মাদার্স ডে
প্রকাশিত : ১৯:৪৭, ২ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ২০:০৪, ২ এপ্রিল ২০২০
শামীম আজাদ বাংলাদেশি বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ কবি ও সাহিত্যিক। তিনি বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের লন্ডন শাখার চেয়ারপার্সন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। উপন্যাস, কবিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ের উপর তার ৩৫টি বই প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সাহিত্যের বিভিন্ন ধারা নিয়ে অসংখ্য প্রবন্ধ দেশ বিদেশের বিভিন্ন জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। বিচিত্র পুরষ্কার ছাড়াও তিনি আরও অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
ভোর চারটা টারটায় ঘুম ভাঙে। এখন আর ঘড়ি দেখি না। জানি এসময়ই প্রতিদিন আমার দেহঘড়ি এভাবে আমাকে ঘুমের বাটি থেকে উপছে ফেলে জাগন-টেবিলে। এ আমার লেখার সময়।
কিন্তু করোনার কারনে এখন যা হয় উঠে বাথ্রুমে যাবার আগে, হাত বাড়িয়ে টেবিল লাইট জ্বালাবারও আগে চোখ বন্ধ রেখেই হাতিয়ে হাতিয়ে বালিশের নিচ খুঁজি সেই মহার্ঘ ছোট্ট স্যানিটাইজারের শিশিটি। ঐ রকম তিন তিনটে শিশি ঘরের তিন জায়গায় রাখা আছে আর একটি গাড়িতে। তিন জায়গায় তিনটি জীবানু নাশক ডেটল ভেজা টিস্যুর প্লাস্টিক প্যাকেটও রাখা আছে এবং একটা গাড়িতে। গাড়ি আমার থার্ড বেড্রুম। কে জানে কখন হাত,আঙুল ও নখের গা-গোড়া মুছে ঝুলন্ত এই শ্ত্রু হাতজোড়ার গায়ে সেঁটে থাকা মৃত্যুকনা করোনাকে মারতে হয়!
চোখ বন্ধ রেখেই ’হাতের তালুতে দু’ ফোটা স্যানিটাইজার ফেললাম। এক্ষুনি তা ভাল করে ডলবো এবং ডলার পর সে করতল দিয়েই আবার শিশিটির গায়ে হাত বুলিয়ে তার দেহকেও জীবানু মুক্ত করবো। তো প্রথমেই হাতের আঙুলের মাথায় বসে থাকা যে নখগুলো আছে তাতে এই -নির্যাস মাখিয়ে নিলাম। ম্রুতে মদ পরার মত সংগে সঙ্গে তার সব শুষে গেল। তারপর আরো দু’’ফোটা নিয়ে করতলদল ভালোবেসে বেসে মাখালাম। এবার মুঠোতে শিশিটি নিয়ে হাত বুলাতে বুলাতে ভাবলাম, জীবন হবে যে এমন অদ্ভূত হবে কখনোতো বুঝিনি আগে। এত দুখ আর এত ভয় শুধু দুঃস্বপ্নের মত লাগে।
এখন আমার শ্ত্রু আমার নিজের এই হাতজোড়া। ওরা আমার মুখের কাছে গেছেতো মরেছি। না জেনে করোনা আক্রান্ত কাউকে যদি ছুঁই আর তারপর কোন না কোন ভাবে আমার হাত, মুখ চোখে বা নাকে যায় তাহলে আমি শেষ। না জেনে করোনার ক্যারিয়ার মানুষকে ছুলেও তাই হবে। সে মৃত্যু বীজ বহনকারী তো নিজেও জানে না যে সে যাকে করমর্দন করবে সেই করোনা আক্রান্ত হবে। এভাবেই আক্রান্ত হয়েছেন বিলেতের প্রধানমন্ত্রী, রাজকুমার, রাশিয়ার রাষ্ট্র প্রধান ও । তোমার হাত পথে পথে সে যতজনকে হ্যালো করবে – তারা আজরাইল তাদেরেও হ্যালো বলবে। দোয়া দরুদে কাজ হবে না। হচ্ছে না। আল্লা আল্লা করলেও বাঁচবো না।
কয়েক ফোটা স্যানিটাইজার করতলে দিইয়ে শিশিটিকেও ঐ হাতে মুছে, টেবিল লাইটের সুইচ টিপে দিলাম। আলো জ্বলে উঠলো পূবে পশ্চিমে। আলোর দিকে চেয়ে বললাম, তোমাকে কি করে স্নান করাবো? তারচেয়ে তোমার ঐ ঘন কালো মিনি ডিঙ্গি নাওয়ের মত সুইচটাই সাফা করি। তারপর কনুই দিইয়ে সুইচ টিপে বাথ্রুমে প্রবেশ করলাম অস্ত্রোপচার কক্ষে প্রবেশ করার আগে টিভি সিরিজগুলোতে দেখা নীল ভিনেক হাফহাতা জামাপরা শৈল্য চিকিৎসকদের মত। ’হাত উপরে তুলে।
বাথ্রুমের ভেতরে তাকিয়ে দেখিসর্বনাশ! সেখানে আমাকে মারবার জন্য ওঁৎ পেতে আছে রূপালী ধাতব বসানো সিংক, সাদা প্লাস্টিকের টয়লেট সিট, ধতব র্যাকে ঝুলছে ধোয়া তোয়ালে, পাশে কংক্রিটের খোপে নানান রঙ ও পদার্থে তৈরী ছোট ছোট প্রসাধনী পাত্র। ধাতবেই না করোনার মৃত্যুবীজ ঘাপটি মেরে বসে থাকে সব চেয়ে বেশি সময়। ধাতব হ্যান্ডেলে জ্যান্ত বসে থাকে ৪২ ঘন্টা! ভাবা যায়?কাঠে থাকে কপারে থাকে ৪ ঘন্টা, কাপড়ে থাকে তিন ঘন্টা,প্লাস্টিকে থাকে ৭২ ঘন্টা। মরে যাবোতো। কাপড়েতো আর ফার্নিচার বানানো যাবে না যদি বাঁচি সব কাঠের করে ফেলবো। ভাগ্যিস আমরা মূলত কাপড়ের কাপড় পরি। করোনার কাঁটা কাঁটা গা সমেত দেহটা কাপড়ে আটকে যায় আর নিজের প্রাণ নেই বলে ওর নিজ সময় শেষে নিজেই মরে যায়। বিলেতের এনএইচএস এর নির্দেশানুযায়ী সবাই মুখে মাস্ক পরে অন্যের বিষ নিঃশ্বাসের সামনে ব্যারিকেড দিচ্ছি।
চা করে মনে হল আজ আমার বাজার নিয়ে আসছে আরমান। আমার দেয়া লিস্ট থেকে সে কফি ও ফ্রোজেন সব্জী কিছু সে কিনে রেখেছে এবং বাকিটা হিল্লোল। মানুষ করোনার কারনে ভয়ে কিনে কিনে র্যাক খালি করে ফেলেছে। হিল্লোল যেহেতু নিজেই এক সুপার স্টোরের ম্যানেজার সে আমার প্রয়োজনীয় আগেই তুলে রাখবে।
সরকারের নির্দেশানুযায়ী নিজে আইসোলেশনে আছি। বৃটেনে আমার বয়সী মানুষদের নিয়েই চিন্তা। আমাদেরকে সোশাল ডিস্ট্যাসিং, যা সামাজিকতায় দূরত্ব বজায় রাখতে অনুরোধ করা হয়েছে। এর মাপ হল দুই ফিট। কারোনার জীবানু জল টলটলে অনুসমান। তাই অতটুকু যেতে যেতেই নিচে পড়ে যায়। তখন আশে পাশে কাপড়, ধাতব, চামড়া যা পায় তাতেই বসে পড়ে।
ফোন পেয়ে গ্লাভস ও মুখোশ পরে রিসেপশনে তিন ফুট দূর থেকেই দেখি আলু, সব্জী মাছে ও দুধের প্যাকেট থেকে গলা বাড়িয়ে আছে একগুচ্ছ ফুল! আমি তো মোবাইল লিস্টে তা দিয়েছি বলে মনে পড়ছে না!ব্রিটিশ পুলিশ আরমানের তাড়া আছে। আমার গোলাপী মাস্কের উপরের বিস্মিত চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলে, হ্যাপি মাদার্স ডে আপা। সজীব ডকল্যান্ড থেকে নানান পাব্লিক পরিবাহন হাতিয়ে মাকে রোগ দিতে আসবে না। ঈশিতা দেশ থেকে এসেছে বলে আমাকে বাঁচাতে সেলফ আইসোলেশনে আছে। ! আরমানে দীর্ঘদেহ ঐ দূরে থেকেই মিলিয়ে যায়। আমার চোখ ভিজে যায়।
ঘরে প্রবেশ করে সব সবান জলে পরিষ্কার করে ফরাসী উইন্ডোর ভেতর দিয়ে কাচের জানালা ভেদ করে রাস্তায় তাকাই। কেউ কোথাও নেই। এ এক ভিন্ন মাদার্স ডে। মাকে বাঁচাতে হলে তার কাছে যেও না। সরকার ও টিভি বার বার বলেছে একথা। এরকম সময় প্রতিবছর কত লোক ফুল ও চকোলেট নিয়ে মা’র কাছে যেতো। ওল্ড হোম গুলোতে মা-বাবারা সন্তানদের জন্য সেজেগুঁজে তৈরি হয়ে থাকতো লাঞ্চে যাবার জন্য। নাতিপুতিকে দেখার জন্য। য়াজ কেউ নেই।
লন্ডন
২৩ মার্চ ২০২০
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।