মুলতবি হজ
প্রকাশিত : ১৭:১৮, ২২ নভেম্বর ২০১৯
হোদায়বিয়ার সন্ধির পর দেখতে দেখতে একটি বছর কেটে গেল। আকাশ-কোণে আবার জিলহজের চাঁদ দেখা দিল। সন্ধির শর্তানুসারে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) তাঁর সাহাবীদের নিয়ে এবার মুলতবি হজ সম্পন্ন করার মনস্থির করলেন।
রাসূল (সাঃ) এর নির্দেশে ২ হাজার মুসলিম হজের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত হলেন। কুরবানীর জন্য ৬০টি উট সঙ্গে নিয়ে মক্কার উদ্দেশ্যে যাত্রা করলেন।
সন্ধির শর্তানুসারে প্রত্যেক মুসলিম আত্মরক্ষার্থে একটি করে তরবারি সঙ্গে নেন, তাও আবার কোষবদ্ধ অবস্থায়। কিন্তু অতীতের ন্যায় কুরাইশরা বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে এমন আশঙ্কায় ২০০ মুসলিম সেনাকে অস্ত্রসস্ত্রসহ মক্কার বাহিরে একটি উপত্যকায় পাঠিয়ে দেন। সেখানেই তারা নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করেন।
রাসূল (সাঃ) আল কাসওয়া নামক উঠের পিঠে চড়ে সাহাবীদের নিয়ে ধীরে ধীরে মক্কায় প্রবেশ করলেন। মক্কায় প্রবেশ করেই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদের মুখে লাব্বায়েক! লাব্বায়েক ধ্বনিতে মুখরিত হতে থাকে মক্কা নগরী।
হজরতের মনে আজ কত ব্যাথা, কত আনন্দ। দীর্ঘ সাত বছর পর নিজ জন্মভূমিতে ফিরেছেন তিনি। এ সময় রাসূল (সাঃ) এর মনে সেই মক্কা, হেরা গুহা, দাদা আব্দুল মুত্তালিব ও প্রিয় স্ত্রী খাদিজার কথা মনে পড়ে গেল। রাসূল (সাঃ)কে কাছে পেয়ে মৃত মক্কা নগরী যেন নতুন রুপে প্রাণ ফিরে পেল।
এদিকে, মুহাম্মাদ (সাঃ) এর আগমনের কথা শুনে মক্কার কুরাইশরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আশ্রয়ে নেয় পার্শ্ববর্তী পর্বতে। এছাড়া যে তাদের কোনো জায়গা ছিল না। যে মুহাম্মাদ (সাঃ) ও তাঁর সাহাবীদেরকে সদলবলে হামলা করে নিজ জন্মভূমি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই তারাই আজ মক্কায় উপস্থিত হয়েছেন হজের উদ্দেশ্যে।
এমন দৃশ্য দেখতে তাঁরা কখনো প্রস্তুত ছিল না। রাসূল (সাঃ) যে, এভাবে মক্কায় হাজির হবে, তা তারা কল্পনাও করেনি। ফলে কোনো উপায় না দেখে, লোক লজ্জার ভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে পাহাড়ে আশ্রয় নেন।
রাসূল (সাঃ) সাহাবাদের নিয়ে নগরীর মূল কেন্দ্রে প্রবেশ করলেন। মুসলমানরা তাদের ফেলে যাওয়া ঘরবাড়ি ও পরিচিত স্থানগুলো ঘুরে ঘুরে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই মক্কার জন্য, শুধু মাত্র এক আল্লাহকে বিশ্বাস করার কারণে নিজ ভূমি ছাড়তে হয়েছিল তাদের। তাই তারা পূর্বের গৃহে না থেকে নতুন করে তাবু টাঙালেন।
তারপরও তাদের চোখে মুখে বিজয়ে হাসি। এতে করে তারা হুদায়বিয়ার সন্ধির গুরুত্ব ও সার্থকতা খুঁজে পেলেন।
মুহাম্মাদ (সাঃ) সাহাবাদের নিয়ে কাবা গৃহে প্রবেশ করলেন। হযরত বেলাল (রাঃ) সুমধুর কণ্ঠে আযান দিলেন। আযান শুনে মুসলিমরা দলে দলে কাবার কাছে আসেন। হৃদয় দিয়ে আযান শুনতে থাকেন। কারো কারো চোখে অশ্রু বেয়ে পড়ছিল। এদিনের জন্য তাদের কত নির্যাতন ও নিপীড়নের শিকার হতে হয়েছে।
রাসূল (সা) সবাইকে নিয়ে যোহরের নামাজ আদায় করলেন। চতুর্দিকে প্রতিমাগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। দূর থেকে কোরাইশরা মুসলিমদের সে দৃশ্য দেখছিলেন। এতে করে তারা বড় বিচলিত হয়ে পড়েন। মুসলিমদের উত্যক্ত করতে থাকেন। বিবাদ লাগোনোর চেষ্টা করেন। কিন্তু রাসূল (সাঃ) এর সহনশীলতায় তারা ব্যর্থ হন।
যথারীতি মুসলমানরা হজ সম্পন্ন করলেন। সাফা ও মারওয়া পর্বত সাতবার প্রদক্ষিণ করে উটগুলোকে কুরবানি দিলেন। এমনিভাবে তিন দিন চলে গেল। চতুর্থদিনে কোরাইশরা রাসূল (সাঃ) কে সাহাবীদের নিয়ে মক্কা ত্যাগ করতে বললেন। তিনি তাই করলেন।
কী অপূর্ব সত্যনিষ্ঠা। কোরাইশদের নিকট তিনি যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তা তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। আপন বাসভূমি, আত্মীয় স্বজন সবকিছু পড়ে রইলো। রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা সেদিকে কোনো ভ্রক্ষেপই করলেন না।
বিদায় বেলায় আত্মীয়-স্বজনের প্রেম তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকলো। আকাশ তাদেরকে স্নেহের পরশ বুলিয়ে গেল। কত স্মৃতি, কত আকর্ষণ তাদের মনে দোলা দিয়ে গেল। কিন্ত তারা নির্বিকার।
ইচ্ছে করলেই রাসূল (সাঃ) ও তাঁর সঙ্গীরা প্রতিশোধ নিতে পারতেন। কিন্তু তা তাঁরা করলেন না। সত্য একদিন বিজয় হবেই, সে লক্ষ্যে পুনরায় মক্কা ত্যাগ করলেন।
কিন্তু এই ক্ষুদ্র সময়ে আরো একটি ঘটনা ঘটে গেল। রাসূল (সাঃ) যে তিন দিন মক্কায় অবস্থান করছিলেন, সে তিনদিন কারো গৃহে প্রবেশ করেননি তিনি। কিন্তু কোরাইশদের অনেকের সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছিল।
সেই সূত্রে মায়মুনা নাম্নী জৈনিক দূরসম্পর্কীয় আত্মীয় বিধবা রমণী হযরতকে বিয়ের প্রস্তাব করেন। রাসূল (সাঃ) তা গ্রহণ করেন। মায়মুনাকে তিনি সঙ্গে করে মদিনায় নিয়ে যান।
এ বিবাহের এক আশ্চর্য ফল ঘটে। বীর সেনা খালিদ বিন ওয়ালিদ ছিলেন মায়মুনার আপন ভগিনীর পুত্র। এই খালিদের অসাধারণ বীরত্বে ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটেছিল। মায়মুনার বিয়ের পরেই অপ্রত্যাশিতভাবে খালিদ বিন ওয়ালিদ ইসলাম গ্রহণ করেন।
শুধু খালিদ নন, সে সময়ে প্রখ্যাত কবি আমর ইবনুল আ’স ও কাবা গৃহের কুঞ্জি রক্ষক ওসমান বিন তালহা। এ তিনজনের ইসলাম গ্রহণের পর কোরাইশদের মেরুদণ্ড যেন ভেঙে পড়ে।
রাসূল (সাঃ) মক্কায় হজে গিয়ে কোরাইশদের প্রকৃত অবস্থা পর্যালোচনা করেন। তাদের দুর্বলতা সচক্ষে দেখেন তিনি। একমাত্র আবু সুফিয়ান ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনো উল্লেখযোগ্য নেতা নেই, তাদের মধ্যে কোনো একতা নেই, সে সত্য আর গোপন রইলো না। রাসূল (সা.) বিজয়ের অপেক্ষায় প্রহর গুণতে লাগলেন। যা এক সময় মক্কায় বিজয়ের দ্বার উম্মোচন করে দেয়।
এআই/এসি