মানুষ মাংসাশী না তৃণভোজী প্রাণী?
প্রকাশিত : ১৫:১১, ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
আশ্চর্য শোনালেও সত্যি, বর্তমানে সারা বিশ্বে মোট মৃত্যুর ৬৩ শতাংশ ঘটছে অসংক্রামক রোগে। আর বাংলাদেশেও ২০১৬ সালে ৬৭ শতাংশ মৃত্যুর কারণ ছিল অসংক্রামক রোগ। যেমন : হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি। এসব রোগের অন্যতম প্রধান কারণ অবৈজ্ঞানিক ও ভুল খাদ্যাভ্যাস।
অবৈজ্ঞানিক খাদ্যাভ্যাসের কারণে বিশ্বে প্রতি পাঁচজনে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। মাত্রাতিরিক্ত মাংস, লবণ ও চিনি গ্রহণই এর মূল কারণ। আসলে খাবার হওয়া উচিত স্বাস্থ্যসম্মত, বিজ্ঞানসম্মত ও আধুনিক পুষ্টিবিজ্ঞানসম্মত।
এনথ্রোপলজিস্ট বা নৃ-বিজ্ঞানীরা মনে করেন, আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন প্রধানত তৃণভোজী। প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ মাংস ডিম দুধ খেতে পেলেও তা ছিল অনেক কম। এর পক্ষে প্রমাণ হিসেবে তারা বলেছেন, মানুষের দাঁতের গঠন মূলত শাকসবজি, ফলমূল ও শস্যদানা খাওয়ার উপযোগী। এ-ছাড়াও মানুষের পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদান্ত্র এতটাই দীর্ঘ যে, সেটি আঁশযুক্ত ও উদ্ভিজ্জ খাবারের ধীরে ধীরে হজমপ্রক্রিয়াকে সমর্থন করে।
গত শতাব্দীর শুরুতেও আমেরিকানরা ছিল অনেকটাই ভেজিটেরিয়ান বা তৃণভোজী। তাদের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকার দুই-তৃতীয়াংশ আমিষই ছিল উদ্ভিদজাত। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, পোলট্রি শিল্পের বিকাশ এবং রেফ্রিজারেটরের ব্যাপক ব্যবহারের কারণে ধীরে ধীরে তাদের প্রাণিজ আমিষ খাবারের পরিমাণ বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে আমেরিকানদের খাদ্যতালিকার দুই-তৃতীয়াংশ আমিষ আসে প্রাণিজ আমিষ অর্থাৎ মাছ মাংস ডিম দুধ থেকে। ফলাফল অত্যন্ত বেদনাদায়ক।
১৯০০ সালের দিকেও যে-সব রোগে আক্রান্তের হার ছিল খুবই কম, সেই রোগগুলোই এখন আমেরিকানদের ঘরে ঘরে। যেমন : হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্থূলতা, ক্যান্সার ইত্যাদি।
প্রভাবশালী ডায়েট বিশেষজ্ঞ ড. টি. কলিন ক্যাম্পবেল দীর্ঘ তিন দশক নিবিড় গবেষণালব্ধ অভিজ্ঞতা ও ফলাফল পর্যবেক্ষণ করে বলেন, বিশ্বব্যাপী এত উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, স্থূলতা ও ক্যান্সারের মূল কারণ মাত্রাতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ গ্রহণ এবং শারীরিক পরিশ্রমের অভাব।
খাদ্য যখন প্রক্রিয়াজাত করা হয়, তখন খাবারের প্রাকৃতিক অবস্থা বদলে যায়। আবার ওভার কুকিং ও রিফাইনিংয়ের ফলেও খাবারের প্রাকৃতিক অবস্থা বদলে যায়। দীর্ঘদিন এই জাতীয় খাবার গ্রহণের ফলে শরীরে বাই-প্রোডাক্ট হিসেবে একগুচ্ছ রাসায়নিক পদার্থ তৈরি হয়, যা DLS (Dioxin Like Substance) নামে পরিচিত।
দীর্ঘদিন ধরে এই DLS জমা হতে হতে একপর্যায়ে তা Advance Glycosylation End Product (AGE)) নামের এক ধরনের ছাই বা বর্জ্য পদার্থে রূপান্তরিত হয়। এই AGE নামের বর্জ্য শরীরে নাইট্রিক অক্সাইড তৈরির ক্ষমতা নষ্ট করে ফেলে। নাইট্রিক অক্সাইড আমাদের শরীরের জন্যে অত্যন্ত দরকারি। এটি ‘মিরাকল মলিক্যুল’ নামে পরিচিত। এই নাইট্রিক অক্সাইড ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক, কিডনি রোগ ও ক্যান্সার প্রতিরোধে পালন করে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সারায়েভো যুদ্ধ চলাকালীন সেখানে তীব্র খাদ্যসংকট দেখা দেয়। ফলে ব্যাহত হয় মাছ মাংস ডিম দুধের স্বাভাবিক সরবরাহ এবং সেখানকার অধিবাসীরা দীর্ঘসময় এসব প্রাণিজ আমিষ খাওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। এ-ছাড়া যুদ্ধের কারণে রান্না করা খাবারও তেমন খেতে পায় নি। শুধু ফলফলাদি, সবজি-সালাদ, রুটি ইত্যাদি খেয়ে বেঁচে ছিল তারা। যুদ্ধ শেষে দেখা গেল, যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস ছিল, তারা এই রোগগুলো থেকে নিরাময় লাভ করেছে।
পাকিস্তানের উত্তর সীমান্তে হিমালয়ের কোল ঘেঁষে রয়েছে একটি পাহাড়ি জনপদ, যা ‘হুনজা ভ্যালি’ নামে পরিচিত। অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই পাহাড়ি অঞ্চলটি আধুনিক সভ্যতা থেকে বিচ্ছিন্ন একটি উপত্যকা। এখানকার অধিবাসীরা হুনজা নামে পরিচিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তারা দীর্ঘজীবনের অধিকারী।
সাধারণ পাকিস্তানিদের গড় আয়ু যেখানে ৬৭ বছর, সেখানে আধুনিক যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা ও উন্নত চিকিৎসাসেবা বঞ্চিত হুনজা জনগোষ্ঠীর গড় আয়ু ১০০ বছর। কেউ কেউ এমনকি ১২০ বছর পর্যন্ত বাঁচে! তারা নিজেদের উৎপাদিত খাবার খায় আর বরফগলা পানিতে গোসল করে এবং সেই পানিই পান করে। কোনো ধরনের প্যাকেটজাত ও প্রক্রিয়াজাত খাবার খায় না। সেই সুযোগই তাদের নেই।
হুনজাদের অন্যতম প্রধান খাদ্য এপ্রিকট। মনে করা হচ্ছে, এপ্রিকটে রয়েছে ভিটামিন বি১৭ (এমিগডালিন), যা তাদের ক্যান্সারমুক্ত রেখেছে। তাদের খাদ্যতালিকায় থাকে প্রচুর তাজা ফল, কাঁচা সালাদ, কাঁচা সবুজ পাতা এবং পূর্ণ শস্যদানা, বাদাম, বীজ ও বিন। আর মাংস থাকে খুবই কম। তাদের দীর্ঘজীবনের নেপথ্যে আরো রয়েছে প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম আর বিশুদ্ধ বাতাসে দম নেয়ার সুযোগ। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস তাদের কাছে অচেনা।
ওপরের ঘটনাগুলো পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, বর্তমানে এত উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্ট্রোক, ক্যান্সারের পেছনে প্রধান কারণ অতিরিক্ত প্রাণিজ আমিষ ও মানুষের তৈরি খাবার।
এছাড়াও মানুষের তৈরি প্রক্রিয়াজাত খাবারের সাথে থাকা চিনি ও সাদা ময়দা খাওয়ার ফলে বাড়ছে স্থূলতা, ফ্যাটি লিভার ডিজিজ, ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স এবং টাইপ-২ ডায়াবেটিস। আবার কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাটসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণের ফলে দেখা দিচ্ছে করোনারি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ, স্ট্রোক ও ডায়াবেটিস।
সূত্র: ‘এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’, ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান
এমএম/