মৃত্যুভয় বনাম মৃত্যুজয়
প্রকাশিত : ১১:৫৯, ১২ এপ্রিল ২০২০ | আপডেট: ১৬:৩১, ১২ এপ্রিল ২০২০
গোটা বিশ্বের প্রায় সাতশ কোটি মানুষের বেশির ভাগ এখন হয়ত করোনা মহামারী বা মৃত্যু নিয়ে ভেবেই সময় কাটাচ্ছেন। করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯ অন্তত এই একটি বিষয়ে বিশ্ববাসীকে একমতে আনতে সক্ষম হয়েছে। এর আগে সম্ভবত বিশ্ববাসী কখনও অন্তত একটা বিষয়ে এক হতে পারেন নাই বা ঐক্যমতে আসেন নাই। করোনায় সবাই এক হয়েছি, ঘরে থাকছি, পরস্পরে সহমর্মী হয়েছি, স্রষ্টাকে স্মরণ করছি। চরম অসহায়ের ন্যায় বিনয়ের সঙ্গে আরও কতকিছু যে করছি তার হিসেব নেই। শুধু মৃত্যু থেকে বাঁচতে, সুস্থ থাকতে বেঁচে থাকার আকুতির যেন শেষ নেই। শুধু সাধারণ মানুষ নয়, গোটা বিশ্বের গণমাধ্যমে এখন নব্বই শতাংশ দখল করে আছে এই ভাইরাস। মুদ্রণ সংবাদপত্র তো বন্ধ হওয়ার পথে করোনা ছড়ানোর আতঙ্কে। করোনা আর মৃত্যু যেন এক হয়ে গেছে। যদিও অন্য সাধারণ রোগের মৃত্যু আরও বেশি।
মৃত্যু নিয়ে অনেক বড় মানুষের লেখা আছে। যেমন কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘মরণরে তুঁ হুঁ মম শ্যাম সমান।’ পবিত্র কোরআন এ মৃত্যু সম্পর্কে অনেক জায়গায় বলা হয়েছে। মৃত্যু সম্পর্কে সূরা হজ’র ৬৬ নাম্বার আয়াতে বলা হয়েছে, আল্লাহই তোমাদের জীবন দান করেছেন। তিনিই তোমাদের মৃত্যু ঘটাবেন। কোরআনে বলা হয়েছে, মৃত্যু কখন কার কোথায় হবে সেটা স্রষ্টাই একমাত্র বলতে পারেন আর কেউ জানেন না। আমরাও বিশ্বাস করি আরাম, আয়েশ করে বসে বা শুয়ে থাকলেও মৃত্যু হবে। সৃষ্টির প্রত্যেক জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ নিতে হবে।
সূরা বাকারার ১৫৬ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আমরা আল্লাহর কাছ থেকেই এসেছি এবং তার কাছেই ফিরে যাব। হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, ইহুদী, সকল ধর্মে মৃত্যু নিয়ে একই রকম বিশ্বাস। সুতরাং এ বিষয়ে না গিয়ে এবার আমরা মৃত্যুর পরের ভাবনায় আসতে পারি। ইসলাম ধর্ম বিশ্বাস করে মৃত্যুই শেষ নয়, মৃত্যুর পরেও জীবন আছে। অর্থাৎ আমরা মহান স্রষ্টার কাছ থেকে এসেছি আবার তার কাছেই ফিরে যাবো। সেখানে আমাদের পুনর্জীবিত করা হবে এবং দুনিয়ার ভালোমন্দ কাজের হিসেব নেয়া হবে। যেহেতু মরণ শেষ যাত্রা নয় সুতরাং মৃত্যুর পরের জীবন কীভাবে কাটবে সেটা নিয়ে প্রস্তুতি নিতে হবে।
সুতরাং বলা যায়, এ মহামারী আমাদেরকে মৃত্যুর পরের জীবনের জন্য প্রস্তুত হওয়ার ভালো সুযোগ এনে দিয়েছে। প্রস্তুতির বিষয়ে অনেকের কাছে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। তবে মোটা দাগে একটা মিল থাকতে পারে। প্রস্তুতি মানে স্রষ্টার প্রার্থনা, সৃষ্টির সেবা করা, দান, স্রষ্টার ক্ষমা পাওয়া, মানুষের ক্ষমা পাওয়া, মানুষের জন্য কাজ করা, মানুষের সমস্যা সংকটে ব্যথিত হওয়াসহ অনেক কিছু।
আমরা জানি, আমি যতই পালিয়ে থাকি না কেন ঋণ শোধ না করলে পাওনাদার আমাকে ছাড়বে না। আবার পরিশোধ করতে না পারলেও ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে। মানুষের জীবনে ঋণ দু’রকমের। স্রষ্টার ঋণ এবং মানুষের ঋণ। পবিত্র কোরআনে স্রষ্টা বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে সৎ কর্মে কে অগ্রগামী তা পরীক্ষার জন্যই তিনি জীবন মৃত্যুর ব্যবস্থা করেছেন।’ আবার ইসলাম ধর্মে বিভিন্নভাবে সতর্ক করা হয়েছে, স্রষ্টা মানুষের কাছ থেকে নেয়া ঋণ মানুষ মাফ না করলে তিনি মাফ করবেন না। অর্থাৎ স্রষ্টা আমাদের জীবন দিয়ে কিছু আদেশ নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলো না মানলে তার কাছে জবাবদিহি করতে হবে। তাতে তিনি মাফ করতে পারেন, আবার মাফ নাও করতে পারেন। সেইসঙ্গে তিনি দুনিয়াতে আমাদেরকে অনেক দায়িত্ব দিয়েছেন, সেগুলো নিয়েও তিনি হিসাব নিবেন। তবে দুনিয়াতে যদি আমরা কারো সাথে খারাপ ব্যবহার করি বা অন্যের সম্পদ নষ্ট করি, পরচর্চা করি, তার দায়-দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। তাই সময় থাকতে আমাদেরকে ক্ষমা চেয়ে মাফ পাওয়ার চেষ্টা করতে হবে।
মহামারির এ সময়ে আমরা নিরাপদে থাকতে বাসায় সময় কাটাচ্ছি। অনেকেই বাসায় থাকার এই সময়টাকে সুন্দরভাবে কাজে লাগিয়েছি। কেউ আমরা পরিবার এবং নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত থেকেছি, আবার কেউ কাটাচ্ছি নানাভাবে মানুষের সহযোগিতা করে। শুধু আর্থিক সাহায্য নয়, এ বিপদ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য মহান স্রষ্টার কাছে নিজের এবং অন্যের জন্য প্রার্থনা করাও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। অনেকেই আবার এই সময়টাকে ব্যয় করেছি- অহেতুক দুশ্চিন্তা করে, ভয় পেয়ে, নেতিবাচক কথা বা ভাবের আদান-প্রদান করে। অর্থাৎ যেসব কাজ আমাদের কোন প্রয়োজনে আসবে না। অথবা ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভার্চুয়াল জগতে কাটানোর মাধ্যমে নিজের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে দুর্বল করে, নিজেকে আরও ভয় এবং আতঙ্কে ভাসিয়ে।
আমরা যদি একটু পিছনে ফিরে দেখি যেমন ছাত্র জীবনের পরীক্ষা। সারা বছর সবাই অনেকটা স্বাধীন। পড়া লেখা তেমন না করলেও শিক্ষককে ফাঁকি দিতে পারলেই চলে। মোটামুটি স্কুলে আসা যাওয়া করে সময় পার করলেই হলো। কিন্তু বার্ষিক পরীক্ষা আসলে সময়ের মুখোমুখি হতেই হবে। অর্থাৎ পরীক্ষায় কোনরকমে পাস করতে হলেও কিছু পড়ালেখা করতে হবে। না হলে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। মৃত্যুকেও আমরা এভাবে উপলব্ধি করতে পারি। সারা জীবন প্রার্থনা করে বা না করে, স্রষ্টার নির্দেশ মেনে বা না মেনে পার করে দিলাম। কিন্তু মৃত্যুর আগে তো ক্ষমা চাইতে হবে। না হয় তো জীবনের পরীক্ষার পাশ করার কোন সুযোগ থাকছে না। ক্ষমা চাইলে যে পাবো সেটা হয়তো নিশ্চিত না, কিন্তু চেষ্টা তো করতে হবে।
সেদিন ফেসবুকে এক বন্ধুর স্ট্যাটাস দেখে মন খুবই বিচলিত হয়ে উঠলো। তিনি লিখেছেন, ‘এ মহাদুর্যোগের পর কার সাথে কার দেখা হবে তা অনিশ্চিত। তাই আসুন আমরা পরস্পর পরস্পরকে ক্ষমা করে দেই। আমি একজন ক্ষমা প্রার্থী। চলার পথে কাউকে কোনোভাবে কষ্ট দিয়ে থাকলে আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে ক্ষমা করুন।’
একজন বিখ্যাত জ্ঞান সাধক বলেছেন, মানুষ তার জীবনে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বাস্তবতাকে ভুলে যায়। এই তিনটি হলো, আল্লাহ, মৃত্যু ও শয়তান। আল্লাহ মানুষের সঙ্গে আছেন, মানুষ তাকে ভুলে থাকে। আর ভুলে থাকে বলেই সে বিপথে যেতে পারে। মৃত্যু তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করছে। কিন্তু মৃত্যুকে ভুলে আছে বলে মানুষ কামনা-বাসনা নিয়ে এমন নিরুদ্বেগ জীবন-যাপন করতে পারে। শয়তান যে তার মধ্যেই বসবাস করে সে কথাও মানুষ বেমালুম ভুলে থাকে। শয়তানে অস্তিত্ব সম্পর্কে সজ্ঞানে চিন্তা করলেও মানুষ শয়তানের প্ররোচনা থেকে বাঁচতে পারে। এই ভুলে থাকাটাই কিন্তু জীবন। সে জন্য মৃত্যুকে এমন ভয়। বলা হয়ে থাকে, মুমিন বা বিশ্বাসীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করে মাত্র। তার কাছে জীবন-মৃত্যুর কোন পার্থক্য নেই। বিশ্বাসীরা জানতে চায় না জীবনের জন্য মৃত্যু, নাকি মৃত্যুর জন্য জীবন। সে জানে জীবন বলতে এ শরীর নয়। মৃত্যু বলতেও এ শরীর নয়। এক অর্থে যার নাম জীবন, তার নামই মৃত্যু।
এ পৃথিবীতে আমরা এসেছি একেবারেই নিষ্পাপ, স্বাধীন, ঋণমুক্তভাবে। আর দিনে দিনে ঋণগ্রস্থ হয়েছি, পাপগ্রস্থ হয়েছি বিভিন্নভাবে। এখন কীভাবে ঋণ শোধ করবো আমরা জানি না। তবে আমরা ঋণমুক্ত হওয়া বা শুদ্ধ হওয়ার জন্য ক্ষমা চাইতে পারি মহান স্রষ্টার কাছে আর স্রষ্টার সৃষ্টি মানুষের কাছে। এ মহামারী আমাদের ক্ষমা পাওয়ার অনেকগুলো সুযোগ এনে দিয়েছে। আমরা এ মহামারী থেকে বাঁচার জন্য মহান স্রষ্টার কাছে বেশি বেশি ক্ষমা চাইতে পারি। পাশাপাশি অসহায় অসুস্থ এবং সহায় সম্বলহীন মানুষের সাহায্যের জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে পারি। যার যা কিছু আছে, সেটা নিয়ে আমরা মানুষের কল্যাণে কাজ করতে পারি। আর যদি কিছুই না থাকে, তাহলে আমরা অসহায় মানুষের জন্য স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে পারি। ইসলাম ধর্মে বলা হয়, দান অকল্যানের ৭০টি দরজা বন্ধ করে। আজ মহামারী থেকে নিজে বাঁচতে এবং মানুষকে বাঁচাতে প্রয়োজন সহমর্মিতা, দোয়া ও আন্তরিক দান।
আমার ধর্মীয় জ্ঞান তেমন একটা নেই। তবুও সাধারণ জ্ঞানে পাওয়ার কয়েকটি বিষয় এখানে তুলে ধরছি। পবিত্র কোরআনের সূরা আল ইমরানের ১৩৪ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, যারা স্বচ্ছলতা ও অভাব সকল অবস্থার মধ্যেই দান করে, রাগ সংবরণ করে ও মানুষকে ক্ষমা করে আল্লাহ তাদের ভালোবাসেন। সূরা মায়েদার ১২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, আমাকে (আল্লাহকে) কর্জে হাসনা দাও (সৃষ্টির সেবায় দান কর) নিশ্চয়ই আমি তোমাদের কল্যাণ করবো।
একদিন এক লোক গৌতম বুদ্ধের কাছে এসে বললেন, বুদ্ধ আমি গরীব কেন? বুদ্ধ উত্তর দিলেন, তুমি দান করো না। প্রতিউত্তরে লোকটি বললে, আমি তো গরীব আমি কি দান করব। তখন বুদ্ধ তাকে বললেন, তোমার সুন্দর হাসি ছিল সুন্দর একটা মন ছিল তুমি তা-ই দান করতে পারতে। বাইবেলে বলা আছে, ঈশ্বর প্রত্যেককেই কর্মফল প্রদান করবেন। যারা ধৈর্যের সাথে সৎকর্ম করে ঈশ্বরের কাছে সুখ, সম্মান ও অনন্ত জীবন পেতে চায় ঈশ্বর তা-ই দেবেন। আর যারা স্বেচ্ছাচারী হয়ে সত্যকে প্রত্যাখ্যান করেছে, অন্যায় করেছে, ঈশ্বর তাদের ভয়াবহ শাস্তি দেবেন। (রোমীয় ২:৬-৮)
সনাতন ধর্মের পবিত্র গ্রন্থ বেদে বলা আছে, সৎকর্ম মানুষকে দৃঢ় ও সাহসী করে। দেহ মনকে রোগ ও পাপ থেকে মুক্ত রাখে। সকল প্রতিকূলতার ওপর বিজয়ী করে। (ঋগবেদ: ৫: ১৫: ৩)
পবিত্র কোরআনে সূরা মুনাফিকুনের ৯ থেকে ১১ নম্বর আয়াতে আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি যে জীবন উপকরণ দিয়েছি মৃত্যু আসার আগেই তা থেকে সৎ কাজে ব্যয় করা। তা না হলে মৃত্যুর মুখোমুখি হলে তুমি বলবে- হে আমার প্রতিপালক! আমাকে আরও কিছুকাল সময় দিলে না কেন? তাহলে আমি সৎকর্ম করতাম ও সৎকর্মশীলদের অন্তর্ভুক্ত হতাম। কিন্তু তোমাদের তখন আর কোন সময় দেয়া হবে না।’
সম্পদ মহান আল্লাহর দান। যার পূর্ণ ও প্রকৃত মালিকানা তাঁরই। আমাদের কেবলমাত্র নির্দিষ্ট মেয়াদে ভোগ করার অধিকার দিয়েছেন। মৃত্যুর পর এই সম্পদই অন্যের হয়ে যাবে। তাই বুদ্ধিমানের কাজ হলো সময় থাকতেই পরকালের জন্য এ সম্পদ থেকে দান করে সেই জীবনের রাস্তা সুগম করা।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, সদকা সম্পদ হ্রাস করে না। কাউকে ক্ষমা করলে এর মাধ্যমে আল্লাহ তাআলা বান্দার ইজ্জত বৃদ্ধিই করে থাকেন। এবং যে কেউ আল্লাহর জন্য বিনম্র হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়েই দেন। (সহিহ মুসলিম)
সুতরাং করোনা নিয়ে আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হোন। ঘরে থাকুন, নিয়ম মানুন, পুষ্টিকর খাবার খান, প্রার্থনা করুন এবং অন্যের জন্য দান করুন। পরম প্রভু আমাদের সবাইকে সুস্থ রাখবেন, ভালো রাখবেন।
এমএস/ টিআই/ এমবি