মহিউদ্দিন শামীম: শেখ হাসিনার জীবন বাঁচাতে গিয়ে প্রথম শহীদ
প্রকাশিত : ১২:০৪, ২৪ জানুয়ারি ২০১৮
এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়- কবি হেলাল হাফিজের এই মন্ত্রে বিশ্বাসী হয়েই সেদিন রাজপথে নেমেছিলেন টগবগে তরুণ মহিউদ্দিন শামীম। আজকের এই দিনে (১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে চট্টগ্রামে যারা নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন তাদের মধ্যে শামীম ছিলেন প্রথম। সময় গড়িয়ে যায়। ক্যালেন্ডার পাল্টায়। দেশে গণতন্ত্র কায়েম হয়। কিন্তু বিস্মৃতির অন্তরালে যেন হারিয়ে যায় মহিউদ্দিন শামীম ও তার মত অনেকেই।
ফিরে দেখা ২৪ জানুয়ারি
১৯৮৮ সালের ২৪ জানুয়ারি। এদিন অন্যদিনের মত সকাল হয়, দুপুর হয়। তবে রোদের ঝাঁঝ ছিল বেশি। মানুষের মধ্যে ছিল তীব্র উত্তেজনা। কারণ চট্টগ্রামে লালদিঘী ময়দানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা স্বৈরাচার বিরোধী সমাবেশ করছেন। লোকমুখে শুনা যাচ্ছে পুলিশ বাধা দিবে। ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে কোনো বাধা তাদের দমিয়ে রাখতে পারবে না।
হাজার হাজার নেতাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে এয়ারর্পোট থেকে নিউমার্কেট হয়ে কোর্ট বিল্ডিং যাচ্ছিল শেখ হাসিনার গাড়িবহর। এর মধ্যেই পথে পথে চলছিল বিডিআরের সঙ্গে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। শেখ হাসিনার গাড়িকে নিরাপদে কোতয়ালী মোড় পার করে দেওয়ার জন্য দারুল ফজল মার্কেটের সামনে মানব বেষ্টনী তৈরি করে সীতাকুণ্ড ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ। তাদের দুজন হলেন সীতাকুণ্ড কলেজ ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মহিউদ্দিন শামীম ও অমল কান্তি দাশ। কৃষ্ণ কুমারী স্কুলের দেয়াল থেকে বিডিআর গুলি চালায়। প্রথম দফা গুলির একটি নি:শব্দে উপরের চোয়াল দিয়ে ঢুকে মাথার পিছন দিয়ে কিছু মগজ নিয়ে বের হয়ে যায়। মাটিতে ঢলে পড়া শামীমকে ধরতে যান অমল দাশ। কিন্তু দ্বিতীয় গুলিটি তার চিবুক হয়ে বাম চোয়ালের একটি অংশ ছিঁড়ে বেরিয়ে যায়। অমল জ্ঞান হারালেও সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুর কোলে ঢরে পড়েন মহিউদ্দিন শামীম।
স্বপ্ন পূরণ হলো না বিধবা মায়ের
মহিউদ্দিন শামীম বাবাকে হারিয়েছিলেন ছোট বেলায়। তিন বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে শামীম ছিলেন প্রথম। বাবার মৃত্যুর পর অনেক কষ্টে মা পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে একটি চাকরি যোগার করেছিলেন। টেনেটুনেই চলছিল সংসার। মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলে বড় হয়ে সংসারের হাল ধরবে। শামীম সংসারের হাল ধরার সুযোগ পাননি। শুয়ে আছেন সীতাকুণ্ড পৌরভবনের পিছনে লাল ইট ঘেরা কবরে।
মায়ের স্বপ্ন খুন ও এক জীবন লড়াই
ওইদিন শামীম নয়, তার আত্মীয় স্বজনদের ভাষ্য অনুযায়ী খুন হয়েছিল একটি পরিবারের স্বপ্ন। এ প্রতিবেদনটি লিখার সময় অনেক চেষ্টা করেও তার সদ্য আমেরিকা প্রবাসী মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে তার মামা সাবেক ছাত্রনেতা শাহেন শাহ কিছুটা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, আমরা এসব নিয়ে কথা বলতে চাই না। সন্তান হারালে আমার বোন হারিয়েছে। এ যন্ত্রনা আর কেউ বুঝবে না।
কথা হচ্ছিল মহিউদ্দিন শামীমের সঙ্গে কলেজ ছাত্রলীগের কমিটিতে সভাপতি পদে থাকা ও ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী (পরবর্তীতে উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও বতর্মানে সীতাকুন্ড উপজেলা আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক) জাহাঙ্গীর ভুঁইয়ার সঙ্গে। আবেগ প্রবণ হয়ে তিনি বলেন, ‘মহিউদ্দিন শামীমের মা সন্তান হারানোর পর নেত্রী (শেখ হাসিনা) তাকে সান্ত্বনা দিতে এসেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীতে স্থানীয় নেতারা উদ্যোগ নিয়ে পরিবারটির কোনো সাহায্য করতে পারেনি। পারেনি কোনো ধরনের মূল্যায়ন বা স্বীকৃতি দিতে।’
একটি মূল্যায়ন
মহিউদ্দিন শামীম ছিলেন ছাত্রলীগ নেতা। তিনি যখন রাজপথে প্রাণ দিচ্ছিলেন তখন আওয়ামী লীগের এমন সুসময় ছিলো না। শামীম প্রাণ দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও আজকের প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে প্রাণে বাচানোর জন্য। মহিউদ্দিন শামীমের মত সেদিন চট্টগ্রামে অসংখ্য তরুণ প্রাণ দিয়েছিলেন। যদিওবা পুলিশ চব্বিশ জনের তালিকা প্রকাশ করেছে। কিন্তু প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য অনুযায়ী সেদিন সাধারণ মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অনেক লাশ পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল।
১৯৮১ সালের ১৭মে শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পর থেকে এ পর্যন্ত তাকে হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে মোট ১৯বার। এর মধ্যে এরশাদ আমলে চেষ্টা করা হয়েছে দুই বার। ২৪ জানুযারির হামলাটি ছিল প্রথম হামলা। আর মহিউদ্দিন শামীম ছিলেন সেই হামলায় প্রথম শহীদ। দল এখন ক্ষমতায়। অসংখ্য নেতার ভিড়ে শামীমদের আত্মত্যাগের কথা আজ অনেকেই ভুলে গেছেন। নিজের জীবন দিয়ে সেদিন যারা ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন তাদের জন্য আমাদের শ্রদ্ধা।
/ এআর /