মুজিব নামের পতাকা
প্রকাশিত : ১০:৪৩, ১৮ মার্চ ২০২৩
প্রথম মহাযুদ্ধ শেষ হয়ে এসেছে ততদিনে। তার অভিঘাত যদিও আসেনি এই বঙ্গদেশে, তবুও ভারতবর্ষে তখনো আঁধার কেটে আলোর ঝরনা বইছিল না। দখলদার শ্বেতাঙ্গ শাসকরা নিজে আলোকিত হলেও উপমহাদেশজুড়ে অন্ধকারের বাতাবরণ তখন। মানুষ চায় শোষণ, নিপীড়ন থেকে বেরিয়ে স্বাধীন সত্তার বিকাশ ঘটাতে। কিন্তু শাসকের শক্তিমত্তার কাছে তা অসহায়ত্ব ছাড়া কিছু ছিল না।
এমনই পরিবেশ তখন এ অঞ্চলজুড়ে। আর তখন পৃথিবীর মানচিত্রের বিশালত্বের ভেতর টুঙ্গিপাড়া নামক গ্রামটি, পৃথিবীর বিচ্ছিন্নতম গ্রামটিতে একদিন আলোর ফোয়ারা জ্বেলে জেগে উঠেছিল বাংলার প্রাণমন আপ্লুত করে এক মানবশিশুর কান্না-হাসির উতরোল। একটি শতক আগে অর্থাৎ বিংশ শতকের পাদপ্রান্তে তখন মানুষ রণক্লান্ত। প্রথম মহাযুদ্ধ শেষে পৃথিবীর ঘরে ঘরে তখনো উৎকণ্ঠা। মানবতার অপমান বেজে ওঠে। ফুলের কুঁড়িরাও নিজের ইচ্ছামতো ফুটতে পারে না তখন আর। ঠিক সে সময় আকাশের মতো বিস্তীর্ণ, প্রান্তরের মতো উদার এক শিশু স্পর্শ রাখল বাংলার সবুজ মাটিতে। কালের প্রবাহ ধরে আলোকিত শিশুটিই ‘আরও আলো চাই গো’ বলে সারা দেশ তোলপাড় করে ছড়িয়ে দিয়েছিল সূর্যের শিরায় শিরায় বাংলার প্রাণ। ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। গোপালগঞ্জের গ্রাম টুঙ্গিপাড়ায় চৈত্রদিনের গান, বসন্তকালের আলো-হাওয়া প্রবাহিত তখন, আর এরই মাঝে আবির্ভূত হলেন বাংলার সহস্র বর্ষের সাধনার নাম—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
সাধিত সেই ধন্য পুরুষের জন্মশতবর্ষ পেরিয়ে বাঙালি জাতি নতুন উদ্দীপনায় তারই নির্দেশিত পথে মুক্তির রথে চলেছে এগিয়ে। জাতি পালন করছে তার পিতার জন্মশতবর্ষ, মুজিববর্ষ। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনটি পালিত হয় জাতীয় শিশু-কিশোর দিবস হিসেবে। তিনি শুধু একটি নাম নন, তিনি একটি জাগ্রত ইতিহাস। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বাংলাদেশের অস্তিত্বস্পর্শী অমর নাম। ন্যায়, সত্য, কল্যাণ এবং আত্মমুক্তির পক্ষে সোচ্চার উদার হৃদয় মহান মানুষ। কোনো প্রকার সংকীর্ণতা, গোঁড়ামি এবং সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প তাকে স্পর্শ করেনি কখনো। বাঙালিত্ব ছিল তার অহংকার। এই বাঙালিকে তিনি জাগিয়ে তুলেছেন রাজনৈতিক এবং সাংগঠনিক দক্ষতায়। কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছার অনিন্দ্য কুসুম ফুটিয়ে তুলেছিলেন তিনি। তারই আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যুদ্ধজয়ের রক্তাক্ত অধ্যায়ে বাঙালি জাতি। সৃষ্টি করেছিল ইতিহাস। জাতির শানিত শিরায় অকুতোভয় সাহস ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি। দুঃসময়, হতাশার সব বাধার দেয়াল ভেঙে দীর্ঘ পরাজিত, শোষিত, বঞ্চিত জাতিকে স্বাধীনতার সূর্যস্নানে স্নাত করিয়েছেন। তাই তো প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম উচ্চারিত হয় ত্যাগের উজ্জ্বল মহিমায় সিক্ত একটি নাম—বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এই নাম অবিরাম প্রতি সূর্যোদয়ে, সূর্যাস্তে অক্ষয় অম্লান। চিরদিন বাংলার আকাশে-বাতাসে-মাটিতে শৌর্যে-বীর্যে বহমান নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষের প্রিয় নাম হয়ে প্রজ্বলিত যুগ থেকে যুগে। বঙ্গবন্ধু তো শুধু একটি নাম নন, তিনি হলেন একটি জাতির জাগ্রত ইতিহাস। একটি জাতির জন্মদাতা। একটি স্বাধীন জাতিসত্তার অপরিমেয় অহংকার, বর্ণিল ঐশ্বর্য। বঙ্গবন্ধু, বাঙালি এবং স্বাধীনতা একসূত্রে গাঁথা। বঙ্গবন্ধু তার নিজের জীবনের কথা লিপিবদ্ধ করেছেন। অসমাপ্ত সেই জীবনী। ঘাতকের উদ্যত সঙ্গিন সেই রচনা সমাপ্ত হতে দেয়নি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি এবং তাদের দেশি-বিদেশি এজেন্টরা বাঙালিত্বের চেতনা এবং স্বাধীনতার সব অর্জনকে নস্যাৎ করে দিতে বঙ্গবন্ধুর ওপর আঘাত হানে। যে শালপ্রাংশু, সিংহহৃদয় মহান মানুষটি অসীম দেশপ্রেম, জনগণের প্রতি তর্কাতীত ভালোবাসা, অনমনীয় দৃঢ়তা, ভয়-দ্বিধাহীন প্রত্যয় এবং কঠোর অধ্যবসায়কে সম্বল করে ক্রমে ক্রমে ইতিহাসের দীর্ঘ কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়েছেন। শেখ মুজিব থেকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা এবং সর্বোপরি একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা পেয়েছেন। তাকে পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট দস্যুর মতো রাতের অন্ধকারে নিরস্ত্র অবস্থায় পরিজনসহ হত্যা করা হয়েছিল। এ যে জাতির জন্য কত বড় গ্লানি, অপমান ও লজ্জার কথা; তা অবর্ণনীয়। ইতিহাসের চাকা, সভ্যতার চাকাকে নিষ্পেষিত করে ঘাতকরা বাঙালি জাতির জীবনে সৃষ্টি করেছিল ট্র্যাজেডি।
টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম যে মহান মানুষটির, তার জীবন ও কর্ম একটি জাতির জীবনকে দিকনির্দেশনা দেয় প্রতিমুহূর্তে। মানুষের প্রতি দয়া-দাক্ষিণ্য, মানুষের প্রতি মমত্ববোধ শেখ মুজিবকে এক মহানপ্রাণ মহানমানবে পরিণত করার দিগন্ত উন্মীলিত করেছে। বাঙালি জাতির প্রাণপ্রবাহ এবং ধমনিতে তিনি সাহসের মন্ত্র বুনে দিয়েছেন। নির্যাতিত নিপীড়িত জনগোষ্ঠীর জন্য নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন তিনি। বাংলার অবহেলিত এবং হতভাগ্য জনগণের কল্যাণ কামনায় সর্বক্ষণ ব্যাপৃত ছিলেন। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষণ কেটেছে তার অত্যন্ত ব্যস্ততায়। একটি মুহূর্তকেও অপচয় খাতে প্রবাহিত করেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ একটি নাম, একটি ইতিহাস। বাঙালি জাতির সংগ্রামী জীবনধারার প্রতিটি সিঁড়িতে ছিলেন তিনি এককভাবে অগ্রসরমাণ। সবাইকে পেছনে রেখে তিনি এগিয়ে গিয়েছিলেন একটি পশ্চাৎপদ ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তোলার কঠিন কাজটি সম্পাদনে। একটি জাতির জাগরণ, একটি জাতির অভ্যুত্থান, একটি রক্তাক্ত একাত্তর এবং একটি স্বাধীনতা—সবকিছুই সম্ভব হয়েছে একক নেতৃত্বে। আর এ যুগান্তকারী কালজয়ী নেতাই হলেন শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালি যাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাব দিয়ে সম্মানিত-সমৃদ্ধ করেছে নিজেদের। জাতি জানে, এসব অর্জন সম্ভব হয়েছিল একজন শেখ মুজিবের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বিশাল ব্যক্তিত্বের কারণে। ছিলেন দূরদর্শী, দুঃসাহসী, আপসহীন। সততা, কর্মনিষ্ঠতা, কর্মকুশলতাÑসবকিছু মিলিয়ে এক অতুলনীয় মানবে পরিণত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। হয়ে উঠেছিলেন বাঙালি জাতির জীবনে আপন দ্যুতিতে প্রজ্বলন এক অবিনাশী ধ্রুবতারা। সহস্র বছরের সাধনা শেষে বাঙালি জাতি পেয়েছে তার মহানায়ককে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালিকে। শেখ মুজিবুর রহমানের পুরো জীবনটাই নিবেদিত তার দেশ, জাতি ও জনগণের জন্য। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে জাতির প্রতি যে অপরিসীম ভালোবাসা, তা প্রমাণ করে গেছেন। জীবনের পুরো পথপরিক্রমায় বাঙালির সুখ-দুঃখের সঙ্গে একাকার ছিলেন। নিরন্ন, দুঃখী, অভাবী, বঞ্চিত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত জাতির দুর্ভোগমোচনে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে অগ্রসেনানীর দায়িত্ব পালন করেছেন। দাঙ্গাপীড়িত বাঙালি-অবাঙালিকে রক্ষায় জীবনবাজি রেখে এগিয়ে গিয়েছেন। লোভ-মোহের ঊর্ধ্বে ছিলেন বলেই শাসকের নানা প্রলোভন উপেক্ষা করে দুঃসাহসে প্রতিবাদ-প্রতিরোধী হয়েছেন। দিনের পর দিন কেটেছে কারাগারে। লৌহকপাটের অন্তরালে কখনো ভেঙে পড়েননি। হতাশা গ্রাস করেনি। শাসকদের সমঝোতার পথকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। ভোগ, বিলাস, ক্ষমতার অংশীদারত্ব ইত্যাদিকে তুচ্ছজ্ঞান করে বাঙালি জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আপসহীনভাবে লড়াই করে গেছেন শেষদিন পর্যন্ত। নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে সগর্বে ঘোষণা করেছেন, ‘দাবায়ে রাখতে পারবা না।’ সেই সাহসী উচ্চারণ অহেতুক ছিল না। প্রমাণ করে দিয়েছেন যে, বাঙালি জাতিকে দাবিয়ে রাখা সহজসাধ্য নয়। এই ঘুমন্ত জাতিটিকে আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে গেছেন চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে। যে জাতি কখনো বন্দুক-বেয়নেট দেখেনি, সে জাতি একাত্তরে অস্ত্র হাতে লড়াই করেছে বাঁশের লাঠি, লগি-বৈঠা ফেলে। ‘জীবন-মৃত্যু পায়ের ভৃত্য’ হিসেবে জেনেছেন তিনি। ঘুমন্ত জাতির প্রতিটি শিরা-উপশিরায় রক্তপ্রবাহের উত্তাপ বঙ্গবন্ধু ধারণ করতেন। তাই জাতিকে নিজের মতো করে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দিয়েছেন। হাজার বছর ধরে পরাধীন-পর্যুদস্ত থেকে থেকে যে জাতিটি আধমরা থেকে পুরো মরায় পরিণত হচ্ছিল ক্রমশ; বজ্রহুংকারে শুধু নয়, আদরে-সোহাগে প্রাণের প্রবাহে স্পন্দন তুলে একটি বিন্দুতে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি তিনি। জীবনের পুরো সময়ই থেকেছেন আন্দোলন, সংগ্রামে। তার আজীবন স্বপ্ন ছিল পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করার। দেশ স্বাধীন করার। দীর্ঘ আন্দোলনের মাধ্যমে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। লাল-সবুজের পতাকায় বাঙালির মুক্তির জয়গান লিখেছেন। তার জীবন এক বীরত্বগাথা। শুধু বাঙালি জাতি নয়, বাংলাভাষীসহ অন্য ভাষাভাষী মানুষের কাছেও মুক্তির প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন শেখ মুজিব। বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গার সময় ছুটে গিয়েছেন কোনো পক্ষাবলম্বন না করেই। দুপক্ষকেই নিরস্ত্র করতে পেরেছিলেন। অবাঙালিদের বলেছিলেন, ‘তোমরা আমার ভাই।’ পাশাপাশি স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমার দেশের মানুষের রক্তে হোলিখেলার চেষ্টা করো না।’ দেশে বসবাসরত বাংলাভাষী নয়, এমন মানুষকেও তিনি কাছে টেনেছেন। বলেছেন, সাম্য-মৈত্রীর বন্ধনে সবাই যেন যার যার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেও এক হয়ে মিশি। ভুলে যাই যেন ভেদাভেদ। নিজের জীবনেও তিনি এই বিশ্বাসবোধের প্রমাণ রেখেছেন। উর্দুভাষীদের তিনি ঘৃণার চোখে কখনো দেখেননি। বরং তাদেরও বাঙালিদের সঙ্গে মিলেমিশে বসবাস করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। পৃথিবীর নিপীড়িত জাতিসত্তার বিকাশের ক্ষেত্র সম্প্রসারণের আহ্বান জানিয়ে জাতিসংঘে বক্তৃতাও করেছিলেন এবং তা বাংলা ভাষায়। বিশ্বদরবারে বাংলা ভাষাকে তিনি দিয়েছিলেন উচ্চাসন। বঙ্গবন্ধু স্কুলজীবন থেকেই স্বাধীনচেতা ও নির্ভীক ছিলেন। হিন্দু, খ্রিষ্টান এবং মুসলমান অধ্যুষিত অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন। তাই জন্মগতভাবে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় লালিত ছিলেন। ধর্মীয় গ্রন্থ কোরআন পাঠ করেছেন। কারাগারের জীবনে এবং পাকিস্তানি কারাগারে একাত্তরের ৯ মাস বন্দিজীবনকালে নিয়মিত কোরআন তেলাওয়াত করতেন। কিন্তু কখনোই ধর্মান্ধ ছিলেন না। ইংরেজি ভাষা ছাত্রজীবনেই চর্চা করেছেন। এ ভাষায় পারদর্শী ছিলেন বলেই এবং মেধাবী হিসেবে সে সময়ের কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। আইন বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা চলাকালেই বহিষ্কৃত হন। অপরাধ, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের দাবিদাওয়ার প্রতি সমর্থনদান।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে ‘নেতাজি সুভাষ বোসের’ সান্নিধ্য তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল। স্থানীয় জনগণের সমস্যা সমাধানের দাবিতে তিনি যখন অগ্রসরমাণ, তখন রাজনৈতিক গণ্ডির পরিধিতে ক্রমশ প্রবিষ্ট হতে থাকেন। গোপালগঞ্জে পড়াকালে যে স্বাধীনচেতা মনোভাব তৈরি হয়েছিল, কলকাতায় তা আরও প্রসারিত হয়। সেখানে ছাত্র আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। ১৯৩৯ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সান্নিধ্য তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় করে তোলে। সাহস ও যোগ্যতায় তিনি সমকালীন অনেককে ডিঙ্গিয়ে পাদপীঠে চলে আসেন। পূর্ববঙ্গের বাঙালি মুসলমানদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ১৯০৫ সালে মুসলিম লীগ। তখনকার সময়ের রাজনীতিতে শেখ মুজিব তার গুরু সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগে যোগ দেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর দেখেন পশ্চিম পাকিস্তানিরা শাসন ক্ষমতায় সর্বত্র। স্পষ্ট হয় যে, এক ব্রিটিশ শোষণ থেকে মুক্তি পেয়ে পাকিস্তানি বেনিয়া শোষকদের হাতে পড়েছে বাঙালি। রাষ্ট্রক্ষমতার কোথাও বাঙালির প্রবেশাধিকার নেই। এমনকি নিজেদের শাসন করার অধিকারটুকুও পাকিস্তানি শাসকরা কবজা করে রেখেছে। উপলব্ধি হলো, পূর্ববঙ্গবাসী দিন দিন দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়ে পড়ছে। শিক্ষা, চিকিৎসা, অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান—মানুষ এই মৌলিক অধিকারগুলো থেকেও বঞ্চিত। পূর্ববঙ্গের কৃষকের উৎপাদিত পাটসহ অন্যান্য পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে যে আয় হয়, তার পুরোটাই পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন ও শিল্পায়নে ব্যয় হচ্ছে। পূর্ববঙ্গের মানুষের জীবন আরেক পরাধীনতার শৃঙ্খলে বাঁধা পড়ছে। কৃষিজীবী, শ্রমজীবী মানুষের বেঁচে থাকার উৎসগুলো ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছে। বঙ্গবন্ধু স্পষ্ট করলেন যে, পূর্ব বাংলার মানুষ অনুভব করে যে, পূর্ববঙ্গকে পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ বানানো হয়েছে। পাকিস্তান আন্দোলনের কর্মী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মোহমুক্তি ঘটতে শেখ মুজিবের সময় লাগেনি। তাই মুসলিম লীগবিরোধী নতুন রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ যখন প্রতিষ্ঠিত হলো, তখন একজন নেতারূপে দেখা দিলেন শেখ মুজিব। গড়ে তুললেন শক্তিশালী বিরোধী দল। বইয়ে দিলেন দেশজুড়ে আন্দোলনের জোয়ার। সেই জোয়ার বাংলার মাঠ, ঘাট, প্রান্তরে প্রবাহিত হতে থাকে। স্বজাত্যবোধ ক্রমশ তৈরি হতে থাকে গণমানুষের মধ্যে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহারে মুসলিম লীগ যে পন্থা নিয়েছে, শেখ মুজিবসহ অন্য নেতারা এর বিরোধিতা করেন। পাকিস্তানকে ধর্মীয় রাষ্ট্র বানানোর নামে শোষণের পথকে আরও সুগম করার পাকিস্তানি মনোভাব ও তৎপরতার বিরুদ্ধে মওলানা ভাসানীকে নিয়ে সোচ্চার ছিলেন শেখ মুজিব। তাদের রাজনীতি বরাবরই অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ ছিল। তারা পূর্ববঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। সব ধর্মমতের ব্যক্তির রাজনীতিতে ও সংগঠনে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত করেন। দলের নাম থেকে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে করা হয় আওয়ামী লীগ। শেখ মুজিব ক্রমশ পূর্ববঙ্গে তার নেতৃত্ব ও সংগঠন সংহত করলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্যের কথা বললেন। তিনি উপস্থাপন করলেন ছয় দফা। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা শাসক তার জবাব দিল আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তৈরি করে। এতেই আগুনে ঘি পড়ল।
পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবকেই একমাত্র স্বার্থরক্ষক হিসেবে দেখল। ছাত্ররা ছয় দফাকে এগারো দফায় অন্তর্ভুক্ত করে নামে আন্দোলনে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে সামরিক শাসক আইয়ুব খান বিদায় নিলেন। শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন এবং হলেন বঙ্গবন্ধু। অর্থাৎ বাংলার বন্ধু। এমন যে হতে পারলেন তার কারণ বঙ্গবন্ধুর একাগ্রতা। বিশ্বাস না করে তিনি কোনো কথা বলেননি। যা বলেছেন, তা যথাসাধ্য পালন করেছেন; ভয়ে বা লোভে পড়ে আপস করেননি। ছয় দফার পক্ষে জনমত গঠন করতে গিয়ে এমন জায়গা নেই যেখানে তিনি গ্রেপ্তার হননি। আজ যশোর, কাল খুলনা, পরশু রাজশাহী, তার পরদিন সিলেট, তারপর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রামে গ্রেপ্তার হয়েছেন। জামিন পেতে যে সময়টুকু অপচয় হয়েছে, তারপর আরেক জায়গায় ছুটে গেছেন। আবার গ্রেপ্তার হওয়া, জামিন পাওয়া, অন্যত্র ছুটে যাওয়া। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পরিণাম কী হতে পারত, জানা নেই। তবে এটুকু জানি যে, আইয়ুব খান তাকে শাস্তি, এমনকি মৃত্যুদণ্ড দিতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। যেমন, একাত্তরে ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধুর জেলখানার পাশে কবর খুঁড়েছিলেন এবং মৃত্যুদণ্ড ঘোষণাও করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু কিন্তু এসবে ভীত হননি কখনো। কাপুরুষ হননি বলেই পৌরুষোচিত বীরত্ব ছিল চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিঘ্ন সৃষ্টির বহুচেষ্টা হয়েছিল। মওলানা ভাসানীও ভোটের আগে ভাত চেয়েছিলেন, ব্যালট বাক্সে লাথি মারতে বলেছিলেন। তেইশ বছরে পাকিস্তানে একবারও সাধারণ নির্বাচন হয়নি। এ কথা মনে রাখলে নির্বাচন না চাওয়া বিস্ময়কর মনে না হয়ে পারে না। নির্বাচন হলো এবং বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলেন। তার সমালোচকরা বলল, এবার তিনি আপস করবেন। কিন্তু আপস হয়নি। সারা পৃথিবী সংগ্রামের এক নতুন রূপ দেখেছিল। সেদিন এ সংগ্রামে সারা দেশের মানুষ তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধুর বয়স পঞ্চাশ বছর। তার চেয়ে বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ নেতা অনেক ছিলেন দেশে। মানুষ কিন্তু বঙ্গবন্ধুকেই তাদের নেতা বলে, তাদের স্বার্থের রক্ষক বলে জেনেছিল। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত অন্তত মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বিপুল ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের দোসর জুলফিকার আলি ভুট্টো ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র শুরু করে। বিজয়ী দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি তোলা হলেও তারা তাতে কর্ণপাত করেনি। আলোচনার টেবিলে পাকিস্তানিরা আপসের নানা ফর্মুলা দিলেও বঙ্গবন্ধু বাংলার মানুষের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে কোনো আপসে রাজি হননি। বঙ্গবন্ধু বুঝতেন, পাকিস্তানিদের সঙ্গে আর বসবাস সম্ভব নয়। জোড়াতালি দিলেও মেলানো যাবে না। সুতরাং, ছয় দফা দাবিকে সামনে রেখে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু এক দফা ঘোষণা করলেন এবং তা স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। সারা দেশ গর্জে উঠল সেই ডাকে। পাকিস্তানের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল বাংলাদেশ। বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে গেল ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামটি। উঠে এলো ‘বাংলাদেশ’ নামক একটি নতুন রাষ্ট্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে অসহযোগ আন্দোলনকালে পুরো জাতি যে একটি বিন্দুতে এসে স্থির-প্রত্যয়ী হয়ে ওঠে, তা হচ্ছে স্বাধীনতা। পূর্ব বাংলার মানুষ স্বাধিকারের দাবি থেকে স্বাধীনতার দাবিতে পৌঁছে গেছে ততদিনে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে। পশ্চিমা সংবাদপত্রে বলা হলো ‘ভয়েস অব বেঙ্গল’। সত্যিকার অর্থেই বঙ্গবন্ধু তখন বাংলার কণ্ঠস্বর। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি পুরো জাতিকে তার স্বাধীনতার জন্য করণীয় সম্পর্কে দিকনির্দেশনা দিলেন। এমন পূর্বাভাসও দিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তবে তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো।’ ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নিরস্ত্র মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বাঙালি নীরবে আক্রমণ মেনে নেয়নি। বঙ্গবন্ধু ‘প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে’ তোলার জন্য বলেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার জীবনদানের মধ্য দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন, তিনি তার দেশ, জাতি ও জনগণের প্রতি ছিলেন সৎ। তার সততা ছিল বাঙালির প্রতি, বাঙালির সংস্কৃতির প্রতি, বাঙালির স্বাধীনতার প্রতি। সততার মাত্রা তীব্র ছিল বলেই কোনোদিন রণক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যাননি। লড়াই করেছেন সাহসের সঙ্গে। গুলি বঙ্গবন্ধুর বুকেই লেগেছিল, পিঠে নয়।
লেখক : একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, মহাপরিচালক প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।