স্মৃতিচারণ
মুক্তিযুদ্ধের ‘শেষ শহীদ’ তসলিম উদ্দিন
প্রকাশিত : ১৮:১১, ১৭ ডিসেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১৪:১৯, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭
লেখক : শহীদ তসলিম উদ্দিনের ভাই জাহাঙ্গীর হাসান মানিক
পড়ন্ত বিকেল। তবে বিকেলটি অন্য দিনের মতো শান্ত-নীরব ও সুনসান নয়। উত্তাল তরঙ্গের মতো একের পর এক মিছিলের ঢেউ আছড়ে পড়ছে তসলিমদের বাড়িতে। এ উত্তাল তরঙ্গ দেখতে বাড়ির সামনে ঝড়ো হয়েছে তসলিমের বাবা-মা, ভাই-বোনেরা। আর এরই মাঝে এক বিশাল মিছিল তসলিমদের বাড়ি অতিক্রম করে। উত্তাল মিছিলের গর্জনে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে ওঠে সেদিন।
মিছিলের সামনে কফিন । কফিনের পেছনে হাজারো অগ্নিগর্ভা মানুষের স্রোত। সেই স্রোতের সামনের কফিনে মোড়ানো মুক্তিযুদ্ধের প্রথম শহীদ ফারুক ইকবাল। রক্তে ভেজা ফারুকের নিথর দেহ নিয়ে বাঙ্গালি মুক্তিকামী মজলুম জনতার চোখে আগুনের হলকা। এই মিছিল কোনো স্বাভাবিক মিছিল নয়। পর্বতেভেদী সেই মিছিলের তেজ তসলিমের শিরায় শিরায় আগুন ঢেলে দিয়েছে। আর সেই আগুনে ঘি হয়ে হয়ে তসলিমের হৃদয়ে বিদ্রোহের আগুন দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছে এলাকার তুমুল জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব আবুজর গিফারী কলেজ ছাত্রসংসদের জিএস ফারুক ইকবালের মৃতদেহ।
তবে তখনো সিদ্ধেশ্বরী বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্র তসলিম মাত্র তের বছরের শিশু। বাবা ছিদ্দিকুর রহমানের বড় ছেলে তসলিম। মিছিলের তেজে তসলিমের হৃদয়ে টান পড়ে। এরপরই মাকে বলল, ‘দেখ মা, ফারুক ভাই কত ভাগ্যবান! হাজার হাজার জনতা তাঁর লাশ নিয়ে মিছিল করছে! তাঁর মৃত্যু নতুন ইতিহাসের সূচনা করছে!’ মা ধমক দেয়, "চুপ কর! কী সব অলুক্ষণে কথা কস!" মায়ের ধমকে তসলিম চুপসে যায়।
২৫ মার্চের ভয়াল রাতে ঢাকা শহরে নেমে আসে বর্বরতা। দেশে শুরু হয় নিধনযজ্ঞ। সেই বর্বরতার আরেক স্বাক্ষী তসলিম। রাতে ঢাকার চারপাশে যে আগুনে ফুলকি তসলিম দেখেছে সেই আগুনের ফুলকি তাঁর হৃদয়ে জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির জন্ম দেয় ততক্ষণে। তাই তসলিমের মধ্যে বড় ধরণের পরিবর্তন লক্ষ করেন মা-বাবা। সে কারো সঙ্গে কথা বলেনা, মেশে না। আগের সেই চঞ্চলতা নেই; খাওয়া দাওয়াও তেমন একটা করে না। বাবা - মা জানতে চায়, কী হয়েছে? রা নেই তসলিমের মুখে।
হঠাৎ একদিন তসলিমকে বাড়িতে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তারিখ ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। তবে মার্চ কিংবা এপ্রিলের কোন একটি সময় তসলিম বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বিভিন্ন জায়গায় খুঁজেও তাকে পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েকদিন পর নিশ্চিত হওয়া যায়, একই এলাকার বাচ্চু, খোকন, তসলিমকে যুদ্ধে পাঠাতে সহযোগিতা করে তৎকালীন আলাউদ্দিন সুইট- এর ম্যানেজার আজিম। বেশ কয়েকমাস পরে তসলিম ফেরে আপন ভুবনে। মাকে এক নজর দেখতে তসলিম বাড়ি ফেরত আসে। তবে রাজাকার আর পাক হানাদার বাহিনীর সদস্যরা তার খোঁজে তাদের বাড়িতে আসছে এমন খবরে গাঁয়ে চাঁদর জড়িয়ে আবারও রওয়ানা হয় রণাঙ্গনের দিকে।
তসলিম বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার পরই এক সকালে তিনটি জলপাই রঙের জীপ এসে দাঁড়ায় আমাদের উঠোনে। তাদের ভারী বুটের আওয়াজে আশে পাশে ভীতি সঞ্চার হয়। লেঃ কর্ণেল পদধারী একজন পাকিস্তানি অফিসারের নেতৃত্বে অনেকগুলো পাক সৈন্য আমাদের বাড়িটি ঘেরাও করে বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। কিন্তু বাবা সেদিন তাদেরকে বলেছিল, ‘ছেলেকে পড়াশোনার জন্য বকাবকি করেছিলাম। তাই ছেলে রাগ করে বাড়ি ছেড়েছে। এখন কোথায় আছে জানিনা।’ এভাবে আরও তিনবার আমাদের বাড়িতে আসে সৈনিকরা। তবে এবার ওরা একা আসতো না, সঙ্গে নিয়ে আসতেন রাজাকার আর আল-বদর সদস্যদের।
তবে চতুর্থ দফায় রাজাকার ও আর্মিরা মিলে বাবাকে ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে আরেকজনকে তুলে নিয়ে যায় তারা। তিনি পরবর্তী বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান সুলতান মাহমুদ - এর বাবা। তবে কয়েকদিন পর তাদেরকে ছেড়ে দেয় আর্মিরা। এরপর আরও তিনবার আমাদের বাড়িতে হানা দেয় পাক আর্মিরা। ভাইয়ের বিষয়ে খোঁজ দিতে বাবাকে ভয় দেখান, কিন্তু বাবা তার কথায় অনঢ়।
এরইমধ্যে তসলিমদের দলটি হানাদার বাহিনীর সদস্যদের আটকাতে ঢাকার কেরানীগঞ্জ আসে। এর আগে মুক্তিযোদ্ধাদের কয়েকটি দল মিলে হানাদার বাহিনীকে ঢাকার একটি এলাকায় ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা করে। এই সুবাদে তসলিম মায়ের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। সম্ভবত দিনটি ছিল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ। তসলিম গাঁয়ে মাথায় চাদর মুড়ি দিয়ে বাড়ীতে হাজির হয়। বাড়ীর সবাই মহাখুশী। মা অনেকদিন পর ছেলেকে পেয়ে চুলায় রান্না বসান। কিন্তু এরই মধ্যে স্থানীয় এক কিশোর দৌড়ে এসে খবর দেয় কয়েকজন রাজাকার পথ দেখিয়ে পাঞ্জাবী সৈন্যদের একটি দলকে এদিকে নিয়ে আসছে। এমন খবরে তসলিম মাথায় চাদর মুড়িয়ে পিছনের দরজা দিয়ে পালায়। পাঞ্জাবী সৈন্যরা আসে। সব কিছু খুঁজে দেখে। কিন্তু তাকে আর পেল না।
তখনও তসলিমরা পাকিস্তানিদের রুখে দিতে ঢাকায় তুমুল লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিল। একসময় লড়াই থেমে যায়। নতুন ভোর নেমে আসে। তখন ১৬ ডিসেম্বর; দেশ স্বাধীন। জনতার বিজয়ের উল্লাস। ছেলে তসলিম এর বিজয় উদযাপনে তার বাবা সিদ্দিক বেশ কয়েকটি ট্রাক সাজান । এরপর ১৭ ডিসেম্বর তসলিমদের বরণ করতে এলাকার ছেলে-মেয়েরা ট্রাকে ট্রাকে বিজয়ের স্লোগান তুলছে। বাবা তার ছেলের জন্য অপেক্ষা করছে। একে একে ফিরে আসেন তসলিমদের দলের প্রধান মোশাররফসহ আরও অনেকে। একেক জন মুক্তিযোদ্ধা ফিরছেন তো বাবার চোখ খুশিতে ঝলঝল করছে। তবে বাবার কাছে আর ফেরা হলো না তসলিমের। শুধু তসলিমই নয়, তিনিসহ আর ১০ জন যোদ্ধাকে ঢাকার অদূরে একটি জায়গা থেকে তাদের মৃতদেহ পরবর্তীতে উদ্ধার করা হয়।
কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তসলিমকে সমাহিত করা হয় মৌচাক মোড়ে মুক্তিযোদ্ধা ফারুক ইকবালের পাশে। যে ফারুক ইকবালের মৃত্যু দেখে নবম শ্রেণী পড়ুয়া কিশোর তসলিম মৃত্যুর স্বপ্ন দেখেছিলেন। এভাবেই তসলিমরা হারিয়ে যান। তবে দেশের জন্য রেখে গেছেন লাল-সবুজের এক পতাকা।
শ্রুতিলিখন : আলী আদনান।
এমজে/ এআর