেশকে গ্রাস করতে পারে।
উল্লেখ্য, ১৯০৬ সালে ফেনী জেলার পরশুরাম থানার গুতুমা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার। বাবার নাম মুহম্মদ নুরুল্লা চৌধুরী ও মাতার নাম আসিয়া খাতুন। এক ভাই এক বোনের মধ্যে বাহার বড়। আর একমাত্র বোন শামসুন্নাহার মাহমুদ ছোট।
বাহারের নানা খান বাহাদুর আবদুল আজিজ বি এ ছিলেন একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব। চট্টগ্রামে মিউনিসিপাল স্কুল থেকে বাহার ১৯২২ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন। তিনি পড়ালেখায় যেমন মেধাবী ছিলেন, তেমনি খেলাধুলায় পারদর্শী ছিলেন। স্কুল ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন হন শৈশবেই। তিনি চট্টগ্রাম কলেজ থেকে ১৯২৪ সালে আইএসসি পাশ করে মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন। কিন্তু অল্পদিন পর পুনঃ চট্টগ্রাম কলেজে বি, এ ক্লাসে ভর্তি হন। সেখানেও খেলাধুলায় সফলতার জন্যে কলেজ টিমের ক্যাপ্টেন হন। স্কুল জীবনে বন্ধুরা মিলে ‘হাতে লেখা’ পত্রিকা বের করতেন। সাহিত্যের প্রতি অসম্ভব আকর্ষণ ছিল তার। কলেজ ম্যাগাজিনের সম্পাদক ছিলেন তিনি।
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম খুব ভালবাসতেন বাহারকে। ১৯২৬ সালে বাহারের নিমন্ত্রণে কবি নজরুল চট্টগ্রামে তাদের বাড়ি তামাকুমুন্ডীর আজিজ মঞ্জিলে বেড়াতে আসেন। সেখানে ছিলেন অনেকদিন। তারপর ১৯২৯ সালে কবি নজরুল দ্বিতীয়বার বাহারদের বাসায় বেড়াতে আসেন। এ বাড়িতে বসে কবি লিখেছেন অনেক কবিতা আর গান। ‘সিন্ধু হিন্দোল' ও ‘চক্রবাক' বই দুটির কবিতাগুলো এখানে লিখেন। সিন্ধু হিন্দোল বইটি কবি উৎসর্গ করেছেন বাহার ও তার ছোট বোন নাহারকে।
বাহার ১৯৩৯ সারে সিরাজুদ্দৌলা স্মৃতি কমিটির সহ-সভাপতি, ১৯৪০ সালে লাহোর মুসলিম লীগ কনফারেন্সে যোগদান, বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সম্পাদক, ১৯৪৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান রেঁনেসা সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, ৪৪ সালে বেঙ্গল লেজিসেলেটিভ কাউন্সিলের মেম্বার, বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রচার সম্পাদক ছিলেন।
সমস্ত দেশ জুড়ে ১৯৪৬ সালে হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বাঁধার পর বাহার মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে নোয়াখালী সফর করেন। আর জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মহাত্মা গান্ধীসহ সর্বত্র বিচরণ করেন। তিনি ১৯৪৫-৪৬ সময়ে বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির যুগ্ম-সম্পাদক, ১৯৪৩ সালে সাধারণ নির্বাচনে বিপুল ভোটাধিক্যে বেঙ্গল লেজিসেলেটিভ এসেম্বলির সদস্যপদ লাভ এবং কলকাতা পোর্ট হজ্ব কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর মুহম্মদ হবীবুল্লাহ বাহার পূর্ব পাকিস্তান সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালে ঢাকায় পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য সম্মেলনে অভ্যর্থনা সমিতির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ সালে জেনেভা এবং কায়রোর বিশ্বস্বাস্থ্য সম্মেলনে সভাপতি ও সহ-সভাপতির আসন অলংকৃত করেন।
তিনি ফেনী পরশুরাম এলাকা থেকে বঙ্গীয় আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ছ’মাস পর পাকিস্তান গণপরিষদে প্রস্তাব ছিল ইংরেজির সঙ্গে উর্দুও হবে পাকিস্তান গণ-পরিষদের সরকারি ভাষা। ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সংশোধনী প্রস্তাব দেন, বাংলাকেও গণপরিষদের সরকারি ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির। হবীবুল্লাহ বাহার প্রস্তাবটি সমর্থন করার জন্যে অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্পোর্টস ফেডারেশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৫৩ সালে হবীবুল্লাহ বাহার হৃদরোগে আক্রান্ত হলে মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দেন এবং রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। এরপর তিনি সাহিত্যচর্চা ও সমাজকর্মে নিয়োজিত ছিলেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ পাকিস্তান, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ওমর ফারুক, আমীর আলী।
১৯৬৬ সালের ১৫ এপ্রিল তিনি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
এসএ/