ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

মানবদেহে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপন!

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৬:৫৭, ১৮ নভেম্বর ২০২১

Ekushey Television Ltd.

সময়টা ১৯৩০-এর সেপ্টেম্বরের সকাল বেলা। আমেরিকার কানসাসের অলিতে গলিতে যেন উষ্ণতা ঝরে পড়ছে। সকলের একটাই প্রশ্ন, এমনও হয়! যেন জ্ঞানশূন্য হয়ে কানসাস স্টেট মেডিক্যাল বোর্ডের একটি দল ছুটছে। তাদের সঙ্গী সাংবাদিকরাও। গন্তব্য কানসাস থেকে মিলফোর্ড। সেখানেই তাদের সামনে অসাধ্যসাধন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এক ‘চিকিৎসক’। যিনি আদতে একজন হাতুড়ে চিকিৎসক। এক রোগীর শরীরে ছাগলের অণ্ডকোষ প্রতিস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তিনি।

কানসাস স্টেট মেডিক্যাল বোর্ডের দলটি ঘরের এক কোনে দাঁড়িয়ে দেখল কীভাবে জীবন্ত ছাগলের নিম্নাংশ অসাড় করে তার দু’টি অণ্ডকোষ কেটে বার করে আনলেন ওই চিকিৎসক। তারপর পাশের টেবিলে শুয়ে থাকা রোগীর শরীরে খুব সন্তর্পনে সেগুলি প্রতিস্থাপন করলেন।

এই অস্ত্রোপচার নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। কিন্তু এই একটি অস্ত্রোপচারই সারা বিশ্বে পরিচিতি এনে দিয়েছিল তাকে। ‘গোট গ্ল্যান্ড ডাক্তার’ হিসাবে এক নামে সকলে চেনেন তাকে।

তার প্রকৃত নাম জন ব্রিঙ্কলে। ব্রিঙ্কলের জন্ম ১৮৮৫ সালে উত্তর ক্যারোলিনাতে। তার বাবাও একজন হাতুড়ে চিকিৎসক ছিলেন। ১৬ বছর বয়সে স্কুলের পড়াশোনা শেষ করে ছোটখাটো কাজে ঢুকেছিলেন তিনি। কিন্তু বরাবর-ই বাবার মতো চিকিৎসক হতে চেয়েছিলেন। বাবার ওষুধের বই পড়ে চিকিৎসা নিয়ে বেশ কিছু জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তার পর গাড়িতে করে অলিতে গলিতে ওষুধ বিক্রির একটি সংস্থায় কাজে যোগ দিয়েছিলেন।

১৯০৮ সালে স্ত্রীকে নিয়ে শিকাগোয় চলে যান তিনি। সেখানে বেনেট মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি হন। সেখানেই ব্রিঙ্কলে মানব শরীর সম্পর্কে বিবিধ জ্ঞান অর্জন করেন। কিন্তু তিন বছর পর বেতন না দিতে পারায় কলেজ থেকে বের করে দেওয়া হয় তাকে। ফলে তার কাছে চিকিৎসকের কোনও প্রশংসাপত্র ছিল না। এর পর তিনি নিজের জন্য একটি নকল প্রশংসাপত্র জোগাড় করেন।

তারপর তিনি গ্রিনভিলেতে চলে যান এবং সেখানে আরও এক সহযোগীর সঙ্গে বিশেষ এক তেল বিক্রি করতে শুরু করেন। মানুষকে বোকা বানিয়ে যৌনশক্তি বৃদ্ধির কথা বলে এই ওষুধ বিক্রি করতেন তারা। কিন্তু কয়েক মাস এভাবে চলার পর তাদের প্রতারণা ধরা পড়ে যায়। ব্যবসা গুটিয়ে দু’জনেই সেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরবর্তীকালে গ্রেফতারও হয়েছিলেন দু’জনে।

এর পরই তার কানসাসে আসা। ওষুধ বিক্রির জন্য নকল প্রশংসাপত্র কাজে লাগিয়েছিলেন এখানে। নিজেকে মহিলা এবং শিশু রোগ বিশেষজ্ঞ হিসাবে তুলে ধরেছিলেন তিনি। কানসাসের সেনা রিজার্ভ মেডিক্যাল বিভাগের চিকিৎসক হিসেবে কাজও পেয়ে যান। বেতনের টাকাতেই নিজের স্বপ্নপূরণ করেন ব্রিঙ্কলে। শহরের ইলেক্টিক মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্জন করেন স্নাতক ডিগ্রি।

এরপর তিনি বিভিন্ন প্রাণীর শরীর নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। তখনই নাকি তিনি জেনেছিলেন সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর প্রাণী ছাগল। ১৯১৭ সালে কানসাসে নিজের ১৬টি ঘরের একটিতে ক্লিনিক খুলে ফেলেন তিনি। স্থানীয়দের সবরকম রোগেরই চিকিৎসা করতেন এই ক্লিনিকে। কিন্তু পরবর্তীকালে একজন সার্জেন হিসাবে তিনি নাম এবং অর্থ উপার্জন করেছিলেন।

১৯১৮ সালেই বিল স্টিটসওয়ার্থ নামে এক ব্যক্তি তার ক্লিনিকে এসেছিলেন। নিজের যৌন দুর্বলতা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন বিল। ব্রিঙ্কলে নেহাত মজা করেই তাকে বলেছিলেন, ছাগলের এক জোড়া অণ্ডকোষেই তার মুক্তি লুকিয়ে রয়েছে। এরপর ব্রিঙ্কলের পিছনে পড়ে যান বিল। ছাগলের অণ্ডকোষ নিজের শরীরে প্রতিস্থাপনের জন্য একপ্রকার নাছোড়বান্দা হয়ে পড়েছিলেন। তার জোরাজুরিতেই এ রকম একটা অস্ত্রোপচার করতে সম্মত হয়েছিলেন ব্রিঙ্কলে।

তবে এর ভিন্ন মতও রয়েছে। বিলের পরিবারের দাবি, ব্রিঙ্কলেই নিজের টাকার বিনিময়ে বিলকে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিতে রাজি করিয়েছিলেন। অস্ত্রোপচারও সফল হয়েছিলো। সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছিলেন বিল। তার পর ঝড়ের গতিতে ব্রিঙ্কলের কথা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল।

ব্রিঙ্কলের ক্লিনিকের বাইরে রোগীদের লাইন পড়ে যেতে শুরু করে। প্রচুর উপার্জন করেন তিনি। তার কাছে প্রতিনিয়ত ছাগল সরবরাহ করতেন এক ব্যক্তি। এক মহিলার দেহে ছাগলের ডিম্বাশয়ও প্রতিস্থাপন করেছিলেন তিনি। উপার্জিত অর্থে শহরের উন্নয়নেরও কাজে লাগিয়েছিলেন তিনি। একটি ডাকঘর, একটি ব্যাঙ্ক, রাস্তায় বৈদ্যুতিক আলো লাগিয়েছিলেন তিনি। একটি চিড়িয়াখানা খোলার চেষ্টাও করেছিলেন সে সময়।

১৯২৩ সালে নিজের রেডিও স্টেশন চালু করেন ব্রিঙ্কলে। এর মাধ্যমে নিজের আরও প্রচার করছিলেন তিনি। প্রতি দিনের অস্ত্রোপচারের কথা এবং নিজের অভিজ্ঞতা এর মাধ্যমে সকলের কাছে পৌঁছে দিতেন।

খুব বেশি দিন এভাবে কাটাতে পারেননি। প্রাথমিক ভাবে অস্ত্রোপচার সফল মনে হলেও তার রোগীরা ক্রমে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন। কারও সঙ্গী হল ভয়ঙ্কর সংক্রমণ আবার কারও মৃত্যু। ১৯৩০ সালে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিল করে দেওয়া হয় তার। এর ছ’মাস পর রেডিওর লাইসেন্সও বাতিল হয়ে যায়।

এরপর রাজনীতিতে হাত পাকাতে শুরু করেন ব্রিঙ্কলে। একাধিক বার কানসাসের গভর্ণর হওয়ার ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রতি বারই পরাজিত হন।

এরপর টেক্সাসে গিয়েও লুকিয়ে তিনি ছাগলের গ্রন্থি মানব শরীরে প্রতিস্থাপনের কাজ করতে শুরু করেন। প্রচুর উপার্জন করেন সেখান থেকেও। তার এবং স্ত্রীর জন্য ১৬ একর জমির উপর একটি প্রাসাদ বানিয়ে থাকতে শুরু করেন সেখানে। বিলাসবহুল ছিল সেই প্রাসাদ।

টেক্সাসেও লোক ঠকানোর এই কাজ বেশি দিন চালাতে পারেননি। জানাজানি হতেই তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়। ৩০ লক্ষ ডলার জরিমানা নেওয়া হয় তার থেকে। ১৯৪১ সাল নাগাদ নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন তিনি।

জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে ফের ধুলোয় মিশে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি ব্রিঙ্কলে। তিন বার হৃদরোগে আক্রান্ত হন তিনি। ক্রমে স্বাস্থ্যের অবনতি হতে শুরু করে তার। অবশেষে ১৯৪২ সালের ২৬ মে সান অন্টোনিয়োতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েই মৃত্যু হয় তার।

সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা

এমএম/আরকে


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি