ঢাকা, শুক্রবার   ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪

মার্টিন লুথার কিং সম্পর্কে কিছু অজানা তথ্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৮:০৭, ২৫ জানুয়ারি ২০১৮ | আপডেট: ২০:১৩, ২৭ জানুয়ারি ২০১৮

মার্টিন লুথার কিং। ‘আমেরিকার এই গান্ধী আবির্ভূত হয়েছিলেন এক শ্রান্ত মায়ের ক্লান্ত পা দুখানি দিকে তাকিয়ে।’

১৯৫৫ সালের ১লা ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার আমেরিকার মাইগোমারি শহরের সিটি লাইসেন্সে বাস চলেছে। বাসের সব আসন পূর্ন। সামনের দিকে ১২ জন শ্বেতাঙ্গ, পেছনে ২৪ জন নিগ্রো। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের অধিকাংশ রাজ্যেই বাসের সামনের দিকে বসবার অধিকার ছিল না নিগ্রোদের। সব বাসই সংরক্ষিত থাকে শেতাঙ্গদের জন্য।

শ্বেতাঙ্গরা বসবার পর যদি কোনো আসন খালি থাকে তবেই সেখানে কৃষ্ণাঙ্গরা বসতে পারবে। বাস এক জায়গায় দাঁড়াতেই তিনজন শ্বেতাঙ্গ গাড়িতে উঠল। ড্রাইভার কৃষ্ণাঙ্গ যাত্রীদের আসন দেবার আদেশ দিলেন। দু’জন কৃষ্ঞাঙ্গ উঠে দাঁড়ালো। কিন্তু নিজের আসন ছেড়ে নড়ল না একটি নিগ্রো মেয়ে। নাম রোজা পার্কস। সে এক দরজির দোকানে কাজ করে। রোজা স্পষ্ট ভাষায় বলে উঠল, আমি আসন ছাড়ব না।

এই স্পষ্ট প্রতিবাদ সরকারী আইন লঙ্ঘন। রোজাকে থানায় নিয়ে যাওয়া হল। তাকে দশ ডলার জরিমানা করা হল। এটি সামান্য ঘটনা। কিন্তু এই  ঘটনার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল নিগ্রো জাযক। তারা ডাক দিলেন আন্দোলনের । বিচিত্র সেই আন্দোলন। কোনো নিগ্রো আর সরকারী বাসে চড়বে না।

পরের সোমবার থেকে ঘটল সেই ঐতিহাসিক ঘটনা। মন্টগোমারির কোন নিগ্রো আর বাসে চড়লেন না। দিনের পর দিন মাসের পর মাস পায়ে হেটে, ঘোড়ার গাড়ি চেপে সাইকেলে করে পরিচিত কারোর গাড়িতে ভাগাভাগি করে যাতায়াত করতে থাকে।

রোজার কন্ঠে সেদিন প্রথম যে প্রতিবাদের সুর ধ্বনিত হয়েছিল, সেই প্রতিবাদের ভাষা হাজার মানুষের কাছে পৌছে দিলেন একজন মানুষ। অল্পদিনের মধ্যেই সমগ্র আমেরিকার লক্ষ লক্ষ নিগ্রো মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হল সেই মানুষটির নাম মার্টিন লুথার কিং। যিনি মহাত্না গান্ধীর আদর্শে আমেরিকার বঞ্চিত মানুষদের জন্য এনেছিলেন মুক্তির আলো। তারই মূল্য দিতে শেষ পর্যন্ত গান্ধীর মতই আত্নাহুতি দিতে হল।

১৯২৯ সালের ১৫ জানুয়ারি আমেরিকার দক্ষিণের মন্টগোমারি রাজ্যের আটলান্টা শহরে এ নিগ্রো যাজক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন। পিতা-পিতামহ দুজনেই ছিলেন ধর্মযাজক। পিতামহ রেভারেন্ড ডানিয়েল বর্ণষৈম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ন্যাশনাল এ্যাসোসিয়েশন। কিং এর পিতাও ছিলেন সংবেদনশীল প্রতিবাদী মানুষ। পিতা-পিতামহের আদর্শ থেকেই অনুপ্রাণিত হয়েছেলেন কিং।

জন্মের পর বাবার নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে পুত্রের নাম রাখা হয়েছিল কিং। ছ’বছর বয়সে পিতা মাইকেল ঠিক করলেন নাম পরিবর্তন করবেন। ছেলের নাম রাখা হল মার্টিন লুথার কিং। একদিন খ্রিষ্টান ধর্মের অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী সেই ধর্মযাজক নিজের পুত্রের মধ্যে বোধহয় নতুন করে আবিস্কার করতে চেয়েছিলেন পিতা। ছেলেবেলা থেকেই কিং ছিলেন শান্তু, ধীর,অনুভূতিপ্রবণ। স্বাভাবিক চেতনা জন্ম নিতেই তিনি অনুভব করলেন চারপাশে জগতে রয়েছে বৈষম্য আর ঘৃনা। আমেরিকার শ্বেতাঙ্গ মানুষেরা তাদের ঘৃনা করে। ট্রাক-বাসে, স্কুলে,কলেজে, পথে ঘাটে চাকরিতে সর্বত্র রয়েছে সারিতে বসবে শ্বেতাঙ্গ ছাত্ররা পেছনের বেঞ্চে বসবে নিগ্রোরা।

এসব ঘটনা গভীরভাবে বিচলিত করত কিংকে। একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ওরা আমাদের ঘৃণা করে কেন? মা বেদনাহত কন্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, আমাদের চামড়ার রং যে কালো। তাই ওরা আমাদের ঘৃনা করে নিগার বলে। পরিণত বয়সে কিং ছেলেবেলায় স্মৃতি স্বরণ করে লিখেছেন, ‘যখন আমি মাকে জিজ্ঞাসা করলাম একই সমাজে কেন আমাদের আলাদা হয়ে থাকতে হবে, মা উত্তর দিতেন, একদিন এই বৈষম্য শেষ হবে। আমি ও বিশ্বাস করতাম একদিন অন্যায়ের প্রতিকার হবেই। কিন্তু কেমন করে হবে তা শুধুই ভাবতাম।’

ছাত্র হিসাবে লুথার কিং ছিলেন খুবই মেধাবী। আটলান্টা পাবলিক স্কুল থেকে পাশ করে মোরাহাউজ কলেজে ভর্তি হলেন। ছাত্র অবস্থায় কিংয়র ইচ্ছা ছিল ডাক্তার হয়ে নিগ্রোদের সেবা করবেন। পিতা-পিতামহ ধর্মজাযক হলেও ধর্মের প্রতি তাঁর তেমন কোন আকর্ষন ছিল না। কিন্তু কলেজে পড়বার সময় দার্শনিক থোরোর লেখা civil disobedience বইটি তার মনের উপর গভীর প্রভাব বিস্তার করে। এরপরই তিনি মনস্থির করলেন ধর্মজাযকের জীবন গ্রহণ করবেন। ধর্মযাজক হিসাবে নিজের লক্ষ্য পূরন করতে পারবেন।

কলেজ থেকে পাশ করবার পর ২৯৪৮ সালে ১৯ বছর বয়সে আমেরিকার পেনসিলভেনিয়ার ক্রোজার থিলজিক্যাল সেমিনারিতে ভর্তি হলেন। এ এক ভিন্ন পরিবেশ এখানে শ্বেতাঙ্গ ও নিগ্রো ছাত্ররা একই সঙ্গে পড়াশুনা করত, কোন বর্ণবৈষম্য ছিল না। পড়াশুনায় বরাবরই মনোযোগী ছাত্র ছিলেন কিং। এখানে ধর্মীয় সংগ্রামের ইতিহাস। তবে যার জীবন রচনা তা রমনকে অধিকার করে নিল তিনি ভারতের মহাত্না গান্ধী। তিনি বলতেন নাজারেথের যীশু আর ভারতের গান্ধী আমার জীবনসর্বস্ব। যীশু পরে দেখিয়েছেন, গান্ধী প্রশান করেছেন সেই পথ পাঠ আমি পেয়েছিলাম বাইবেল ও খ্রীষ্টের জীবন আর উপদেশের মধ্যে। আর এই প্রতিরোধের পদ্ধতিটি পেয়েছিলেন গান্ধীর কাছ থেকে।

ক্রোজার থিওলজিক্যাল সেমিনারি থেকে স্নাতক হওয়ার পথ তিনি বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ধর্মতত্বে ডক্টরেট ডিগ্রি পান। ডিগ্রি ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় তার জীবনে আরো একটি প্রাপ্তি ঘটেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গীত বিভাগের ছাত্রী ছিলেন কোত্তো স্কট নামে একটি তরুণ। কিং এর সাথে প্রথম পরিচয়ে মু্গধ হন স্কট। অল্পদিনের মধ্যেই দুজনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ হবার আগেই ১৯৫৩ সালে দুজনে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। ১৯৫৫ সালে তিনি ডেক্সর্টা অ্যাভিনিউয়ের ব্যাপটিস্ট চার্চের যাজক হিসাবে যোগদান করেন।

ছাত্রাবস্থা থেকে নিগ্রো আন্দোলনের প্রতি প্রত্যক্ষ সমর্থন ছিল। ধর্মযাজক হিসাবে যোগদান করবার পর থেকে তিনি সরাসরি এই আন্দোলনের সাথে যুক্ত হয়ে পড়লেন। সেই সময় নিগ্রোদের প্রধান সংগঠন ছিল National Association for the Advancement of Coloured People (NAACP) , এই সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কিং এর দাদু। সেই সূত্রে এবং নিজের ব্যক্তিত্বে অল্পদিনের মধ্যেই এই অ্যাসোসিয়েশনের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করলেন কিং।

১৯৫৫ সালে মন্টগোমারিতে শুরু হল ঐতিহাসিক বাস ধর্মঘট। সমস্ত নিগ্রোদের তরফে দাবি তোলা হল ১-বাসে নিগ্রো ও শ্বেতাঙ্গদের যে বৈষম্য আছে তা প্রত্যাহার করতে হবে। ২- বাসে যে আগে উঠবে সে আগে বসবে ৩- নিগ্রোদের সাথে ভদ্র ব্যবহার করতে হবে। ৪- নিগ্রো এলাকা দিয়ে যে সব বাস চলাচল করে সেই সব বাসের ক্ষেত্রে নিগ্রোদের ড্রাইভার নিযুক্ত করতে হবে।

নিগ্রোদের সমর্থনে এগিয়ে এলেন নিগ্রো খ্রীষ্টান ধর্মজাযকরা। প্রতিষ্টা হল মন্টগোমারি ইমপ্র ‍ুভমেন্ট এ্যাসোসিয়েশন। মার্টিন লুথার কিং এর সভাপতি নির্বাচিত হলেন। তিনি এক প্রকাশ্য সমাবেশে সমস্ত নিগ্রোদের উদ্দেশ্যে বললেন যতদিন না মন্টগোমারির বাস কোম্পানির পক্ষ থেকে আমাদের দাবি না মেনে নেওয়া হচ্ছে ততদিন একটি নিগ্রোও বাসে উঠবে না।

প্রায় একবছর নানা প্রতিকূলতা সত্বেও নিগ্রোরা সরকারী বাস বয়কট করে। কর্তৃপক্ষ বিরাট ক্ষতির মুখোমুখি হয়ে শেষ পর্যন্ত নিগ্রোদের সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হলেন। সুপ্রীম কোর্ট বাসের এই বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থাকে সংবিধান বিরোধী বলে ঘোষনা করল। অবশেষে  M I A  এ সমস্ত দাবি মেনে নেওয়া হল। বাসে নিগ্রোদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠিত হল।

এই জয়ের পেছনে কিং এর অবদান ছিল বিরাট। তিনি নিগ্রোদের মধ্যে ঘুরে ঘুরে তাদের সাহস দিয়েছেন, শক্তি দিয়েছেন। তার বিরুদ্ধে শ্বেতাঙ্গরা সোচ্চার হয়ে ওঠে তাকে নানাভাবে ভয় দেখানো হতে থাকে। এমনকি একদিন তার বাড়িতে বোমা ফেলা হল। কিন্তু কোন কিছুর কাছেই মাথা নত করলেন না কিং। পুলিশ নানাভাবে তাকে বিব্রত করতে থাকে। এমনকি তিনি নিগ্রোদের সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলছেন বলে তাকে প্রেফতার করা হল। কিন্তু প্রমানের অভাবে তাকে আদালত থেকে ছেড়ে দেওয়া হল।

কিছুদিনের মধ্যেই তিনি নিগ্রোদের কাছে হয়ে উঠলেন প্রতিবাদের মূর্ত প্রতীক। তিনি বিশ্বাস করতেন শান্তি আর অহিংসায়। তিনি অন্তরে অনুভব করতেন ন্যায় ও সত্যের স্বপক্ষে যে সংগ্রাম আরম্ভ করেছেন তা ইশ্বরের ইচ্ছাতেই করছেন। শ্বেতাঙ্গরা তাকে বিদ্রুপ করে বলত নিগ্রো ধর্মগুরু।

মন্টগোমারির বাস আন্দোলনে এই গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকায় কি এর নাম ছড়িয়ে পড়ল সমস্ত আমেরিকায়। তার এই অহিংস আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানাতে এগিয়ে এল বহু নিগ্রো নেতা। সমস্ত আমেরিকা জুড়েই বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জেগে উঠতে থাকে।

১৯৫৭ সালে আমেরিকার বিভিন্ন প্রদেশের নিগ্রো নেতৃবৃন্দ এবং তাছাড়া বিভিন্ন প্রাদেশিক সরকারের নিগ্রো মন্ত্রীরা মিলিত হলেন আটলান্টা শহরে। নিগ্রোদের সামাজিক ও আইনগত অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিকে আরোা জোরদার করবার জন্য প্রতিষ্ঠিত হল SOUTHERN CHRISTIAN LEADERSHIP CONFERENCE সংক্ষেপে বলা হল  SCLC । মার্টিন লুথার এর সর্বসম্মতিক্রমে সভাপতি নির্বাচিত হলেন, তখন তার বয়স মাত্র ২৮ কৃষ্ঞাঙ্গদের দাবির স্বপক্ষে ধীরে ধীরে আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠল। ঘানার স্বাধীনতা দিবস উদযাপন উৎসবে যোগদানের জন্য আমন্ত্রিত হলেন মার্টিন লুথারও আমেরিকার ভাইস প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। এখানে দুই নেতার মধ্যে সাক্ষাৎ হল। নিক্সন নিগ্রোদের দাবির প্রতি সহাননুভূতিশীল ছিলেন। এক বছর পর সাষ্ট্রপতি আইজেন হাওয়ারের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে মিলিত হলেন কিং ও অন্যসব নিগ্রো নেতারা। বেশ কয়েকবার আলোচনা বৈঠক বসবার পরেও কোন সুনিদৃষ্ট সিদ্ধান্তে পৌছানো সম্ভবপর হল না। সরকারের অধিকাংশ প্রস্তাবই তাদের স্বপক্ষে মনোমত হল না। কি এর ভাষায়  This is no neal or meaningful settlement দেশের মধ্যে শ্বেতাঙ্গদের আচরণে ক্রমশই বর্ণবিদ্বেষী মনোভাবপ্র কট হয়ে উঠেছিল। শুধুমাত্র সামাজিক ক্ষেত্রে নয় আইনগত ক্ষেত্রেও নানাভাবে নিগ্রোদের বঞ্চনা কারা হত। বহু রাজ্যে নিগ্রোদের কোন ভোটাধিকার ছিল না। সরকারী উচ্চপদে বসবার অধিকার ছিলনা নিগ্রোদের। কিং আমেরিকার প্রান্তে প্রাান্তে ঘুরে বেড়িয়ে প্রচার করতে লাগলেন, এই বৈষম্যর বিরুদ্ধে অহিংসা আন্দোলনে যোগদেবার জন্য সমস্ত নিগ্রোদের কাছে আহবান জানাতে লাগলেন, এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে অহিংসা আন্দোলনে যোগ দেবার জন্য সমস্ত নিগ্রোদের কাছে আহবান জানাতে থাকেন। ধীরে ধীরে প্রায় প্রতিটি প্রদেশেই আন্দোলন সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। কিং হয়ে উঠলেন সমস্ত আমেরিকার নিগ্রো মানুষের অবিসংবাদিত নেতা।

১৫৫৯ সালে প্রধানমন্ত্রী জহরলালের আমন্ত্রনে ভারতবর্ষে এলেন কিং ও তার স্ত্রী। ভারতবর্ষ কিং এর কাছে ছিল এক মহান দেশ। তিনি গান্ধীর জন্মস্থানে গিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে আসেন।

কিং ভারত ভ্রমণ শেষ করে যখন আমেরিকায় ফিরে এলেন, আমেরিকা জুড়ে আন্দোলন হিংসাত্বক রুপ নিয়েছে। নিগ্রোরা শান্তিপূর্ন আন্দোলন করলেও শ্বোতঙ্গরা হিংস্র হয়ে উঠছে। নিগ্রোদের মধ্যে ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে উঠে। তারাও পাল্টা আক্রমন করে। সর্বত্রই ভাঙ্চুর লুটতরাজ গুলি লাঠি চলতে থাকে। কৃঞ্চাঙ্গদের উপর সমস্ত অভিযোগ এসে পড়ে। কিছু কিছু কৃষ্ঞাঙ্গ নেতা এই অহিংস আন্দোলনের পথ পরিত্যাগের জন্য কিং এর কাছে অনুরোধ জানায়। কিং জানতেন তাতে উদ্দেশ্য সাধিত হবে না, শুধু রক্তপাতই হবে। তিনি এই প্রস্তাব মেনে নিতে পারলেন না। অল্প কিছু দিনের জন্য ব্যাপিস্ত মিশনের হয়ে ধর্মযাজকের কাজে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তার কাছে ধর্ম ছিল মানবমুক্তির একটি পথ। আমেরিকার ক্যারোলিনা , টেনিসি, ভার্জিনিয়া, আরো কয়েকটি প্রদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজের ক্যানটিনে কৃষ্ঞাঙ্গ ছাত্রদের পাশে এসে দাড়ালেন কিং। তারই নির্দেশে অহিংস সত্যগ্রহের পথ বেছে নিল ছাত্ররা। বহুশ্বেতাঙ্গ ছাত্ররাও এই দাবিকে সমর্থন জানাল। কয়েক মাস আন্দেলন চলবার পর প্রতিটি প্রদেশেই এই র্ঘৃণ্য প্রথাকে বিলুপ্ত করা হল। কৃষ্ঞঙ্গ ছাত্ররা শ্বেতাঙ্গদের একই সাথে খাবার অধিকার পেল।

আটলান্টা প্রদেশের একটি বিখ্যাত দোকানে তখনো বর্নবিদ্বেষী প্রথা চালু ছিল। সেখানকার ক্যানটিনে কৃঞ্চাঙ্গদের কোন খাবার অধিকার ছিল না। কিং পচাত্তর জন ছাত্রকে সাথে নিয়ে সেখানে প্রবেশ করলেন। তারা শান্তিপূর্ণভাবে খাবার চাইলেন। কিন্তু তাদের সে অনুরোধ রক্ষা করা হল না। শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় কিং আর কিছু ছাত্রকে বন্দি করা হল।সেই সময় কেনেডি নির্বাচনী প্রচারের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। তার অনুরোধে কিংকে ছেড়ে দেওয়া হল।

ইতিমধ্যে সমস্ত দেশ জুড়ে কৃঞ্চঙ্গদের সামগ্রিক অধিকার লাভের আন্দোলন গড়ে তোলাবার প্রয়োজনীয়তা দেখা গিয়েছিল। সমস্ত দল মিলিতভাবে গড়ে তুলল A Freedom Rird Co-ordinating Committee । কিং হলেন তার চেয়ারম্যান।

বিভিন্ন রাজ্যে আন্দোলনকারী নেতৃবৃন্দ কিংকে তাদের পাশে এসে দাড়াবার জন্য আহবান করতে থাকেন। নির্ভীক কিং সর্বত্রই ছুটে গেয়েছিলেন। এক এক সময় তার জীবন বিপন্ন হবার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। শান্তিপূর্ন আন্দোলনের উপর শ্বেতাঙ্গরা হিংস্রভাবে আক্রমন করে। সামান্যের জন্য রক্ষা পেয়েছেন কিং। তবুও একটি বারের জন্য তিনি হিংসার একটি শব্দও উচ্চারন করেননি।

১৯৬৩ সালে তিনি SCLC র বার্ষিক অধিবেশনে দেশের সর্বত্র পিকেটিং এবং সত্যগ্রহ আন্দোলন শুরু করার ডাক দিলেন। তিনি সহযোগী সাধারন মানুষের কাছে ‍ঘুর ঘুরে অর্থ সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন। যাতে আন্দোলনে আহত,নিহত বন্দী মানুষদের পরিবারের সাহায্য করা হয়।

কিংকে সাধারন নাগরিকদের ক্ষেপিয়ে তোলবার অভিযোগে বন্দী করা হল।……….. কিং এর ভাই একটি চার্চে প্রার্থনা শেষ করা হল এর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠল কৃষ্ঞাঙ্গ সমাজ। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলন হিংসাত্বক হয়ে উঠল।

২রা মে প্রায় ৬০০০ স্কুল ছাত্র স্কুলে বৈষম্যের প্রতিবাদে মিছিল বার করল। প্রায় ১০০ ছাত্রকে বন্দী করা হল। পরদিন আরো বহু স্কুলের ছেলেমেয়েরা জমায়েত হল একটি চার্চে। স্থানীয় পুলিশ হিংস্রভাবে ঝাপিয়ে পড়ল ছোট ছোট ছেলেমেয়ের উপর্

আন্দোলন এমন এক অবস্থায় এসে পৌছাল স্থানীয় গর্ভনর কিং এর সাথে আলোচনায় বসতে বাধ্য হল। কিং এর ডাকে সাময়িকভাবে আন্দোলন প্রত্যাহার করে নেওয়া হল। স্কুলে বর্নবৈষম্য ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হল। এর প্রতিবাদে শ্বেতাঙ্গরা ফেডারেল স্কুলে বোমা ফেলল। বহু নিগ্রো শিশু আহত হল। চারজন মারা গেল, আবহ দাঙ্গা দেখা দিল । কিন্তু শান্তি আর সত্যের পথে অবিচল কিং ছুটে গিয়েছেন দাঙ্গাপীড়িত অঞ্চলে। তিনি এইবার স্থির করলেন দেশ জুড়ে শুরু করবেন ফ্রিডম মার্চ। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওয়াশিংটন পদযাত্রা শুরু হল। ১৯৬৩ সালে ২৭আগস্ট ওয়াশিংটনের লিঙ্কন মেমোরিয়ালে সমাবেত হল প্রায় আড়াই লক্ষের বেশি নিগ্রো। তাদের সামনে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন কিং, আমি স্বপ্ন দেখছি।

সেই বছর টাইমস পত্রিকার তরফে কিংকে বছরের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ হিসাবে পুরস্কার দেওয়া হল। কিং শুধু আমেরিকার নন, বিশ্বের মানবতাবাদী আন্দোলনের অন্যতম নেতা হিসাবে স্বীকৃত হয়েছেন। বর্লিনের মেয়র  উইলি ব্রান্টির আমন্ত্রণে জার্মানিতে গেলেন। সেখানে তাকে অভূতপূর্ব সম্মান দেওয়া হল। তাকে সম্মানিত ডক্টরট উপাধি দেওয়া হল।

১৯৬৪ সালে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে অবিস্বরনিয় অবদানের জন্য তাকে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার দেওয়া হল। গান্ধীর মতই তিনি জীবন কর্ম সর্বক্ষেত্রেই ছিলেন শান্তির পুজারী। যখন তিনি নোবেল পুরস্কার পেলেন তখন তার বয়স হয়েছিল ৩৫ বছর । পুরস্কারের সমস্ত অর্থ তিনি নিগ্রোদের মুক্তি আন্দোলনে দান করলেন।

নিগ্রোদের মানবাধিকারের এই আন্দোলন বিশ্বে সমস্ত মানুষের দৃষ্টি আকর্ষন করেছিল। প্রেসিডেন্ট জনসন নিগ্রোদের বহু দাবি স্বীকার করে নিলেন। এর মধ্যে ছিল নিগ্রোদের ভোটাধিকার।

১৯৬৫ সালে আমেরিকা ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ল । শান্তির পূজারী কিং ছিলেন যুদ্ধের বিপক্ষে। ভিয়েৎনামের মত একটি ছোট দেশের উপর আমেরিকার এই আক্রমন মেনে নিতে পারলেন না কিং। দেশ জুড়ে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেতেই নিগ্রোদের শান্তিপূর্ন সহাবস্থানের উপর শ্বেতাঙ্গরা হিংস্রভাবে আক্রমন করছিল। নিগ্রোরাও পাল্টা আক্রমন শুরু করল। সর্বত্রই অহিংস সত্যগ্রহ হিংসাত্বক আন্দোলনে পরিনত হল। এতে ব্যাথিত হতেন কিং। তিনি বার বার সকলকে শান্ত সংযত থাকবার জন্য আহবান জানাতেন। আমেরিকা ক্রমশই ভিয়েৎনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্বের বহু বুদ্ধিজীবী মানুষের সাথে কিং ও প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধের বিরোধিতা আরম্ভ করলেন। ১৯৬৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ৫ তারিখে তিনি ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে যুদ্ধ বিরোধী পদযাত্রা করবার আহবান জানালেন আমেরিকার সমস্ত  শান্তিকামী মানুষকে। এরই সাথে তিনি ঘোষনা করলেন ২৭ শে এপ্রিল দারিদ্র নির্মূল করবার জন্য আর্থিক নিরাপত্তার দাবিতে দলমত নির্বিশেষে সমস্ত দরিদ্র মানুষদের সাথে নিয়ে তিনি ওয়াশিংটন যাত্রা করবেন।

শান্তি অভিযানে সেদিন হাজার হাজার মানুষের কন্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠেছেল শান্তির আহবান।

মেমপিস টেনেসি রাজ্যে নিগ্রো পৌরকর্মীরা শ্বেতাঙ্গদের সামনে মাইনে ও কাজের সুযোগ সুবিধা বাড়াবার জন্য আন্দোলন করছিল। কিং সেখানে গেলেন। কর্তৃপক্ষ আন্দোলনকারীদের একটি দাবিও মেনে নিলেন না। কিছু অল্পবয়সী ছেলে এর প্রতিবাদে ভাঙচৃর শুরু হগে গেল।পুলিশের হাতে বেশ কয়েকজন মাড়া পড়ল। ৩রা এপ্রিল কিংকে হত্যার হুমকি দেওয়া হল। তার সহকর্মীরা তাকে অন্যত্র চলে যেতে বললেন। কিন্তু অকুতোভয় কিং বললেন তার যাই ঘটুক তিনি এখান থেকে যাবেন না। সকলকে হিংসা ত্যাগ করবার আহবান জানালেন।

পরদিন তিনি যখন হোটেলের বারান্দায় দাড়িয়ে ছিলেন ,আততায়ীর বন্দুকের গুলিতে আহত হয়ে লুটিয়ে পড়লেন। সন্ধ্যে সাতটায় চিরশান্তির প্রতীক মার্টিন লুথার কিং তার আদর্শ খ্রীষ্ট, গান্ধীর মতই হিংস্র মানুষের হিংস্রতার কাছে আত্নাহুতি দিয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। তখন তিনি উনচল্লিশ বছরের এক যুবক।

** লেখাটি মাইকেল এইচ হার্টের অ্যা র‌্যাংকিং অব দ্য মোস্ট ইনফ্লুয়েনশিয়াল পারসনস ইন হিস্টরি বই থেকে নেওয়া।


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি