ঢাকা, রবিবার   ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪

মাহামারী প্লেগ ও স্বামী বিবেকানন্দ

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৭, ১৯ আগস্ট ২০২১ | আপডেট: ১৪:৩৪, ১৯ আগস্ট ২০২১

১৮৯৬ সাল। কলকাতা তখন কলিকাতা। মানুষ শুনল বোম্বে শহরে এক ভয়ানক রোগ দেখা দিয়েছে, যার নাম প্লেগ। প্রায় দুই বছর ধরে মুম্বাই থেকে ধীরে ধীরে গুজরাট, কচ্ছ ও পাঞ্জাবের কিছু অংশ এবং মাদ্রাজ পেরিয়ে ১৮৯৮ সালে রোগটি এসে থাবা বসাল কলকাতায়। ততদিনে কলকাতার মানুষ জেনে গেছে এর আগে দু’বার পৃথিবীতে মহামারীর থাবা বসানো এই প্লেগ ৫৪২ খ্রিষ্টাব্দে জাস্টিনীয় প্লেগ নামে রোমে এক কোটি মানুষের এবং ১৩৪৬ সালে ইউরোপ মহাদেশের আড়াই লক্ষ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। এবার সে তার করাল গ্রাসে ছিন্নভিন্ন করতে এসেছে কলকাতায়।

প্রতিষেধক হিসেবে ছিল রোগ ছড়ানোর অন্তত এক সপ্তাহ আগে বাধ্যতামূলক টিকাকরণ এবং বাড়িঘর যথাসম্ভব পরিস্কার রাখা। তা না হলে সংক্রামণ ও মৃত্যু নিশ্চিত। সব জেনেও আজ করোনা-কবলিত অনেক মানুষ যেমন প্রয়োজনীয় সতর্কতা অমান্য করছে, ঠিক ১২৫ বছর আগেও মানুষ এমনটি করেছিল। একই সঙ্গে টিকা নিয়ে তাদের ছিল অযৌক্তিক প্রচারণা। তাদের বক্তব্যটা ছিল- ‘ইংরেজের হাতে টিকা নিলে রোগ আরও ছড়াবে, এমনকি মৃত্যুও হতে পারে।’ ফলে সীমাহীন বিপর্যয় নেমে আসে। কলকাতার অলি-গলি উজার হয়ে যায় প্লেগের আক্রমনে। ঠিক তখন এগিয়ে আসেন একজন। যার নাম স্বামী বিবেকানন্দ। 

বিবেকানন্দ তখন অসুস্থ। ডাক্তারের পরামর্শে ডায়াবেটিক রোগী হিসেবে অবস্থান করছিলেন দার্জিলিংয়ে। কলকাতায় প্লেগ মহামারির আকার ধারণ করছে এই নিদারুণ সংবাদে অস্থির হয়ে ওঠেন অসুস্থ বিবেকানন্দ। গুরুভাইদের সঙ্গত বারণ সত্ত্বেও তিনি কলকাতায় ফিরলেন। কারণ এই মানুষটি বন্ধু ম্যাকলাউডকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। যাতে তিনি লিখেছিলেন- ‘আমি যে শহরে জন্মেছি, সেখানে যদি প্লেগ এসে পড়ে, তবে আমি তার প্রতিকারকল্পে আত্মোৎসর্গ করব বলেই স্থির করেছি।’

মহামারি নিয়ে বিবেকানন্দের দুশ্চিন্তা সম্বন্ধে স্বামী অখণ্ডানন্দ কিছু তথ্য দিয়ে গিয়েছেন। সে ১৮৯৮ সালের কথা। ‘স্বামীজির সঙ্গে দার্জিলিং-এ আছি। সকালে দেখি— একেবারে গম্ভীর। সারাদিন কিছু খেলেননা, চুপচাপ। ডাক্তার ডেকে আনা হলো, কিন্তু রোগ নিরুপণ করা গেলো না। একটা বালিশে মাথা গুঁজে রইলেন সারাদিন। তারপর শুনলাম কলকাতায় প্লেগ— তিনভাগ লোক শহর ছেড়ে চলে যাচ্ছে— শুনে অবধি এই। সেই সময় স্বামীজি বলেছিলেন, সর্বস্ব বিক্রি করেও এদের উপকার করতে হবে। আমরা যে গাছতলার ফকির, সেইখানেই থাকব।’

অখণ্ডানন্দ লিখছেন, ‘দেশের দুঃখ কষ্টের কথা বলতে বলতে স্বামীজি কেমন হয়ে যেতেন। আমি তখন তাঁকে জিগ্যেস করতাম, ভাই কেন দেশ জাগছে না? তার উত্তরে তিনি বলতেন, ভাই, এ যে পতিত জাত, এদের লক্ষণই এই।’

কলকাতায় তখন এমনই আতঙ্ক যে- হিন্দু-মুসলমান একযোগে কাজ ছেড়ে বাড়িতে বসে রয়েছে। ব্যবসা বাণিজ্য বন্ধ, গাড়ি ঘোড়া স্তব্ধ। এ যেনো স্বতঃস্ফূর্ত লক ডাউন।

এরকম অবস্থায় বিবেকানন্দ তার গুরুভাইদের জানালেন, মরণভয় তুচ্ছ করে প্লেগরোগীদের সেবা করতে, সচেতন করতে, সরকার নির্দেশিত ওষুধ সরবরাহ করতে। এমনকি এ কাজে প্রয়োজনীয় অর্থ সংগ্রহে যদি নতুন মঠের জমি বিক্রিও করতে হয় তার জন্য সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বলেন। তিনি প্লেগ হাসপাতালও তৈরি করতে চেয়েছিলেন। 

ধীরে ধীরে কলকাতা প্লেগের তাণ্ডবলীলার আশ্রয়স্থলে পরিণত হয়। মানুষ পালিয়ে যেতে থাকে কলকাতা ছেড়ে। এ সময় স্বামী বিবেকানন্দ এসব মানুষদের সচেতন করতে চেষ্টা চালান, কারণ নিজেদের অজান্তেই এরা রোগ জীবাণু বহন করে গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিবে।

সরকারের কাজে সাহায্য করার জন্য রামকৃষ্ণ মিশনের পক্ষ থেকে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটিতে ছিলেন- সিস্টার নিবেদিতা, তত্ত্বাবধায়ক হিসাবে সদানন্দ এবং স্বামী শিবানন্দ, নিত্যানন্দ এবং আত্মানন্দ সদস্য।

১৮৯৮ সালে প্লেগের সময় রামকৃষ্ণ মিশন কর্তৃক প্রচারিত আবেদন পত্রের বাছাই অংশ।

স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘মনকে সর্বদা প্রফুল্ল রাখুন। সবাই একবার মরে যাবে। কাপুরুষরা কেবল নিজের মনের ভয়ের কারণে বার বার মৃত্যুর যন্ত্রণায় ভুগছে।’ তিনি এই ভয়কে দূরে সরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘আসুন, আমরা এই মিথ্যে ভয় ছেড়ে দিতে পারি এবং ঈশ্বরের অসীম করুণায় বিশ্বাস রেখে, আমাদের কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করুন। আসুন আমরা শুদ্ধ ও পরিষ্কার জীবনযাপন করি। রোগ, মহামারী ইত্যাদির ভয় একদিন আপনাদের ইচ্ছেশক্তির কবচের কাছে বাতাসে বিলীন হয়ে যাবে।’

এরপর থেকে নিজেদের হাতে সবাই মিলে রাজপথ থেকে বস্তি পরিস্কার করা শুরু করলেন। নিজে ঝাঁড়ু হাতে রাস্তায় নামা, প্লেগ রুগীকে সন্তানসম ভালোবাসায় সেবা দেওয়া, এমনকি তাদের মৃত্যুতে স্বজন হারানোর যন্ত্রণায় ভেঙে পড়া এই নিবেদিত স্বামীজির কাছে কৃতজ্ঞ কলকাতা।

প্রসঙ্গত, ১৮৯৮ সালে কলকাতায় প্লেগের প্রভাবে মৃত্যু যতটা হয়েছিল; তার চেয়ে অনেক বেশি ছড়িয়ে পড়েছিল আতঙ্ক। মানুষের অজ্ঞতাজনিত কারণে আশঙ্কা বাড়াতে; ভোগান্তি বেড়েছিল মানুষের। কলকাতায় হাতে হাত মিলিয়ে; প্লেগ আটকাতে স্বামী বিবেকানন্দ এর নেতৃত্বে লড়াই করেছিলেন; ভগিনী নিবেদিতা ও রামকৃষ্ণ মিশন। প্লেগ আক্রান্ত মানুষের বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে; রাত জেগে সেবা করেছিলেন তাঁরা। শেষ পর্যন্ত আটকানো যায় এই মহামারীকে।

এসএ/

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি