ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ০৩ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

মুক্তিযুদ্ধে শেখ কামাল

ক্যাপ্টেন শচীন কর্মকার (অব.)

প্রকাশিত : ১১:৪৫, ১৪ আগস্ট ২০২১

Ekushey Television Ltd.

১৯৭১ এর ২২শে জুন বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে শেখ কামালকে দেখে চমকে যাই এবং প্রশ্ন করি তুই এখানে কি করছিস? সোজা সাপ্টা উত্তর আমি তোদের সঙ্গে সামরিক প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য মূর্তি যাব। মূর্তিতে স্থাপিত অস্থায়ী সামরিক একাডেমিতে আমি ও শেখ কামাল অন্যদের সঙ্গে পরবর্তী ১৪ সপ্তাহ প্রশিক্ষণ নিয়েছি।

বারাকপুর ক্যান্টনমেন্টে আমাদের নেয়া হয়েছিল মেডিকেল পরীক্ষার জন্য। দুই জন বাদে অন্যান্য সবাই আমরা মেডিকেল ফিটনেস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই। বারাকপুরে আমাদের সঙ্গে ছিল সহযোদ্ধা কামাল উদ্দিন ফিরু। খন্দকার নূরুন্নবি, অলীক কুমার গুপ্ত, আহসান উল্লাহ, মঈনুল ইসলাম, মহম্মদ আলীসহ অন্যরা।

২২ জুন বারাকপুর সেনানিবাসে রাত্রি যাপনের পর ২৩ জুন আমাদের নিয়ে একটি সামরিক কনভয় অজানার উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আমাদের তখনো বলা হয়নি কোথায় যাচ্ছি। দীর্ঘক্ষণ যাত্রার পর সন্ধ্যায় গভীর জঙ্গলে কোনো এক সেনানিবাসে নিয়া যায় এবং সেখানেই নৈশভোজ ও ঘুমানোর ব্যবস্থা করা হয়।

গভীর রাতে এক ঝাঁক যুদ্ধ বিমান আমাদের ব্যারাকের উপর দিয়ে বেশ কয়েকটি চক্কর দেয়। পরে বুঝতে পেরেছিলাম শেখ কামাল অত্যন্ত হাই ভ্যালু টার্গেট হওয়ার কারণে ভারতীয়তার কোনো প্রকার ঝুঁকি নেয়নি। তদুপরি জায়গাটি ছিল চীন সীমান্তের কাছে আসাম সীমান্তবর্তী কোনো অঞ্চল।

২৪শে জুন সন্ধ্যায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সামরিক বাসে করে নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরা মূর্তিতে পৌঁছালাম। আমরা সংখ্যায় মোটে ৬১ জন। ৪টি প্লাটুনে বিভক্ত করে দেওয়া হয়। শেখ কামাল, ফিরু ভাই, মঈন ও আমি চার নম্বর প্লাটুনে ছিলাম। শেখ কামাল ও আমার চৌকি বা খাটিয়া ছিল সামনা সামনি অর্থাৎ বিছানায় শুয়ে একে অপরকে চোখাচোখি করে কথা বলতাম।

অনেক স্মৃতির দুই একটি আজকের লেখায় উল্লেখ করার সময় ও সুযোগ পেলে পরবর্তীতে পূর্ণ বিবরণসহ বই আকারে প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে। কঠোর পরিশ্রমের পরে সামরিক মেসের খাবারের পরে আমাদের কিছু না কিছু বাড়তি খেতে হতো। পকেট মানি হিসেবে আমরা মাসে ১০০ টাকা পেতাম। তবে ফিরু ভাই ও আমাকে সেক্টর থেকে আসার সময় আপৎকালীন খরচের জন্য দুই হাজার করে টাকা দেয়া হয়েছিল।

ওই দুই হাজার টাকার জোরে আমরা অন্যদের চেয়ে একটু বেশি ধনী ছিলাম। ফিরু ভাই, শহীদ আজিজ, খন্দকার নূরনবী এবং অন্যরা মাঝে মধ্যে তাস খেলত। আমি তাস খেলতাম না বিধায় আমার টাকা প্রায় অক্ষুণ্নই ছিল। একদিন বিকেলে দেখি সবাই কিছু না কিছু খাচ্ছে। শুধু শেখ কামাল বাদে। কারণ জিজ্ঞাসা করতে কোনো উত্তরই দিল না। পরে পুলিশি জেরায় স্বীকার করলো ওর কাছে কোনো টাকা নাই। তাৎক্ষণিক ২০০ টাকা হাতে গুঁজে দিয়ে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে হরলিক্স বিস্কুট ইত্যাদি নিয়ে দেই। বললাম জাতির পিতার দরিদ্র পুত্র শেখ কামাল।

শেখ কামাল মাঝে মধ্যে উদাস মনে আমাকে নিয়ে মূর্তি ঝর্ণার পাশে গিয়ে পাঁচমিশালী গল্প করত। মন উদাস হওয়াটাই তো স্বাভাবিক। যার বাবা পাকিস্তানি শত্রুর কারাগারে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। যার মা, ভাই, বোন গৃহবন্দী, যার সামনে অনিশ্চিত যুদ্ধজীবন। তার তো কখনো কখনো মন খারাপ হতেই পারে।

শেখ কামালের নামের সংক্ষিপ্ত করা অক্ষর দুটি ঝ.ক যা আমরা গেঞ্জি ও আন্ডারওয়ারে কালি দিয়ে লিখে দিতাম। ধোপা এসে ময়লা কাপড় নিয়ে যেত এবং পরিষ্কার করে আবার দিয়ে যেত। মাঝে মধ্যে ওর কাপড় আমার কাছে এবং আমার কাছে ওর কাছে চলে যেত, সমস্যা হতো সাইজ নিয়ে। কামাল যেহেতু আমার চেয়ে লম্বায় বেশি এবং সাইজে বড় আর আমার ছোট তাই কখনও কখনও বিড়ম্বনায় পড়তে হতো।

৯ অক্টোবর ট্রেনিং সমাপ্তি তথা কমিশন প্রাপ্তির পর আমি ৯নং সেক্টরে ও কামালকে প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসাবে পোস্টিং করা হয়। কামালের খুব ইচ্ছে ছিল আমাদের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার। কিন্তু জাতির পিতা তথা প্রেসিডেন্ট পুত্র হওয়ার কারণে কামালের এই দাবিটি ভারতীয় তথা বাংলাদেশ সরকার গ্রহণ করতে পারেনি। বাংলাদেশকে দেওয়া ভারতের একটি বিশেষ সামরিক বিমানে করে আমরা কলকাতা দমদম অবতরণ করে আবেগঘন কোলাকুলির পর যে যার জন্য নির্ধারিত গাড়িতে চড়ে চলে যাই।

নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে শেখ কামাল তাঁর চাচা শেখ নাসেরের পরিবারকে দেখাশোনা করার জন্য আমাকে একটি চিরকুট পাঠায়। শেখ নাসের ৯ নম্বর হেডকোয়ার্টারে পূর্ব থেকেই অবস্থান করছিলেন।

২০ নভেম্বর ঈদের দিন আমরা সামরিক গুরুত্বপূর্ণ সীমান্ত থানা কালিগঞ্জ দখল করে নেই। ২২ নভেম্বর জেনারেল ওসমানী ওই এলাকা পরিদর্শনে এলে শেখ কামালের সঙ্গে কয়েক ঘণ্টা কথা হয়। এক সঙ্গে মধ্যাহ্ন ভোজ করি। যুদ্ধের মধ্যে ওটাই ছিল দুজনের শেখ সাক্ষাত।

(৫ আগস্ট ১৯৯৭, দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত নিবন্ধ)

এএইচ/


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি