ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪

মানবিকতার চর্চায় সার্থক হোক রমজান

মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল হালিম হেলালী

প্রকাশিত : ১৫:৫৬, ২৩ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১১:৪১, ২৪ এপ্রিল ২০২০

ইনসেটে মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল হালিম হেলালী

ইনসেটে মাওলানা মোহাম্মদ আব্দুল হালিম হেলালী

রমজান এমন একটি মাস- যে মাসে নিজের শারীরিক, মানসিক সুস্থতার জন্যে করণীয় কাজগুলো করতে চাইলেই করা অনেক সহজ। ধর্ম আমাদেরকে সেই সুযোগ এনে দিয়েছে। যারা ধর্মের এই বিধান অনুসরণ করবেন, তারা উপকৃত হবেন শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে। 

রোজা নিয়ে এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা বলছেন, ডায়েট বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা এই রোজারই নাম দিয়েছেন ‘অটোফেজি’ এবং এর উপকারিতা নিয়ে গবেষণা করে জাপানী চিকিৎসাবিজ্ঞানী ইয়োশিনোরি ওশোমি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কারণ রোজার যে উপকারিতা, বৈজ্ঞানিকভাবে তিনি খুব সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছেন।

গত বছরের ন্যায় এ বছরেও রোজার পুরোটাই গ্রীষ্মকালে। এজন্যে আমাদের বিশেষভাবে আল্লাহ্‌র শুকরিয়া আদায় করা উচিৎ। কারণ এই দীর্ঘ সময়ের রোজা শরীরের জন্যে অনেক বেশি উপকারি। এ বছর প্রায় পনেরো ঘন্টা খাবার ও পানি ছাড়া থাকতে হবে। এর উপকারিতা একটু ব্যাখ্যা করা যাক। 

আমাদের দেহকোষগুলোতে নিয়মিত টক্সিন বা বিষাণু সৃষ্টি হয় এবং এই দেহকোষগুলো যতক্ষণ পর্যন্ত বাইরে থেকে খাবার পায়, সে খাবার খেতে থাকে। আর যত খাবার পাবে তত সে খেতে থাকবে। কিন্তু যখন দীর্ঘসময় আপনি রোজা রাখেন, তখন এই কোষগুলো বাইরে থেকে কোনো খাবার পায় না। ফলে সে ক্ষুধার্ত হয়ে যায়। আমারা যেরকম বেশি ক্ষুধা লাগলে খাবারের মান নিয়ে কোনো বাছবিচার করি না। যা পাই, তা-ই খাই। তেমনি দেহকোষগুলো যখন ক্ষুধায় আক্রান্ত হয়, তখন ভালো-মন্দ বিচার করে না। দেহের ভেতরে থাকা বিষাণুগুলোকেই তারা খেয়ে ফেলে। ফলে দেহের ভেতরে জমতে থাকা টক্সিনগুলো দূর হয়ে যায়। যে টক্সিনগুলো ছিল দেহের আবর্জনা, সেগুলোকেই দেহকোষ তখন হজম করে শক্তিতে রূপান্তরিত করে। এই প্রক্রিয়াটির তুঙ্গতম মুহূর্ত হচ্ছে রোজার ১২ থেকে ১৬তম ঘন্টা। তাই এবারের গ্রীষ্মে দীর্ঘ সময়ের রোজা শরীরের জন্য অনেক বেশি উপকারি হবে।

এবারের রমজান আরেকটি কারণে মানুষের মানসিক ও আত্মিক উন্নতির সুযোগ করে দিতে পারে। বর্তমানে করোনা নিয়ে সারা বিশ্ব জুড়ে উদ্বেগ আতঙ্ক অমানবিকতা ও বিশ্বাসহীনতা বা ঈমানের দুর্বলতা বিরাজ করছে। এসব থেকে নিজে বের হওয়ার ও অন্যকে বের করার চমৎকার সুযোগ হচ্ছে রমজান। তারাই ভাগ্যবান হবেন যারা কোরআনের মধ্যে ডুবে গিয়ে নিজের মানবিকতার পুনরুত্থান ঘটাতে পারবেন। প্রকৃত অর্থেই ঈমানদার হতে পারবেন। একজন ঈমানদার বা বিশ্বাসী মানুষ কখনো অমানবিক আচরণ করতে পারেন না। মনুষ্যত্বকে বিসর্জন দিতে পারেন না।
 
মনুষ্যত্বের কত অভাব হলে একজন মা তার ছেলের লাশ নিয়ে চিৎকার করছে লাশের সৎকার করার জন্যে কিন্তু তার অন্য সন্তানরাও সেই লাশের সৎকারের জন্যে এগিয়ে আসছে না। ২১ ঘন্টা মা লাশ নিয়ে বসেছিলেন! যেখানে আল্লাহ্‌র রাসুল বলেছেন, মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত।

কত অমানুষ হলে, কত আতঙ্কপাগল হলে ৫০ বছরের বৃদ্ধা মা-কে বাড়ি নেয়ার পথে জঙ্গলে ফেলে দিয়ে যেতে পারে এবং মানুষ কত অমানুষ হলে একজন অসুস্থ বৃদ্ধা মহিলাকে পরিবার পরিজনসহ ঘর থেকে প্রতিবেশীরা বের করে দিতে পারে।

কত অমানুষ হলে সাত বছরের একটি শিশু আশেপাশে সবার কাছে, সব ঘরের দরজায় গিয়ে কাকুতি মিনতি করেছে যে ‘আমার বাবাকে একটু হাসপাতালে নিয়ে যাও।’ কিন্তু কেউ দরজা খুলে বেরিয়ে আসেনি এবং সে লোক মারা যাওয়ার পরেও কেউ দরজা খুলে বেরিয়ে তার দাফন-কাফনে এগিয়ে আসে নি। অর্থাৎ ভয়, আতঙ্ক, স্বার্থপরতা, অমানবিকতা নিম্ন স্তরে নেমে গেছে। সব দেখে মনে হচ্ছে আমরা যেনো জাহেলিয়াতে প্রবেশ করেছি!

পবিত্র কোরআনে সূরা মূলক এর দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ বলেছেন- ‘তোমাদের মধ্যে সৎকর্মে কে অগ্রগামী তা পরীক্ষার জন্যই তিনি জীবন সৃষ্টি ও মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন।’

এ থেকে বোঝা যায়, জীবন ও মৃত্যুর পুরো বিষয়টিই আসলে আমাদের জন্য পরীক্ষা। করোনা ভাইরাসের এই সময়টা নিঃসন্দেহে একটি বড় পরীক্ষা। কে সৎকর্মে অগ্রগামী হতে পারব আর কে মানুষের ক্ষতি করে মন্দ কাজে অগ্রগামী হবো তা আল্লাহ ভালভাবেই দেখতে পাচ্ছেন। বেশি বেশি মানব কল্যাণমূলক কাজ করে আমরা অগ্রগামী হয়ে থাকবো কিনা তা আমাদেরই ভেবে দেখতে হবে। করোনাকে আসলে আমরা আমাদের মনুষ্যত্ব মাপার কিট বলতে পারি।

করোনা নামক কিট দিয়ে আমরা মাপতে পারি- আমরা আসলেই মানুষ কিনা? আমাদের মধ্যে মানবিকতা আছে কিনা?  নাকি আমরা জাহেলিয়াতে আক্রান্ত, অসভ্য-বর্বর, অমানুষ?

লেখক : প্রখ্যাত মুফাসসির ও বিশিষ্ট ওয়ায়েজ এবং খতিব, বায়তুল আমান জামে মসজিদ, সীতাকুণ্ড, চট্টগ্রাম।
এসএ/


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি