মহিলা পরিষদের ৪৯ বছরের পথচলা
প্রকাশিত : ১০:৫১, ৪ এপ্রিল ২০১৯ | আপডেট: ১২:২৩, ৪ এপ্রিল ২০১৯
আমাদের ভাষা আন্দোলন, সামাজিক সংস্কারসহ সব প্রগতিশীল আন্দোলনের প্রাথমিক প্রস্তুতি পর্বের এক অনন্য সফল সংযোজন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের প্রতিষ্ঠা। দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলনের মধ্যে দেশপ্রেমের উদ্দীপনায় গড়ে ওঠা নবীন-প্রবীণদের অনবদ্য সংগঠন তার ৪৯তম জন্মদিনে পা রাখতে যাচ্ছে। আজ ৪ এপ্রিল এই সংগঠনের জন্মদিন।
সমাজে মানুষে মানুষে সমতা, নারী-পুরুষের সমতাবৈষম্য ও নিপীড়নহীন মানবিক মর্যাদাপূর্ণ জীবন প্রতিষ্ঠাই ছিল এই সংগঠনের মূল লক্ষ্য। দেশের আর্থ-সামাজিক সমস্যা সমাধানের দাবি, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ও নারীদের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সনদ বাস্তবায়নের দাবিতে শুরু থেকেই নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের সংগঠিত প্রয়াস অনন্য একটি নতুন সংযোজন। সমাজ প্রগতির গণতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ, অর্থনৈতিক ও নারীমুক্তির জন্য এরা প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরুদ্ধে দৃঢ়তার সঙ্গে রুখে দাঁড়িয়েছে।
দেশে যখন সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় রাজনৈতিকভাবে একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টির প্রচেষ্টা চলছে, ঠিক তখনই নারীর প্রতি সহিংসতা, নারী-শিশু ধর্ষণ, খুন, নারী নির্যাতন, উত্ত্যক্তকরণ, যৌন হয়রানির মাত্রা বেড়েছে, যা সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য মোটেও শুভ ও কল্যাণকর নয়। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আইন প্রণয়ন ও তার যথাযথ প্রয়োগ এবং সাইবার ক্রাইম থেকে তরুণ-তরুণীদের রক্ষা করার জন্য নতুন মূল্যবোধের সংস্কৃতি গড়ে তোলা, যা এখন সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। যদিও আইন প্রণয়নই শেষ কথা নয়। তার জন্য প্রয়োজন সমাজ, রাষ্ট্রে ও পরিবারে তার সঠিক ব্যাখ্যা এবং চর্চা। প্রয়োজন সচেতন পদক্ষেপ, যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত, ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা, নারী-পুরুষের সমতার সংস্কৃতি এবং উপযুক্ত শিক্ষার অবাধ সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। মহিলা পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে এ দেশে নারী নির্যাতন বন্ধে পারিবারিক সহিংসতা বিল ২০১০ পাস হওয়ার দাবিতে ক্রমাগত আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে। জাতীয় সংসদে সেই বিল পাস হওয়া তার সফল পরিসমাপ্তি। আমরা জানি, নারীর মৌলিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম প্রধান শর্ত নিরাপদ মাতৃত্ব। এই অধিকার প্রতিষ্ঠিত না হলে নারীর মানবাধিকার পদে পদে বাধাগ্রস্ত হবে, বাধাগ্রস্ত হবে জাতীয় কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি। এই সত্যকে সামনে রেখেই বিভিন্ন আইন ও মানবাধিকার সংগঠন এ লক্ষ্যে নেওয়া নানা কর্মসূচিকে বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে এই অগ্রগতির ক্ষেত্রে একনিষ্ঠ ভূমিকা রেখে চলছে।
নারীদের দৈহিক ও মানসিক নির্যাতন নিয়ে বৈশ্বিক নানা পরিবর্তনের আলোকে প্রয়োজন আজ বিজ্ঞানভিত্তিক আধুনিক গবেষণার। কারণ আমাদের দেশে পরিবার, সমাজ এবং আইনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধের প্রচলিত উপায়গুলো যথেষ্ট কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন, কারণ ক্রমেই বদলে যাচ্ছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর সুবর্ণচরের দুটি ধর্ষণ ঘটনা যা নির্বাচনকেন্দ্রিক। তা নতুন করে ক্ষোভ ও আলোড়ন তৈরি করেছে। যা মোটেই কাম্য নয়।
দেশে ৭২-এর সংবিধান অনুযায়ী অসাম্প্রদায়িক চেতনার পূর্ণ প্রতিষ্ঠা, রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার, যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তির নিশ্চিত ব্যবস্থা, পোশাকশিল্পের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জীবনের নিশ্চয়তা, তাদের বেতন-ভাতা লেবার কোড অনুযায়ী করা, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন, বৈষম্য দূর করা এবং নির্যাতনকারীদের জন্য দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা, জাতীয় স্বার্থে অর্থনীতির চাকা সচল রাখার বিরুদ্ধে নেওয়া সব ষড়যন্ত্র প্রতিহত করা, নারী কৃষি শ্রমিকদের স্বীকৃতি, তাদের কার্ড প্রদান এবং পূর্ণাঙ্গ কৃষি শ্রম আইন প্রণয়ন করা, সচেতন করাসহ কৃষিপণ্য বিক্রির সহায়ক নানা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার জন্য রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা দরকার। তাদের জীবনমান উন্নয়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য মহিলা পরিষদ কাজ করে যাচ্ছে।
আমাদের সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় নানা আইনে নারীর অধিকার স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু বর্তমান আর্থ-সামাজিক ও রাষ্ট্রব্যবস্থার কারণে নারীরা এখনো সাংবিধানিক অধিকার ও আইনানুগ অনেক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। আমাদের সংসদে ৩০টি আসন সংরক্ষিত ছিল নারীদের জন্য, বর্তমানে তা বাড়িয়ে ৫০টি করা হয়েছে। ৫০ জনকে নারী সংসদ সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে, এবারও নারী আন্দোলনের জোরালো দাবি প্রতিষ্ঠা হলো না। প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের সুযোগ না থাকায় সত্যিকার জনপ্রতিনিধি নারী নির্বাচিত হলো না। তাদের জবাবদিহির আওতায় আনা গেল না। এ ছাড়া বিবাহবিচ্ছেদ, অভিভাবকত্ব ও সম্পত্তির উত্তরাধিকারবিষয়ক আইনগুলোতে নারী ও পুরুষের মধ্যে বিরাট ব্যবধান তৈরি করেছে। সরকারকে মনে রাখতে হবে অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়ন এবং সিডও সনদের দুটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা যা সংরক্ষিত, তা প্রত্যাহার এখন সময়ের দাবি। মহিলা পরিষদ মনে করে, স্থাবর, অস্থাবর সব সম্পত্তিতে নারীর পূর্ণ অধিকার প্রতিষ্ঠা না হলে এসডিজি সম্ভব হবে না।
নারীর কর্মসংস্থানের জন্য প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে। নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ আরো বৃদ্ধি করতে হবে। গৃহশ্রমের মূল্যায়ন, কৃষিতে নারীর সামগ্রিক অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া এবং আয় বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে হবে। মজুরিবৈষম্য দূর করতে হবে। বিধবা ভাতা, মাতৃত্বকালীন ভাতা, বৃদ্ধাভাতাসহ বিভিন্ন নিরাপত্তাব্যবস্থার পাশাপাশি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনসহ বহুমুখী কর্মতৎপরতার মধ্য দিয়ে নারীর জন্য বিনিয়োগ বৃদ্ধি করতে হবে। সম্পদ-সম্পত্তিতে সম-অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এসব কিছুর জন্য রাষ্ট্র ও সরকারের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা এবং নীতি থাকতে হবে। নীতিকে আইনে পরিণত করা শুধু নয়, সেই আইন বাস্তবায়নও করতে হবে। নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের মাধ্যমে সংসদে, স্থানীয় সরকার প্রশাসনে নারীর সম-অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করে এই উদ্যোগকে যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।
বর্তমান সময়ে জেন্ডার বাজেট ক্রমান্বয়ে অর্থবহ হয়ে উঠছে। নতুন অর্থবছরে জাতীয় বাজেট সংসদে উত্থাপনের আগে নারীর স্বার্থের জায়গা থেকে অর্থনীতির চলতি প্রবণতা সম্পর্কে এবং বিশেষভাবে করণীয় দিকগুলো নিয়ে প্রতিবারের মতো এক প্রাকবাজেট আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ। মহিলা মন্ত্রণালয় কত বরাদ্দ পাচ্ছে এবং অন্য মন্ত্রণালয়গুলো যেসব বরাদ্দ দিচ্ছে তাতে নারী কতটা লাভবান হচ্ছে, সেটা খতিয়ে দেখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।
মাতৃত্বকালীন ছুটিকে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নের কথা নিরবচ্ছিন্নভাবে শোনা যাচ্ছে। কিন্তু নারীকে ক্ষমতায়িত করতে হলে তাকে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হতে হবে। সেটা করতে হলে সব মন্ত্রণালয়ের সাধারণ প্রকল্পে নারী স্বাস্থ্যের ঝুঁকির বিষয়টি গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনতে হবে। উদ্যোগ নিতে হবে তৃণমূল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়ার। ইদানীং আমাদের দেশে জরায়ু এবং ব্রেস্ট ক্যান্সারের প্রকোপ বেড়েই চলছে। এই রোগ দুটি প্রতিরোধে স্কুলগামী মেয়েদের বিনা মূল্যে প্রতিষেধক টিকা দেওয়ার কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। অভিভাবকদের সচেতন করতে হবে যাতে তারা মেয়েসন্তানদের এই টিকা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী হয়। যারা এরই মধ্যে এই রোগাক্রান্ত হয়ে গেছে তাদের যথাযথ চিকিৎসা, ওষুধ যা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এই ব্যয় হ্রাস এবং সাধারণ মানুষের জন্য চিকিৎসা সুযোগ আয়ত্তে আনার জন্য বাজেটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখার পদক্ষেপ জরুরিভাবে নিতে হবে। নারীর সার্বিক ক্ষমতায়নে ওপরে উল্লিখিত দাবি ও অধিকারের বিষয়ের অগ্রাধিকার তুলে ধরতেই আজ মহিলা পরিষদকে আরো বেশি সক্রিয়, গতিশীল ও শক্তিশালী হয়ে উঠতে হবে। তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত গড়ে তুলতে হবে নতুন প্রজন্মের দক্ষ ও যোগ্য নেতৃত্ব। সেই লক্ষ্যে কাজ করার শপথই হোক মহিলা পরিষদের ৪৯তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর সম্মিলিত অঙ্গীকার।
লেখক : সাংবাদিক ও গণমাধ্যম সম্পাদক, মহিলা পরিষদ
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।