মার্কিন ডলার কি বিশ্ব অর্থনীতির নেতৃত্ব হারাচ্ছে?
প্রকাশিত : ২০:১৫, ১৮ আগস্ট ২০১৮ | আপডেট: ২০:১৯, ১৮ আগস্ট ২০১৮
রাশিয়ান রুবলের মতো উঠতি মুদ্রার দাপটে মার্কিন ডলার কি তার স্থান হারাচ্ছে? প্রকাশ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের ‘পতন` কামনাও করেছে মস্কো৷ কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী?
কোনো মুদ্রার স্থিতিশীলতা যদি পুরোপুরি তার ইস্যুকারীর ওপর নির্ভর করে, তাহলে ডলারের অবস্থা বেশ নাজুকই বলা চলে৷ ওয়াশিংটনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বিশ্বের সবার সাথে লড়াইয়ে বেশি ব্যস্ত৷ তাঁর প্রশাসন চীনসহ অন্যান্য দেশের পণ্যে শুল্ক আরোপ এবং বড় বড় কথা দিয়ে বাণিজ্যযুদ্ধে ব্যস্ত৷
সম্প্রতি, রাশিয়া এবং তুরস্কের সাথেও বিবাদে জড়িয়েছেন ট্রাম্প৷ ওয়াশিংটনকে সুযোগ বুঝে পালটা জবাবও দিচ্ছে তারা৷ এখন রাশিয়া ও তুরস্ক, উভয়ের পক্ষ থেকেই চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে মার্কিন ডলারের আধিপত্যকে৷
ইউরো
ইউরো বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত এবং প্রচলিত মুদ্রা৷ এটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর সাধারণ মুদ্রা হিসেবে স্বীকৃত৷ ইইউ-এর ২৮টি সদস্য দেশের মধ্যে ১৯টি দেশে এই মুদ্রার প্রচলন রয়েছে৷ যেসব দেশে ইউরো চলে, তাদের ‘ইউরোজোন’ বলা হয়৷ এছাড়া কসোভো, মন্টেনিগ্রো এবং ভ্যাটিকান সিটিতেও ইউরোর চল রয়েছে৷
ডলারের অবস্থান
মার্কিন মুদ্রার জয়যাত্রা শুরু হয় ১৯৪৫ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি৷ মিশরের সুয়েজ খালের পাশে গ্রেট বিটার হ্রদে নোঙর করা ইউএসএস কুইন্সি নামের জাহাজে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্র্যাঙ্কলিন ডি রুজভেল্ট এবং সৌদি বাদশাহ ইবনে সৌদ উপস্থিত ছিলেন৷
সৌদি তেলে যুক্তরাষ্ট্রের অধিকার এবং ডলারের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে দেশটিকে সামরিক সহায়তা দেয়ার অঙ্গীকার করেন রুজভেল্ট৷
এর মধ্যে অনেকবারই সৌদি-মার্কিন সম্পর্কে উত্তেজনা ছড়িয়েছে, কিন্তু এই চুক্তির বরখেলাপ করেনি কোনো পক্ষই৷ পরবর্তী দশকগুলিতে তেলের চাহিদা যতই বেড়েছে, মার্কিন ডলারের চাহিদাও বেড়েছে তরতর করে৷ বিভিন্ন দেশের অর্থনৈতিক লেনদেনের মাধ্যম হয়ে ওঠে মার্কিন ডলার৷
এখনও মোটামুটি একই অবস্থানেই আছে মার্কিন ডলার৷ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর হিসেবমতে বিশ্বের মোট রিজার্ভের প্রায় ৬২ শতাংশই সংরক্ষিত আছে ডলারে৷ বাকি অংশের মধ্যে শতকরা ২০ ভাগ আছে ইউরোতে এবং ইয়েন ও ব্রিটিশ পাউন্ডে সংরক্ষিত আছে ৫ শতাংশ রিজার্ভ৷
বৈদেশিক মুদ্রার লেনদেনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে মার্কিন ডলার৷ বিশ্বজুড়ে লেনদেনের ৮৫ শতাংশই হয়ে থাকে ডলারে৷
মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভও ডলারের নেতৃত্ব ধরে রাখার নীতিই ধরে রেখেছে এবং পর্যাপ্ত তারল্য বজায় রাখার চেষ্টা করেছে, যাতে বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের কর্তৃত্ব ঠিক থাকে৷
সার্বিক পরিস্থিতি
ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে তুরস্ক৷ বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ৪৫ শতাংশ দর হারিয়েছে লিরা৷ এর ফলে বিশ্বের ১৮তম বৃহৎ অর্থনীতির এই দেশটি আরো মারাত্মক সংকটে নিমজ্জিত হতে যাচ্ছে৷ এর ধাক্কা এসে লাগছে বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশ, এমনকি ইউরোপের মার্কেটেও৷
ডলারের তারল্য বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করে৷ যেকোনো সময় ডলার দ্রুত বিনিময় করা যায় বলে এটিকে তাঁরা একটি নিরাপদ মুদ্রা বলে মনে করে থাকেন৷
কিন্তু এর বিপরীত দিকও রয়েছে৷ কোনো বিপদের গন্ধ পেলে সবাই ডলারের দিকেই ছুটে যায়৷ কিন্তু বিশ্ব অর্থনীতির বড় সব ধাক্কার উৎস বেশিরভাগ সময় যুক্তরাষ্ট্রেই হয়ে থাকে৷ ২০০৭-০৮ সালের অর্থনৈতিক সংকটের সময়ও একই ঘটনা ঘটেছিল৷
অর্থনীতিবিদ ব্যারি আইখেনগ্রিন এই অবস্থাকে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একটি ‘নিদারুণ সুবিধা` হিসেবে উল্লেখ করেছেন৷ কিন্তু এই মুহূর্তে ডলারের কোনো বিকল্পও তিনি দেখতে পাচ্ছেন না৷ ডলারের সম্ভাব্য দুই প্রতিদ্বন্দ্বী ইউরোপের ইউরো এবং চীনের ইউয়ান নিজেরাই অনেক সমস্যায় আছে৷ আইখেনগ্রিন বলছেন, ইউরোর ওপর রাষ্ট্রের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই, অন্যদিকে ইউয়ানের ওপর রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ অনেক বেশি৷
অর্থাৎ, বড় ধরনের সংকটের মুহূর্তে ইউরোকে সমর্থন দিয়ে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার মতো একক কোনো সরকার নেই৷ অন্যদিকে, চীনের ইউয়ান বাজারের গতিপ্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রণ না হয়ে দেশটির সরকারের ইচ্ছে অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়৷
তবুও...
তারপরও বিশ্ব অর্থনীতিতে ডলারের আধিপত্য কমার সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না৷ ট্রাম্প বিভিন্ন দেশের অর্থনীতি নিয়ে বড় বড় কথা বলেন৷ বিশেষ করে চীনকে মুদ্রাব্যবস্থায় অযাচিত হস্তক্ষেপ করার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন তিনি৷ কিন্তু ঠিক উলটো কাজটা করেছেন নিজের ঘরে এসে৷ ফেডারেল ব্যাংককে তিনি ক্রমাগত চাপ দিয়ে যাচ্ছেন তাঁর পরামর্শমতো মুদ্রানীতি ঘোষণার জন্য৷
মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন পর্যন্ত সে চাপ সামলে নিজস্বতা বজায় রেখেছে বটে, কিন্তু কতদিন ফেডারেল ব্যাংক রাজনীতিনিরপেক্ষ থেকে নীতি ঘোষণা করতে পারবে, সে নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে৷
সমচেয়ে বড় কথা, ট্রাম্পের অর্থনীতিতে কেউই আর ভরসা রাখতে চায় না৷ মুখে যা বলেন ট্রাম্প, কাজে করেন তার ঠিক উলটো৷ বড় বড় বাণিজ্য চুক্তির কথা বলে এখন পর্যন্ত আগের বিভিন্ন চুক্তি কেবল বাতিলই করে চলেছেন তিনি৷ উপরন্তু, চীন, রাশিয়া এবং সবশেষ তুরস্কের সাথে জড়িয়েছেন বিবাদে৷ ফলে বর্তমান অর্থনৈতিক পরিবেশে ডলারকে আর আগের মতো নিরাপদ মনে করছেন না অনেকেই৷
ফলে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে, ডলারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারে কোন মুদ্রা?
রাশিয়া এবং তুরস্ক এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে, ড়লারের বদলে তাঁরা নিজ নিজ জাতীয় মুদ্রাতে বাণিজ্য চালাতে আগ্রহী৷ যদি এই দুই দেশ অন্যদেরকেও এ ব্যাপারে রাজি করাতে পারে, তাহলে ডলারের আধিপত্য স্পষ্টতই অনেক কমে আসবে৷
তবে যতদিন যুক্তরাষ্ট্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে বিনিয়োগকারীদের পর্যাপ্ত আস্থায় থাকবে, ততদিন ডলারও সবচেয়ে শক্তিশালী থাকার সম্ভাবনাই বেশি৷
সূত্র: ডয়েচে ভেলে
এমজে/
আরও পড়ুন