মা-বাবা, বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে
প্রকাশিত : ১২:০১, ২৮ জানুয়ারি ২০২১
আপনি কী একজন শুদ্ধ মানুষ হতে চান? তাহলে পথ চলার ক্ষেত্রে কিছু শুদ্ধাচার মেনে চলুন। আর তা যদি আপনি পারেন, তবে দেখবেন চমৎকার এক জগতে প্রবেশ করেছেন। শুদ্ধ হওয়া বিষয়টি এমন নয় যে এটা আপনা আপনি হয়ে যায়। শুদ্ধ হওয়ার জন্যে আপনাকে এটা চর্চ্চা করতে হবে। এটা অনেকটা ভালো সঙ্গীত শিল্পী বা ক্রীড়াবিদ হয়ে উঠার মতোই। সাফল্যের জন্যে তাদেরকে যেমন চর্চ্চা করতে হয়, শুদ্ধা মানুষ হওয়ার ব্যাাপরেও আপনাকে সেটা করতে হবে।
মা-বাবা, অভিভাবক ও বয়োজ্যেষ্ঠদের সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হবে সে সম্পর্কে জানবো আজ।
- মা-বাবা ও মুরুব্বি/ গুরুজনদের সাথে দেখা হলে আগে সালাম দিন। হাসিমুখে কুশল জিজ্ঞেস করুন।
- যত ব্যস্তই হোন, দিনের কিছুটা সময় তাদের জন্যে রাখুন। আপনার সঙ্গ তাদের আনন্দ দেবে।
- ঘরে ফিরে আগে মা-বাবার সাথে কুশল বিনিময় করুন। তাদের সাথে গল্প করুন, সারাদিন কী কী উল্লেখযোগ্য ও মজার ঘটনা হলো তা বলুন এবং তাদের কাছ থেকেও শুনুন।
- বাইরে বেরোনোর সময় কোথায় যাচ্ছেন বলে যান এবং কোনোকিছুর প্রয়োজন আছে কিনা, আনতে হবে কিনা বা বিশেষ কিছু খেতে ইচ্ছে করছে কিনা তা জেনে নিন।
- বাসায় ফেরার সময় সম্ভব হলে তাদের জন্যে কিছু একটা নিয়ে আসুন। না চাইতে পাওয়ায় তারা খুশি হবেন।
- নিয়মিত তাদের শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিন। অসুস্থ হলে সুচিকিৎসা ও সেবার ব্যবস্থা করুন।
- বয়স বাড়লে মানুষ দ্বিতীয় শৈশবে চলে যায়। তাদের শিশুসুলভ আচরণে অসহিষ্ণু বা ক্ষুব্ধ হবেন না। এ সময় তাদের প্রতি আরো সহনশীল ও সমমর্মী হোন।
- মুরুব্বি/ গুরুজনদের সামনে পায়ের ওপর পা তুলে বসবেন না। তাদের দিকে পা ছড়িয়ে দিয়েও বসবেন না।
- মুরুব্বি/ গুরুজনেরা কথা বলতে এলে সম্মানার্থে উঠে দাঁড়ান।
- অযথা হাত নেড়ে বা আঙুল উঁচিয়ে কথা বলা থেকে বিরত থাকুন। সঙ্গত কারণ না থাকলে সানগ্লাস/ ক্যাপ খুলে কথা বলুন।
- যে-কোনো ভালো কাজে যাওয়ার আগে তাদের দোয়া/ আশীর্বাদ নিন।
- তাদের কাজে সবসময় এগিয়ে গিয়ে সহায়তা করুন।
- বয়োজ্যেষ্ঠ বা সম্মানিত কাউকে মোবাইলে ‘মিসড কল’ দেয়া থেকে সচেতনভাবে বিরত থাকুন।
- সশরীরে সহজেই যাওয়ার সুযোগ আছে-এমন দূরত্বে বয়োজ্যেষ্ঠদের ফোন করে সিদ্ধান্ত জানাবেন না বা কিছু জানতে চাইবেন না।
- বয়োজ্যেষ্ঠদের সাথে কখনো ধমকের সুরে ও মেজাজ দেখিয়ে কথা বলবেন না। তাদের যে-কোনো প্রশ্নের জবাব বিনয়ের সাথে দিন।
- তাদের কথা শোনার ক্ষেত্রে মনোযোগী হোন। বিরক্তি বা অস্থিরতা প্রকাশ করবেন না।
- মা-বাবার মানিব্যাগ বা পার্স থেকে বিনা অনুমতিতে কখনো টাকা নেবেন না।
- মা-বাবার ডায়েরি অথবা মোবাইল ফোন অনুমতি ছাড়া ধরবেন না।
- আপনার সঙ্গে পদ-পদবি বা যোগ্যতার ব্যবধান থাকলেও বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রত্যেককে তার প্রাপ্য সম্মান দিন।
- মা ও অবসরপ্রাপ্ত বাবাকে বিনয়ের সাথে নিয়মিত হাতখরচ দিন।
- মতের অমিল হলেও মা-বাবার সাথে তর্ক করবেন না। বিনয়ের সাথে নিজের অভিমত তুলে ধরুন।
- মুরুব্বি, শিক্ষক, গুরুজন যে স্বরে কথা বলছেন তার চেয়ে উচ্চস্বরে কথা বলবেন না।
- বয়োজ্যেষ্ঠদের মতামতকে গুরুত্ব দিন। সবসময় মনে রাখুন-আপনার ধ্যানধারণা সমকালীন হলেও জীবন ও জগৎ সম্পর্কে তারা আপনার চেয়ে অভিজ্ঞ।
- মুরুব্বিদের সিদ্ধান্ত, উপদেশ, নির্দেশ আপাতত অপছন্দনীয় হলেও তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ বা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবেন না।
- কোনো অন্যায় বা ভুল করতে দেখলে বিনয়ের সাথে তা বুঝিয়ে বলুন, তাদেরকে শুধরে নিতে সাহায্য করুন।
- মা/ বাবা যদি কোনো গুরুত্ব ভুল বা অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে যান (যেমন, মাদকাসক্তি, পরকীয়া, জুয়া ইত্যাদি)-যেখানে আপনার কিছু করার নেই, তা নিয়ে বাসায় হইচই বা বাইরে নিন্দা করবেন না। সুযোগ থাকলে পরিবারের কোনো গুরুজনের সাথে পরামর্শ করুন। নিজে প্রশান্ত থাকুন এবং তাদের জন্যে দোয়া করুন। কিন্তু এ কারণে কোনোভাবেই নিজের জীবন ও ক্যারিয়ারের ক্ষতি করবেন না।
- মা-বাবার যুক্তিসঙ্গত যে-কোনো ইচ্ছাপূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করুন।
- কারো বাসায় বা কোনো অনুষ্ঠানে গেলে প্রবীণদের সঙ্গে নিজেই এগিয়ে গিয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করুন।
- অপেক্ষমাণ যে-কোনো লাইনে বয়োবৃদ্ধদের আগে সুযোগ দিন।
- মা-বাবার সুস্থতা ও দীর্ঘায়ু কামনা করে সবসময় প্রার্থনা করুন।
- গুরুত্বপূর্ণ বা পারিবারিক বিষয়ে তাদের সাথে আলাপকালে আগ বাড়িয়ে কথা বলবেন না।
- মা-বাবা কিংবা ঘনিষ্ঠ অভিভাবক পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়ে থাকলে তাদের মাগফেরাত বা অনন্ত প্রশান্তি কামনা করে সৎকর্মে অংশ নিন, সাধ্যমতো দান করুন। সামর্থ্য থাকলে তাদের নামে একজন - এতিমকে আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ার দায়িত্ব নিন।
- তাদেরকে নিয়ে মাঝেমধ্যে কাছাকাছি আত্মীয়দের বাড়িতে বেড়াতে যান। আর দূরে গেলে তাদের যেন কোনো অসুবিধা না হয় সেদিকে খেয়াল রাখুন।
- ভ্রমণকালে তাদের বার্ধক্যজনিত কোনো শারীরিক বা মানসিক অপারগতা বা অক্ষমতাকে বার বার মনে করিয়ে দেবেন না।
- রাতে ঘুমানোর সময় আগে তাদের ঘুমানোর ব্যবস্থা করে দিন। তারপর নিজেরা ঘুমাতে যান।
- বড় যে-কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে মা-বাবাকে জানান। তাদের পরামর্শ ও দোয়া নিন।
- বাসায় কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করলে তাদেরকেও সম্পৃক্ত করুন।
- সুযোগ পেলেই তাদের সাথে গল্প করুন। সমসাময়িক বিভিন্ন ইতিবাচক বিষয়ে আলাপ করুন কিংবাতাদের সুখস্মৃতি বলতে অনুরোধ করুন।
- স্কুলে/ বাইরে যাওয়ার সময় দাদা-দাদি/ নানা-নানি/ মুরুব্বিদের সাথে দেখা করে দোয়া নিতে সন্তানদের উদ্বুদ্ধ করুন।
- পরীক্ষায় কিংবা কোনো সাফল্যে সন্তানদেরকে বয়োজ্যেষ্ঠদের কাছে বিশেষভাবে দোয়া চাইতে উৎসাহিত করুন।
- খাবার টেবিলে বয়োজ্যেষ্ঠদের নিয়ে একসাথে বসুন। সবার আগে তাদের প্লেটে খাবার উঠিয়ে দিন।
- বাইরে থাকলেও দিনে অন্তত একবার ফোন করে খোঁজখবর নিন।
- তাদেরকে হাসিখুশি রাখতে সাধ্যমতো চেষ্টা করুন। মনের সুখই বার্ধক্যে তাদের দেহের অনেক অসুখকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
- সাপ্তাহিক ছুটির দিনে আপনার ব্যক্তিগত কাজের ফাঁকে তাদের জন্যে সময় রাখুন। তাদের পছন্দের খাবার রান্না করুন বা তাদের নিয়ে বেড়াতে যান। মেলা/ উৎসব/ দাওয়াতে তাদেরকে সঙ্গে নিন। আপনার সান্নিধ্য তাদেরকে সবসময় উৎফুল্ল রাখবে।
- মা-বাবাকে উদ্বুদ্ধ করুন বাসায় একাকী অলস সময় না কাটিয়ে সবার সাথে মিলেমিশে আত্ম উন্নয়নমূলক ও সেবা কাজে শরিক হতে। তাহলে তারা আরো প্রফুল্ল থাকবেন।
- বাসার কারো আচরণে বা কথায় যেন তারা মনে না করেন যে, বৃদ্ধ হয়েছেন বলে সংসারে তারা এখন অপাঙক্তেয়, বোঝা।
- মা-বাবার বিশেষ দিনগুলোতে তাদের বিশেষভাবে সময় দিন।
- মুরুব্বিদের কখনোই ‘বুড়ো/ বুড়ি’ বলে সম্বোধন করবেন না। পঙ্গুত্ব বা শারীরিক অক্ষমতার জন্যে খোঁটা দেবেন না।
- আপনার জীবনে মা ও বাবার অবদানের জন্যে সবসময় তাদের প্রতি বিনীত, কৃতজ্ঞ ও শ্রদ্ধাশীল থাকুন। তাদের প্রতি দায়িত্ব পালন আর সম্মান-ভালবাসা জানানো শুধু তথাকথিত ‘বাবা/ মা দিবসে’ সীমাবদ্ধ করে ফেলবেন না।
- জীবনসায়াহ্নে সন্তানের কাছে থাকার আকুতি তাদের মাঝে সবচেয়ে বেশি থাকে। এ সময় তাদেরকে গ্রামে বা নিজের থেকে দূরে শুধু গৃহকর্মী দিয়ে পরিবেষ্টিত করে রাখবেন না। তাদের প্রতি টান অনুভব করুন-যেভাবে তারা আপনাকে শিশুবয়সে আগলে রেখেছিলেন, একইভাবে তাদের শেষ বয়সে আপনি আগলে রাখুন।
- তাদেরকে বোঝা মনে করে/ মতের অমিল হলে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠানোর কথা ভুলেও চিন্তা করবেন না। তাদেরকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠালে আপনার বার্ধক্যেও একই পরিণতির জন্যে তৈরি থাকুন।
- জীবন যেমন স্বাভাবিক, মৃত্যুও তেমনি স্বাভাবিক। জীবন যেমন সম্মানজনক, মৃত্যুও তেমনি সম্মানজনক হওয়া উচিত। তাই মৃত্যুপথযাত্রী মা-বাবাকে ‘লাইফ সাপোর্টে’ ঢুকিয়ে ‘নির্জন সেলে’ একাকী ফেলে রেখে তাদের অসম্মান করবেন না। তাদের জন্যে সবচেয়ে সম্মানজনক মৃত্যু হচ্ছে আপনার কোলে মাথা রেখে, আপনার হাতে হাত রেখে পরম প্রভুর নাম নিতে নিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা।
- আপনার বেড়ে ওঠায় মা-বাবার অবদান কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করুন। আর সন্তান হিসেবে মনে রাখুন-মায়ের পায়ের নিচে আপনার বেহেশত।
এসএ/