মুসফিক, দ্য আনসাং রেইডার
প্রকাশিত : ০৩:৪৭, ৮ সেপ্টেম্বর ২০২১
রাত আনুমানিক আড়াইটা। চেলাছড়া, দিঘীনালা, খাগড়াছড়ি।
দীর্ঘ চার ঘণ্টা হেঁটে অবশেষে লেফটেন্যান্ট মুসফিক তার সতেরজন রেইডার্স আর একজন সোর্সসহ টার্গেট এলাকায় এসে পৌঁছুলেন। লক্ষীছড়ি ক্যাম্প থেকে বেরুবার পর পথে সাতটা ছড়া আর ছয়টা উঁচু পাহাড় পেড়িয়ে আসতে হয়েছে। অবশ্য সোর্স রাস্তাটা বেশ ভাল করেই চিনত বলে দূরত্বের তুলনায় সময় বরং কমই লেগেছে বলা চলে।
গঙ্গারামছড়া পার হয়েই রেইডার্সরা সবাই এক ফাঁকে অস্ত্রের নল আর বাটে লাগা কাদাবালি পরিস্কার করে নিয়েছে। সিদ্দিকছড়ি ক্যাম্প থেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট সাইদের দলটাও ইতোমধ্যে উল্টাছড়ি গ্রামের পাশদিয়ে বয়ে চলা খালের পশ্চিম পাড়ে পজিশন নিয়েছে বলে ওয়্যারলেসে জানা গেছে। পরিস্থিতি কোন কারণে মুসফিকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে সাইদ এগিয়ে আসবে।
গা ছমছমে অন্ধকার ভেদ করে মুশফিক সামনের বিশাল পাহাড়ের গায়ে লুকানো জুম ঘরটা সনাক্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। আকাশটা আজ কিছুটা মেঘলা বলেই অপারেশনটা প্ল্যান করা, যেন প্রতিকুল আবহাওয়ার সুযোগে শত্রুর অগোচরে টার্গেটের খুব কাছাকাছি যাওয়া যায়। আঁধার অবশ্য দ্বিমুখী, নিজেদের দৃষ্টিসীমাও কমিয়ে দেয়। যাহোক, অবশেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সোর্সকে ইশারায় পাশে ডাকলেন। এবার সোর্সের সহায়তায় দু’টো জুমঘর সনাক্ত করা গেল; একটা পাহাড়ের পাদদেশেই, আরেকটা প্রায় চূড়ার কাছাকাছি।
প্ল্যানমতই সব এগুচ্ছিল। মুসফিক নিজে হাবিলদার মেজবাহর ৫ জনের উপদলটাকে পাহাড়ের পাদদেশের টার্গেটের কাছে পজিশনে বসিয়ে দিয়ে মূলদলের কাছে ফিরে এলেন। এবার হাবিলদার নজরুলের ৬ জনের রিজার্ভ পার্টিটাকে পজিশনে পৌঁছে দিয়ে বাকি ৫ জন নিয়ে মুসফিক রওয়ানা দিলেন পাহাড়ের চূড়ার মুল টার্গেটের উদ্দেশ্যে।
প্রায় চল্লিশ মিনিট খুব সন্তর্পনে পাহাড় বেয়ে উঠার পর মুশফিকেরা থামলেন। এবার মাটি কামড়ে প্রায় নিঃশব্দে ক্রল করতে করতে পৌছে গেলেন জুমঘরের পাঁচ গজের চৌহদ্দিতে। উত্তেজনা আর ক্লান্তিতে ফুঁপিয়ে উঠতে চাওয়া ফুসফুসটাকে দমিয়ে রেখে মুসফিক সবাইকে ইশারা করলেন আড়াআড়িভাবে ছড়িয়ে পড়তে। মুহুর্তের ভেতর প্রশিক্ষিত রেইডার্সরা এক্সটেন্ডেড লাইনে পজিশন নিয়ে ফেললেন। সবাই যখন অন্ধকার চিরে আঁতিপাঁতি করে শত্রুর অস্তিত্ব খুঁজছেন; ঠিক তখনি হঠাৎ আকাশে বিদ্যুত চমকে উঠল।
লে. মুসফিকের প্রাপ্তি কিছু মেডেল ও তার স্মৃতি
দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দটা কান পর্যন্ত আসার আগেই তারা ও প্রতিপক্ষ একে অপরকে দেখতে পেল। কে আগে গুলি ছুড়ল তা জানার উপায় নেই। মিনিটখানেকের জন্য যেন নরক ভেঙ্গে পড়ল চেলাছড়ার ঐ পাহাড় চূড়ায়। মুখোমুখি মাজল ফ্ল্যাশ আর বুলেটের বৃষ্টি ছাপিয়ে কর্ডাইটের গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে উঠল। মুসফিকের নল থেকেই হয়ত প্রথম বুলেটটা বেরিয়েছিল, তাই প্রতিপক্ষের প্রথম পশলা বুলেট তার দিকেই ধেয়ে এল। প্রায় পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ, তাই কাভারের দিকে ঝাঁপিয়ে পরেও শেষ রক্ষা হলনা।
আহত মুসফিকের কথা ভেবে মুহুর্তের জন্য সব রেইডার্সদের ট্রিগারে রাখা আঙ্গুল যেন স্রেফ জমে গেল। দাঁতে দাঁত চেপে বুক বেয়ে উঠে আসা তীব্র যন্ত্রণাটাকে গিলে ফেলে মুসফিক ‘ফায়ার’ বলে চিৎকার করলেন। পরের পাঁচ মিনিটে রেইডার্সরা যেন ঝুলে থাকা অন্ধকারটাকেই গুলিতে গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিতে চাইল!
গুলাগুলি শেষে রেইডার্সরা সবাই মুসফিকের দিকে এগিয়ে আসতে চাইলে তিনি নিজেই নিজের ক্ষত চেপে ধরে আগে অন্য সবাইকে নিরাপদে উপরে উঠে আসার নির্দেশ দিলেন। আলো না জ্বেলেই সবাই টার্গেটের চারপাশ ক্লিয়ার করে নিয়ে অলরাউন্ড ডিফেন্স নিলেন। সার্চ পার্টি দুটো রাইফেল, এসএমসি আর গোলাবারুদসহ জলপাই রঙের শান্তিবাহিনীর ইউনিফর্ম পরা তিনটি মৃতদেহ পেল; দুজন পাহাড়ের চূড়ার টার্গেটে আর এক জন নিচের টার্গেটে। বাকিরা পালিয়েছে।
গুলির শব্দ শুনে ততক্ষণে সাইদ তার দল নিয়ে এগিয়ে আসতে শুরু করেছেন। সহ রেইডার্সদের মুখ দেখেই মুসফিক ইতোমধ্যে যা বোঝার তা বুঝে নিলেন। হাবিলদার নজরুলকে বললেন সাইদের দল কাছাকাছি এলেই যেন ট্রেসার রাউন্ড ফায়ার করে পথ দেখিয়ে আনার ব্যবস্থা করেন। ৩ টা বেজে ৪০ মিনিটে মুসফিকের অপারেটর আর অনুমতির তোয়াক্কা না করেই হেলিকপ্টার পাঠানোর জন্য মেসেজ দিলেন।
ভোর সাড়ে পাঁচটায় সাইদ যখন পৌঁছুলেন, মুসফিক ততক্ষণে অত্যধিক রক্তক্ষরণে অনেকটাই নির্জীব। সাইদ কালবিলম্ব না করে হেলিপ্যাড বানাতে ছুটলেন। দূর চট্টগ্রামের ১নং স্কোয়াড্রনের রানওয়েতে একটা হেলিকপ্টারের রোটর তখন ঘুরতে শুরু করেছে; পাইলট সেই রাত চারটা থেকে ককপিটে বসে ভোরের আলো ফোটার অপেক্ষায় আছেন।
লে. মুসফিকের একটি পোট্রেট
হাবিলদার মেজবাহ হন্যে হয়ে আরো উঁচু একটা বাঁশ খুঁজছেন, যেন পাইলট উইন্ড শকসটা খুঁজে পেতে দেরি না করে ফেলেন। সাইদ নিজেই ওয়্যারলেস সেট আঁকড়ে ধরে ক্যাম্পের ডাক্তারের কাছ থেকে জানার চেষ্টা করে যাচ্ছেন, যেন করণীয় কিছুই করা বাদ না পরে। ফুল থ্রটলে একটা হেলিকপ্টার মেঘ ভেঙ্গে এগিয়ে আসছে। সাতক্ষীরার ছেলে মুসফিক সুদূর পার্বত্য চট্টগ্রামের অচেনা এক সবুজ পাহাড়ে তার রানারের কোলে মাথা রেখে মৃত্যুর প্রতীক্ষায়। অসহায় রানার থেমে থেমে অক্ষেপে বলে উঠছে, ‘গুলিটা আমার গায়ে ক্যান লাগল না স্যার?’
আঁধার কেটে গিয়ে দিবালোক যখন প্রখরতর হয়ে উঠছে, মুমূর্ষু মুসফিকের চারপাশে তখন নিকষ আঁধার ঘনিয়ে আসতে শুরু করেছে। প্রথমে মা, তারপর বাবার মুখ ভেসে উঠল; তারওপরে আঁধার মেঘ ফুঁড়ে তিনটা চেনা মুখ উঁকি দেয়; হাতছানি দিয়ে ডাকে হাবিলদার হারুন, ল্যান্স নায়েক সুনিল আর ডিএমটি নাজমুল হুদা। আজ থেকে ঠিক নয় দিন আগে বাগাইহাট থেকে ১০ নম্বর ক্যাম্পে যাবার পথে এই শান্তিবাহিনীর পুঁতে রাখা বোমা বিস্ফোরণে এরা তিনজন প্রাণ হারিয়েছিল। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে, তবু অঝোর কান্নায় ভেঙ্গে পরা রানারকে সান্ত্বনা দিতে মুসফিক বলে উঠেন, ‘তোমার তো সংসার আছে, পরিবার আছে, তুমি মারা গেলে তাদের কি হবে? আমি মরলে এদেশের কারো কোন ক্ষতি হবে না।’
০৮ সেপ্টেম্বর ১৯৮৯, সকাল ৮টা বেজে ১৫মিনিট। হলুদ উইন্ড শকসটা পতপত করে উড়ছে, দূর দিগন্তে হন্তদন্ত হয়ে উড়ে আসা হেলিকপ্টারটা ক্রমশ বড় দেখাচ্ছে। মুসফিক ততক্ষণে হারুন, সুনীল আর নাজমুল হুদাদের সাথে মেঘেদের দেশে। সাতক্ষীরায় মুসফিকের মায়ের আজ কেন জানি বড্ড অস্থির লাগছে...
পুনশ্চঃ
পার্বত্যাঞ্চলে ইনসার্জেন্সি মূলত পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর অতি ক্ষুদ্র অংশের অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ। ‘শান্তিবাহিনী’ নামে নৃশংস আর দুর্ধর্ষ এক সশস্ত্র ইন্সার্জেন্ট বাহিনী প্রতিষ্ঠার পর থেকেই একের পর এক পরিকল্পিতভাবে হত্যা করছিল অসংখ্য নিরীহ ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, বাঙালী আর নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। ২০১৫ পর্যন্ত সন্ত্রাসীরা পার্বত্য চট্টগ্রামে ২০৯৬ জনকে হত্যা, ১৮৮৭ জনকে আহত এবং ২১৮৮ জনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। বর্তমানে একই ধরনের কার্যক্রম ইউপিডিএফ, জেএসএস এবং সংস্কারবাদী দলের সন্ত্রাসীরা সবাই মিলে করছে।
এ সকল ইনসার্জেন্টদের উৎখাতের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সাল থেকে সেখানে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালিত হয়ে আসছে। শান্তি চুক্তির পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্যাঞ্চলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত ঝু্ঁকিপূর্ণ। দেশের অখণ্ডতা ও স্বার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে সেনাবাহিনী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অনেক সদস্যকে জীবন দিতে হয়েছে, অনেকে বরণ করে নিয়েছে স্থায়ী পঙ্গুত্ব।
২০১৫ সালের জুন মাস পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসীদের আক্রমণে নিরাপত্তা বাহিনীর ৩৫৩ জন প্রাণ দিয়েছেন, আহত হয়েছেন ৪৫২ জন এবং ম্যালেরিয়া ও অন্যান্য রোগে প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২৫৫ জন।
পার্বত্য চট্টগ্রামের নিরাপত্তা এবং শান্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এভাবেই প্রাণ আর রক্ত দিয়ে গিয়েছেন আমাদের বীর সেনানিরা। তারা আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। তাদের দেশপ্রেম, ত্যাগ, বীরত্বগাঁথা ও চেতনাই আজকের নতুন প্রজন্মের সামনে এগিয়ে চলার পাথেয়।
বি:দ্র: লেখাটি মেজর দেলোয়ার হোসেনের বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।