ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪

মুডির রেটিং নিয়ে যা জানাল বাংলাদেশ ব্যাংক

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৩:৪৪, ২৩ নভেম্বর ২০২৪

সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান ও নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠনের পরে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যেসব ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে তা আন্তর্জাতিক রেটিং এজেন্সি মুডি’র সাম্প্রতিক রেটিংয়ে সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি বলে দাবি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। 

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক শুক্রবার এক বিবৃতিতে উল্লেখ করেছে, পরিবর্তন সম্পর্কে মুডি যে রেটিং করেছে তা গাড়ি সামনে চলার সময় ‘রিয়ারভিউ মিরর দিয়ে দেখার’ সামিল।

গত ১৯ নভেম্বর মুডি বাংলাদেশের রেটিং বি১ থেকে নামিয়ে বি২ করেছে এবং বলেছে যে, স্বল্পমেয়াদি ইস্যুকারী রেটিং ‘নট প্রাইম’। রেটিং এজেন্সির দৃষ্টিভঙ্গি স্থিতিশীল অবস্থা থেকে নেতিবাচক হয়েছে। অবনতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মুডি অধিকতর রাজনৈতিক ঝুঁকি এবং নিম্নমুখী অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছে।

বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ছাত্র নেতৃত্বাধীন আন্দোলন ও ব্যাপক জনসমর্থনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ২০২৪ সালের জুলাইয়ে একটি ঐতিহাসিক রাজনৈতিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে গেছে। 

ছাত্র-নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলনের সমর্থনে ও সকল প্রধান রাজনৈতিক দলের সমর্থনে ২০২৪ সালের আগস্টে গঠিত নতুন অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ, গণতান্ত্রি নির্বাচন প্রক্রিয়া ও জনপ্রশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কার শুরু করেছে।  

অর্থনৈতিক ও আর্থিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক একটি ব্যাপক ভিত্তিক ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে- ব্যাঙ্কিং খাতে ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচি পরিচালনার লক্ষ্যে ব্যাংত সম্পদের ব্যাপক ভিত্তিক গুণমান পর্যালোচনা করার লক্ষ্যে তিনটি টাস্ক ফোর্স গঠন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম জোরদার ও অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা এবং দেশে-বিদেশে পাচার হওয়া সম্পদ পুনরুদ্ধারের পথ খুঁজে বের করা। 

একই সাথে সরকার অর্থনীতির পুনঃকৌশলীকরণ এবং ন্যায্য ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সম্পদ আহরণের জন্য একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠন করেছে। সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে পরামর্শের পর এই টাস্ক ফোর্স ইতোমধ্যে কার্যক্রম শুরু করেছে। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, অন্তর্বর্তী  সরকার সামষ্টিক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক  উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ পেয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে লেনদেনের ব্যাপক ভারসাম্যহীনতা, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত হ্রাস এবং দেশীয় মুদ্রার দ্রুত অবমূল্যায়নকারী বিনিময় হার। মূল্যস্ফীতির হারও বেড়েছে, যার ফলে নাগরিকদের কষ্ট হচ্ছে। গত চার মাসে বাহ্যিক খাতের সূচকগুলো স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জিত হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, ২০২৪ সালের আগস্ট থেকে বিনিময় হার প্রতি ডলার প্রায় ১২০ টাকায় স্থিতিশীল রয়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ের অব্যাহত বৃদ্ধির ফলে তা সম্ভব হয়েছে। প্রথম চার মাসে (জুলাই-অক্টোবর), বৈদেশিক চলতি হিসাব বড় ঘাটতি থেকে ভার্চুয়াল ব্যালেন্সে উন্নীত হয়েছে, আর্থিক পরিস্থিতিও বহিঃপ্রবাহের নেট অবস্থান থেকে বিশাল অন্তঃপ্রবাহের নেট অবস্থানে ফিরেছে এবং সামগ্রিক ভারসাম্য পরিস্থিতি জোরদার হয়ে এক বিলিয়ন ডলারের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি করা থেকে বিরত রয়েছে এবং এই সময়ের মধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ প্রায় ১৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে স্থিতিশীল হয়েছে। উল্লেখ্য, আগের সরকারের গত দুই বছরের লেনদেনের প্রেক্ষিতে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত ২.৫ বিলিয়ন ডলারের বকেয়া হয়েছিল- তিন মাসের মেয়াদে তা প্রায় ৪৫০ মিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এসব ইতিবাচক ফলাফল ইঙ্গিত দেয় যে, বাহ্যিক খাতের দুর্বলতাগুলো মোকাবেলা করা হয়েছে এবং বাংলদেশ ব্যাংকের বিচক্ষণ নীতির ফলে অব্যাহত রেমিট্যান্স প্রবাহ ও টেকসই রপ্তানি আয়ের মাধ্যমে আরও উন্নতি আশা করা হচ্ছে। 

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, আর্থিক খাত গুরুতর অব্যবস্থাপনা এবং পূর্ববর্তী প্রশাসনের সহায়তায় নির্দিষ্ট পরিবার বা গোষ্ঠীর দ্বারা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক আমানতের অর্থ পাচারের কারণে বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

বিবৃতিতে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ১১টি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠণ করে সিদ্ধান্তমূলকভাবে কাজ করেছে। এই ব্যাংকগুলোর পরিচালনা কার্যক্রম, তারল্য ব্যবস্থাপনা এবং কর্মক্ষমতা এখন প্রতিদিন নিরীক্ষণ করা হচ্ছে, যার ফলে এই ব্যাংকগুলোতে স্থিতিশীলতার প্রাথমিক লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ উদ্বৃত্ত ব্যাংকগুলোকে গ্যারান্টি প্রদান করেছে, যার ফলে তারা তারল্য-স্বল্পতা ব্যংকগুলোতে তারল্য সহায়তা দিতে সক্ষম হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অধিক অর্থ প্রদান করার প্রয়োজনীয়তা পরিহার করে এ পদক্ষেপ দুর্বল ব্যংকগুলোর তারল্য ব্যবস্থাপনাকে ইতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংক বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করেছে, দেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ, পিএলসি ইতিমধ্যেই তার গ্রাহকদের আস্থা অর্জন করেছে এবং উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ইতিবাচক নগদ প্রবাহ ও অধিক পরিমাণ রেমিট্যান্স পেয়েছে। তাই, অন্যান্য ব্যাংকের কাছ থেকে অতিরিক্ত তারল্য সহায়তার প্রয়োজন হবে না। গ্রাহকদের আস্থা পুনরুদ্ধার করে আরও কয়েকটি ব্যাংকও সেদিকে অগ্রসর হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তারা আরও কয়েকটি ব্যাংকের তারল্য সমস্যা সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও মার্কিন ট্রেজারির সহায়তায় তৈরি করা একটি ব্যাপক ব্যাংক রেজোলিউশন কৌশল নিয়ে কাজ করছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে যে, ব্যাংকিং ব্যবস্থায় কোনো পদ্ধতিগত ঝুঁকি নেই এবং কোনো সংক্রামক প্রভাবও থাকবে না। ব্যাংকিং খাতে পূর্ববর্তী সরকারের আমলে উদ্ভূত সংকটের ঝুঁকি অনেকাংশে প্রশমিত হয়েছে।

বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করা হয়েছে, ব্যাংকিং খাতের সূচকগুলো এখনও লক্ষণীয় উন্নতি প্রদর্শন না করলেও বাংলাদেশ ব্যাংক অদূর ভবিষ্যতে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আশা করছে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ও বিশ্বব্যাংকের (ডবি¬উবি) সহযোগিতায় ব্যাংকিং সংস্কার সংক্রান্ত টাস্কফোর্স সমস্যাযুক্ত ব্যাংকগুলোর সম্পদের গুণমান পর্যালোচনা (একিউআর) পরিচালনা করবে। এটি ডিসেম্বর ২০২৪ সালের প্রথম সপ্তাহে শুরু হবে। টাস্কফোর্স প্রাসঙ্গিক নির্দেশিকা ও নীতি ব্যবস্থাসহ ব্যাংকগুলোর জন্য একটি পুনরুদ্ধার ও রেজোলিউশন কাঠামো তৈরিতেও কাজ করবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নীতিনির্ধারকদের জন্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমাতে চাহিদা ও সরবরাহ উভয় ক্ষেত্রেই বাস্তবসম্মত নীতিগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।

চাহিদার দিক থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক সুদের হার নির্ধারণের নীতি পরিত্যাগ করে বাজার ব্যবস্থায় অবাধে নির্ধারণ করতে দেওয়ার মাধ্যমে মুদ্রানীতির অবস্থানকে কঠোর করেছে, সুদের হার কাঠামোতে বৃদ্ধি বজায় রাখতে অবদান রাখছে; রাজস্ব ঘাটতি পূরণের জন্য নতুন টাকা ছাপানো থেকে বিরত রয়েছে; তিনটি সমান মাসিক ধাপে পলিসি রেট অক্টোবরে ৮.৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হয়েছে; এবং বাজেট অর্থায়নের জন্য রাজস্ব ঘাটতি ও অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করার জন্য গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

সরবরাহের ক্ষেত্রে গৃহীত পদক্ষেপগুলো উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দামের মাত্রা কমাতে ও দামের চাপ নিয়ন্ত্রণে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এই পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে- সকল অর্থ প্রদানের বাধা দূর করে কৃষি উপকরণগুলোর নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য বৈদেশিক মুদ্রার অতিরিক্ত চাহিদা পূরণ করে বিভিন্ন সারের মজুদ সম্পূর্ণরূপে পূরণ করা হয়েছে; বিভিন্ন প্রয়োজনীয় পণ্যের ওপর কর ও আমদানি শুল্ক উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করা হয়েছে বা হ্রাসকৃত খরচে সরবরাহ বাড়াতে সহায়তা করার জন্য সম্পূর্ণভাবে বাদ দেওয়া হয়েছে; অ-বিলাসী সামগ্রীর ক্ষেত্রে সকল এলসি মার্জিন বাদ দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাংকগুলোকে প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের জন্য এলসি খোলার অগ্রাধিকার দেওয়ার এবং অভ্যন্তরীণ সরবরাহ চেইন-সম্পর্কিত বিকৃতি মোকাবেলা করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছে।

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বন্যার কারণে ফসল ও শাকসবজির ব্যাপক ক্ষতি ও সরবরাহ শৃঙ্খলে ব্যাঘাতের কারণে খাদ্য মূল্যস্ফীতি এখনও উচ্চ ও অস্থিতিশীল রয়েছে। তবে, খাদ্যের দামের চাপ থাকা সত্ত্বেও কম অস্থিতিশীল খাদ্য ছাড়া অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি অক্টোবর মাস পর্যন্ত টানা তিন মাস হ্রাস পেয়েছে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকার বিশ্বাস করে যে চাহিদা ও সরবরাহের সকল প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা বিদ্যমান রয়েছে এবং প্রত্যেককে অবশ্যই ট্রান্সমিশন মেকানিজমগুলো কাজ করার জন্য প্রয়োজনীয় সময় দিতে হবে এবং টেকসই পদ্ধতিতে মূল্যস্ফীতিকে ৫-৬ শতাংশের লক্ষ্যমাত্রায় নামিয়ে আনতে হবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংক উল্লেখ করেছে যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি একটি বড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং বিভিন্ন সরকারি পদক্ষেপের ইতিবাচক প্রভাব সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হতে আরও সময় লাগবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক আরও বলেছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আরও গতি সঞ্চার করতে আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সমর্থন ও আন্তর্জাতিক অংশীদারদের কাছ থেকে জোরালো সমর্থন প্রয়োজন।

বাংলাদেশ ব্যাংক আশা প্রকাশ করেছে যে, মুডি শীঘ্রই বাংলাদেশ সফরের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির আরও ব্যাপক মূল্যায়ন করবে এবং সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডার ও অভিজ্ঞ অর্থনৈতিক পর্যবেক্ষকদের সাথে পরামর্শ করে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জন করবে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ইতোমধ্যে গৃহীত নীতি, রেকর্ড করা উন্নয়ন এবং অদূর ভবিষ্যতে উন্মোচিত হতে পারে এমন অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমেই তারা একটি সঠিক ও বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করতে সক্ষম হবে। 

এএইচ


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি