মৃত্যু সর্ম্পকে পবিত্র কোরআন কি বলে?
প্রকাশিত : ১৯:৩১, ১৪ মে ২০২০ | আপডেট: ১৬:৪৬, ১৫ মে ২০২০
মৃত্যু নিশ্চিত তাতে কোন সন্দেহ নেই। অথচ অধিকাংশ মানুষ তা থেকে গাফেল। একজন মুসলিমের করণীয় হল, মৃত্যুর কথা বেশী বেশী স্মরণ করা এবং তার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা। অনুরুপ ভাবে দুনিয়াতে থাকতে সময় ফুরিয়ে যাওয়ার পূর্বেই আখেরাতের পাথেয় সঞ্চয় করা।
মনে রাখতে হবে, প্রতিটি মানুষ মরণশীল। ক্ষণস্থায়ী পৃথিবীতে স্থায়ী নয় কেউ-ই। দুনিয়ার টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, পরিবার-পরিজন, বন্ধু-বান্ধব সবাইকে ছেড়ে একদিন পাড়ি জমাতে হবে ওপাড়ে। যেখানে বন্ধু হবে না কেউ, হবে না শত্রুও। নিজেকেই নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।
পবিত্র কোরআন শতাব্দীর পর শতাব্দী জীবন ও জগৎ সম্পর্কে কোটি কোটি মানুষের অন্তর্দৃষ্টি খুলে দিয়েছে, বদলে দিয়েছে ভেতর থেকে, খুলে দিয়েছে তাদের সম্ভাবনার দ্বার, দিয়েছে প্রশান্ত ও পরিতৃপ্ত জীবন। এই জীবনের সঙ্গে মৃত্যুও যে জড়িত তাও উল্লেখ রয়েছে আল-কোরআনে।
এবার দেখে নেওয়া যাক আল-কোরআনে মৃত্যু নিয়ে কি কি বলা আছে-
‘নিশ্চয়ই মৃত্যুর সময় নির্ধারিত। আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কারো মৃত্যু হতে পারে না। কেউ পার্থিব পুরস্কারের জন্যে কাজ করলে তাকে তার পুরস্কার ইহকালে দান করবো। আর যদি কেউ পরকালের জন্যে কাজ করে তবে তার পুরস্কার সে পরকালে পাবে। শোকরগোজার বান্দাদের কাজের ফল আমি নিশ্চয়ই দেবো।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৪৫]
‘সত্যের পথে তোমরা স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করো বা নিহত হও, তোমরা আল্লাহর কাছেই সমবেত হবে।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৫৮]
‘প্রতিটি প্রাণকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে। মহাবিচার দিবসে তোমাদের সবাইকে কর্মফল পুরোপুরিই দেয়া হবে। সফল মানুষ হবে সে-ই, যাকে লেলিহান আগুন থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে দাখিল করা হবে। আর শুধু পার্থিব জীবন তো এক মরীচিকাপূর্ণ ভোগ-বিভ্রম ছাড়া কিছুই নয়।’ [সূরা আলে ইমরান, আয়াত ১৮৫]
‘এই পৃথিবীতে সবই ধ্বংসশীল।’ [সূরা আর রহমান : ২৬]
‘চিরন্তনতা তো তোমার পূর্বের কোন মানুষের জন্য সাব্যস্ত করে দেইনি।’ [সুরা আম্বিয়া : ৩৪]
‘তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও।’ [সুরা নিসা : ৭৮]
৬৬. ‘(বুঝতেই পারছ) আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। আবার তিনিই তোমাদেরকে পুনরুত্থিত করবেন। তারপরও মানুষ অতি-অকৃতজ্ঞ!’ [সূরা হজ]
৫৫-৫৬. ‘ওরা কি মনে করে যে, ওদের যে (যোগ্যতা, মেধা, কর্মক্ষমতা) সম্পদ ও সন্তানসন্ততি দান করেছি, তা শুধু বৈষয়িক সাফল্য লাভে প্রতিযোগিতা করার জন্যে? এটাই সৎকর্ম? না, তা নয়! ওরা আসলে বুঝতে পারছে না (এটাই ওদের একটা পরীক্ষা)!’ [সূরা মুমিনুন]
৫. ‘(আল্লাহ বলেন) হে মানুষ! পুনরুত্থানের সত্যতার ব্যাপারে তুমি কি সন্দিগ্ধ? তবে একটু সময় নিয়ে চিন্তা করে দেখ—আমি তোমাদের সৃষ্টি করেছি ধুলোমাটি থেকে, তারপর শুক্রবিন্দু থেকে, তারপর নিষিক্ত ডিম্ব থেকে, তারপর (বিকাশমান) ভ্রূণ—পূর্ণ বা অপূর্ণ মাংসপিণ্ড থেকে। তোমাদের নিকট প্রকৃত সত্য সুস্পষ্ট করার জন্যেই (এ বর্ণনা)। আমি যে শুক্রাণুকেই ইচ্ছা করি, নির্দিষ্টকাল পর্যন্ত জরায়ুতে স্থিতিশীল রাখি। তারপর শিশুরূপে ভূমিষ্ঠ করি। তারপর কালক্রমে পরিণত বয়সে উপনীত করি। যৌবন আসার আগেই কারো কারো মৃত্যু হয়, আবার কাউকে কাউকে নিষ্কর্মা বয়স পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখা হয়। ফলে একসময় সে যা খুব ভালোভাবে জানত, তা-ও ভুলে যায়। (হে মানুষ! এরপরও যদি পুনরুত্থান সম্পর্কে তোমার কোনো সন্দেহ থাকে, তবে বিবেচনা করো জমিনের কথা) তুমি দেখ নিষ্প্রাণ শুষ্ক মাটি। তারপর আমি বৃষ্টিবর্ষণ করলে মাটিতে শিহরণ জাগে। অঙ্কুরিত হয় উদ্ভিদ লতাগুল্ম। প্রান্তর হয়ে ওঠে সবুজ শস্যশ্যামল। ৬. এসব ঘটার কারণ হচ্ছে, আল্লাহই একমাত্র চূড়ান্ত সত্য। তিনি মৃতকে জীবন দান করেন। তিনি সর্ববিষয়ে সর্বশক্তিমান।’ [সূরা হজ]
৮. ‘হে নবী ওদের বলুন, যে মৃত্যু থেকে তোমরা পালাতে চাচ্ছ, তোমাদেরকে সে মৃত্যুর মুখোমুখি হতেই হবে। শেষ পর্যন্ত তোমাদেরকে হাজির করা হবে দৃশ্য ও অদৃশ্যের পরিজ্ঞাতা আল্লাহর কাছে। জীবদ্দশায় যা করেছ, তা তোমরা তখন পুরোপুরি জানতে ও উপলব্ধি করতে পারবে।’ [সূরা জুমআ, আয়াত ৮]
৯. ‘যে ব্যক্তি রাতে সেজদায় অবনত হয়ে বা দাঁড়িয়ে ইবাদত করে, আখেরাতের জবাবদিহিতা নিয়ে শঙ্কিত থাকে এবং প্রতিপালকের রহমত প্রত্যাশা করে, সে কি কখনো তার সমান হতে পারে, যে এসব কিছুই করে না? বলো, ‘যারা জানে আর যারা জানে না (অর্থাৎ জ্ঞানী ও মূর্খ) তারা কি কখনো সমান হতে পারে?’ শুধু সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারীরাই সৎ-উপদেশ গ্রহণ করে।’ [সূরা জুমার]
৪২. ‘আল্লাহ মৃত্যু এলে বা ঘুমের সময় আত্মাকে তুলে নেন। তারপর যার মৃত্যু অবধারিত তার আত্মা রেখে দেন। আর অন্যদের আত্মা নির্দিষ্ট সময়ের জন্যে ফিরিয়ে দেন। সহজাত বিচারবুদ্ধি প্রয়োগকারীদের জন্যে এর মধ্যে শিক্ষণীয় নিদর্শন রয়েছে!’ [সূরা জুমার, আয়াত ৪২]
১৯-২৪. ‘তোমার প্রতিপালকের কাছ থেকে তোমার ওপর যে কিতাব নাজিল হয়েছে, তাকে যে সত্য বলে জানে আর যে (ব্যক্তি এই মহাসত্যের ব্যাপারে) অন্ধ, তারা দুজন কি কখনো সমান হতে পারে? অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন মানুষেরাই উপদেশ গ্রহণ করে। তারা (এক) আল্লাহকে প্রদত্ত অঙ্গীকার রক্ষা করে এবং কখনো চুক্তিভঙ্গ করে না। (দুই) আল্লাহ যে-সম্পর্ক বহাল রাখার নির্দেশ দিয়েছেন, তা বহাল রাখে। (তিন) প্রতিপালকের কাছে জবাবদিহিতার ব্যাপারে শঙ্কিত থাকে। (চার) প্রতিপালকের সন্তুষ্টির জন্যে যে-কোনো বিপদে ধৈর্যধারণ করে। (পাঁচ) নামাজ কায়েম করে। (ছয়) তাদের যে জীবনোপকরণ দেয়া হয়েছে, তা থেকে গোপনে ও প্রকাশ্যে অন্যের জন্যে ব্যয় করে। (সাত) ভালো কাজ দিয়ে মন্দের প্রতিকার করে। পরকালের সাফল্য এদের জন্যেই নির্দিষ্ট, তারা স্থায়ী জান্নাতে প্রবেশ করবে। তাদের পিতামাতা, পতি-পত্নী, সন্তানসন্ততিদের মধ্য থেকে যারা সৎকর্মশীল, তারাও তাদের সাথে জান্নাতে প্রবেশ করবে। আর প্রত্যেক তোরণে ফেরেশতারা তাদের স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে বলবে, তোমাদের ওপর শান্তি— বর্ষিত হোক, দুনিয়ায় তোমরা সবর করেছিলে। এখন তোমাদের স্থায়ী আবাস জান্নাত কতই না মনোহর!’ [সূরা রাদ]
২. তিনিই তোমাদের মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তোমাদের জীবনচক্র নির্দিষ্ট করেছেন আর একটি সুনির্দিষ্ট সময় (মৃত্যু ও পুনরুত্থান) সম্পর্কে শুধু তিনিই জানেন। তারপরও তোমরা সন্দেহ করো। ৩. অথচ মহাকাশ ও পৃথিবীর তিনিই আল্লাহ (একক ও অদ্বিতীয়)। তোমাদের গোপন ও প্রকাশ্য সবকিছুই তিনি জানেন। আর তোমরা নিজেদেরকে কী পাওয়ার উপযুক্ত করছ, সে-সম্পর্কেও তিনি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। [সূরা আনআম : ২]
আপনি কি চাননা মু’মিন হয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিতে। মু’মিনের বিদায়লগ্ন হয় অত্যান্ত আনন্দের। পক্ষান্তরে কাফির, জালিম সম্প্রদায়ের বিদায়লগ্ন হয় অত্যান্ত ভয়ংকর। মু’মিনের নিকট যখন মৃত্যু আসে, তখন মৃত্যুর ফেরেশতা সুন্দর মনোহর রুপ ও আকৃতি নিয়ে উপস্থিত হোন। সুগন্ধে ভরে যায় পরিবেশ। আর তার সাথে থাকেন রহমতের ফেরেশতা, যারা উক্ত ব্যাক্তিকে জান্নাতের সু-সংবাদ দেন।
আল্লাহ বলেন, ‘নিশ্চয় যারা বলেঃ আমাদের প্রতিপালক ও মালিক আল্লাহ এবং তারা এর উপর সুদৃঢ় ও অটল থাকলো, নিঃসন্দেহে তাদের জন্য ফেরেশতা অবতরণ ক’রে বলেন, ভয় পেয়োনা, চিন্তা করোনা আর সেই জান্নাতের সুসংবাদ পেয়ে সন্তুষ্ট হও, তোমাদের নিকট যার অঙ্গীকার করা হয়েছে।’ [সূরা হা-মীম -আসসাজদাহ : ৩০]
পক্ষান্তরে যারা ম’মিন হতে পারল না তাদের কাফের অবস্থায় মৃত্যুবরন করবে তাদের কাছে মৃত্যুর ফেতেশতা ভীতিপ্রদ আকৃতি ধারন করে ও কালো চেহারা নিয়ে আসেন এবং তার সাথে থাকে আযাবের ফেরেশতা যারা তাকে আযাবের দুঃসংবাদ দেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘তুমি যদি দেখতে পেতে (ঐ সনয়ের অবস্থা) যে সময় যালিমরা সম্মুখিন হবে মৃত্যু যন্ত্রনায়; আর ফেরেশতারা হাত বাড়িয়ে বলবেঃ নিজেদের প্রানগুলো বের কর, আজ তোমাদেরকে সেসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে লাঞ্চনাময় শাস্তি দেয়া হবে যে, তোমরা আল্লাহর উপর মিথ্যা দোষারোপ করে অকারন প্রলাপ বকছিলে এবং তার আয়াতসমূহ কবূল করা হতে অহংকার করছিলে।’ [সূরা আল-আন’আম : ৯৩]
মৃত্যু এলে বাস্তব সত্য উন্মোচিত হয়ে যাবে এবং আসল তত্ত্ব প্রত্যেক মানুষের কাছে সু-সস্পষ্ট হয়ে যাবে।
আল্লাহ বলেন, ‘যখনই তাদের কারো মৃত্যু উপস্থিত হয় তখন সে বলেঃ হে আমার প্রতিপালক! আমাকে পুনরায় ফেরত পাঠান। যাতে আমি সৎকর্ম করতে পারি যা আমি পূর্বে করিনি; না এটা হবার নয়; এটা তার একটা উক্তি মাত্র; তাদের সামনে বারযাখ (পর্দা, প্রতিবন্ধক, অন্তরায়) থাকবে পুনরুত্থান দিবস পর্যন্ত।’ [সুরা মু’মিনুন : ৯৯-১০০]
মৃত্যু এলে কাফের ও পাপী লোক ভাল ও সৎ কাজ করার জন্য পুনরায় পার্থিব জীবনের দিকে ফিরে যেতে চাইবে কিন্তু সময় শেষ হওয়ার পর অনুশোচনা কোন কাজে আসবে না।
আল্লাহ বলেন, ‘তুমি দেখবে পাপাচারীরা যখন আযাব প্রত্যক্ষ করবে, তখন তারা বলবে আমাদের ফিরে যাওয়ার কোন উপায় আছে কি?’ [সূরা আশ শুরা : ৪৪]
‘আমি বিধান দিয়েছি যে, মৃত্যু সব সময় তোমাদের মাঝে অবস্থান করবে। আর তোমাদের অস্তিত্বের প্রকৃতি পরিবর্তন বা তোমাদের জানা নেই, এমন আকৃতিতে তোমাদের সৃষ্টি করা থেকে আমাকে বিরত রাখার শক্তি কারো নেই।’ [সূরা ওয়াকিয়া, আয়াত ৬০-৬১]
‘হে মানুষ! আমিই জীবন দান করি। আমিই মৃত্যু ঘটাই। আমার কাছেই সবাইকে ফিরে আসতে হবে। যেদিন জমিন বিদীর্ণ হবে এবং মৃত্যুরা উত্থিত হয়ে ছুটতে থাকবে, তখন তাদের সমবেত করা খুব সহজ একটি কাজ।’ [সূরা কাফ, আয়াত ৪৩-৪৪]
এসএ/