মেনোপজ হলেই কি মূল্য কমে যায়, জীবন থমকে যায়?
প্রকাশিত : ১০:১৬, ৩১ জুলাই ২০২১
প্রতীকী ছবি
মেনোপজ হচ্ছে মেয়েদের ঋতুচক্রের শেষ পরিণতি। প্রতিটি মেয়েরই জীবনের স্বাভাবিক একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু কিভাবে বুঝবেন যে মেনোপজ হয়েছে? খুবই সহজে বুঝতে পারবেন- যখন আপনার শেষ মাসিকের দিন থেকে বারো মাস পূর্ণ হবে, অর্থাৎ পুরো এক বছর যখন মাসিক বন্ধ থাকবে তখন বুঝতে হবে মেনোপজ হয়েছে।
তবে বেশিরভাগ বাঙালি মেয়েই ভাবেন যে, মাসিক বন্ধ হলেই বুঝি মেয়ে হিসেবে তাদের মূল্য কমে গেল কিংবা সে ভাবতে শুরু করে যে, তার জীবনটাই বুঝি থমকে গেল।
আদতে কথাটা ভুল। এই সময় বাড়তি যত্ন এবং সঠিক পুষ্টি গ্রহণে শারীরিক ও মানসিকভাবে আরও বেশি সুস্থ, সবল ও কর্মক্ষম থেকে বাকি জীবনটুকু সুন্দরভাবে উপভোগ করা যাবে।
মেনোপজের সময় সব থেকে লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- এসময় ইস্ট্রোজেন হরমোনের সিক্রেশন কমে যেতে থাকে। এর ফলে বিপাকক্রিয়া ব্যাহত হয় অনেকাংশে। অর্থাৎ কম ইস্ট্রোজেন হরমোনের কারণে মেটাবলিজম হয় অনেক ধীর গতিতে। এই কারণেই মেনোপজের সময় নারীদের ওজন বেড়ে যায় খুব সহজে। হরমোনের তারতম্যের কারণে অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি হট ফ্লাশ বা অতিরিক্ত গরম লাগা, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটা কিংবা পর্যাপ্ত ঘুম না হওয়া, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া, ডিপ্রেশনে ভোগা, মুড সুইং করা, হাড় ও পেশীর ঘনত্ব কমে যাওয়া কিংবা হাড়ের ভঙ্গুরতা ইত্যাদি শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে।
যেহেতু মেনোপজ মেয়েদের ঋতুচক্রের একটা স্বাভাবিক পরিবর্তন, যা সব মেয়েদেরই একটি নির্দিষ্ট সময়ে আসবেই। তাই একে সহজভাবে মেনে নিয়ে সঠিক পরিচর্যা ও সঠিক পুষ্টি গ্রহণে মেনোপজের জটিলতা অনেকাংশেই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
#মেনোপজের সময় সুষম খাবারের প্রভাব-
বিভিন্ন ধরণের গবেষণায় দেখা গেছে, মেয়েদের বিশেষ এই সময়টাতে যথাযথ যত্ন এবং সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবারের মাধ্যমে এই সময়ের অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত শারীরিক সমস্যা ও মানসিক সমস্যাগুলো অনেকাংশে কমে যেতে পারে। যথাযথ শারীরিক যত্ন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল সমৃদ্ধ সুষম ও স্বাস্থ্যকর খাবার মেনোপজ-এর সময় যে হট ফ্লাশ অতিরিক্ত গরম লাগা, হাত পা জ্বালাপোড়া করা, ঘুমের ব্যাঘাত এবং হাড়ের ঘনত্ব কমে যাওয়া অনেকাংশে কমিয়ে এনে সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবনযাপন করা সম্ভব।
#ডেইরি প্রোডাক্টস/দুধ ও দুধ জাতীয় খাবারঃ
ডেইরি প্রোডাক্টস যেমন- দুধ, দই, পনির ইত্যাদি খাবার ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন-ডি ও ভিটামিন-কে পুষ্টি উপাদানগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকে। পুষ্টি উপাদানগুলো মাংসপেশী ও হাড়কে মজবুত রেখে শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখবে। ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি যুক্ত খাবার দাঁত ও দাঁতের মাড়ির সুস্থতা বজায় রাখে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবারে বিশেষ করে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি এর পাশাপাশি গ্লাসের নামক অ্যামাইনো এসিড রয়েছে, যা পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে সাহায্য করে। অর্থাৎ যাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে দুধ ও দুগ্ধ জাতীয় খাবার রাখেন তাদের ঘুম বেশ ভালো হয়।
এছাড়াও অন্যান্য গবেষণায় দেখা গেছে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ চিজ বা পনির এবং পাস্তুরিত দুধ খেলে আর্লি মেনোপজের ঝুঁকি প্রায় ২০% কমে যায়। তাই মেয়েদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এক কাপ দুধ বা এক স্লাইস চিজ বা এক কাপ টক দই বা চিনি ছাড়া হাফ কাপ ছানা বা দুধের তৈরি কোনও খাবার রাখতে হবে।
*হেলদি ফ্যাটঃ
সব ফ্যাট-ই খারাপ না, সব কোলেস্টেরল-ই খারাপ না। খারাপ কোলেস্টেরলের পাশাপাশি ভালো কোলেস্টেরলও আছে যা আমাদের শরীরে অনেক উপকারী ভূমিকা রাখে। হেলদি ফ্যাট যেমন- ওমেগা-৩ ফ্যাটি এসিড ও ওমেগা-৬ ফ্যাটি এসিড মেনোপজ-এর সময় শরীরের সুস্থতা বজায় রাখতে সাহায্য করে খুব সহজেই। পর্যাপ্ত পরিমাণে হেলদি ফ্যাট গ্রহণে মেনোপজ-এর সময়ের সব থেকে বড় শারীরিক সমস্যা হট ফ্লাশ কমে যাবে।
তাই মেনোপজ ম্যানেজমেন্টের সময় হেলদি ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার, যেমন- চর্বিযুক্ত সামুদ্রিক মাছ কোরাল মাছ, টুনা, স্যালমন, ম্যারেল, রূপচাঁদা ইত্যাদি মাছ, চিয়া সিড, তোকমা, মিষ্টি কুমড়ার বিচি, ডাল ইত্যাদি বিজ জাতীয় খাবার, কাঠবাদাম, অলিভ ওয়েল, সানফ্লাওয়ার তেল ইত্যাদি হেলদি ফ্যাট পরিমিত পরিমানে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় রাখতে হবে।
*দানা শষ্য জাতীয় খাবারঃ
শষ্য জাতীয় খাবার ছাড়া সুষম পুষ্টিকর খাদ্য তালিকা চিন্তা করাই উচিত না। শস্য জাতীয় খাবার পুষ্টিসমৃদ্ধ হয়ে থাকে। এই জাতীয় খাবার উচ্চ খাদ্য আঁশ যুক্ত এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স, যেমন- থায়ামিন, নায়াসিন, রিবোফ্লাবিন এবং পেন্টোথেনিক এসিড সমৃদ্ধ, যা পর্যাপ্ত পরিমাণে গ্রহণে হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে, ক্যান্সারের ঝুঁকি অনেকাংশে কমে এমনকি অকাল মৃত্যুর হারও অনেকাংশে কমে যেতে পারে।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ৩ থেক ৪ সারভিং whole grain food বা জটিল শর্করা দানাশস্য গ্রহণ করেন তাঁদের ওবেসিটি, ডায়াবেটিস এবং হৃদরোগের ঝুঁকি ২০-৩০% কমে যায়। তাই মেনোপজের সময় সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে হলে দৈনিক খাদ্য তালিকায় লাল চালের ভাত, লাল আটার রুটি, গমের রুটি, গমের ছাতু, বার্লি, যব, ওটস ইত্যাদি পরিমাণ মতো রাখতে হবে।
*সতেজ ফলমূল ও শাকসবজিঃ
তাজা শাকসবজি ও ফলমূল ভিটামিনস, মিনারেল, ফাইবার ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর সম্পূর্ণ আধার। অর্থাৎ তাজা শাকসবজি ও ফলমূলে রয়েছে শরীরের প্রয়োজনীয় সমস্ত পুষ্টি উপাদান যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে সুস্থ ও কর্মক্ষম থাকতে সাহায্য করে। এ কারণে "আমেরিকান ডায়েটারি গাইড লাইন" রেকোমেন্ড করেছে- খাবার প্লেটের অর্ধেক অংশ তাজা শাকসবজি ও ফলমূল দিয়ে ভর্তি করতে হবে।
সবুজ ও নানান রঙের শাক সবজিতে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার, যার কারণে দৈনিক খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে মিক্স সবজি ও মৌসুমী ফল রাখলে ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। কারণ উচ্চ খাদ্যআঁশ যুক্ত এইসব খাবার খেলে পেট অনেকক্ষণ ভরা থাকে, সহজে ক্ষুধা লাগে না। ফলে অতিরিক্ত খাওয়া থেকে বিরত থাকা যায়। যেখানে মেনোপজের সময় অনাকাঙ্ক্ষিত ওজনাধিক্য একটি বিশাল সমস্যা। তাই দৈনিক খাদ্য তালিকায় উচ্চ আর যুক্ত শাকসবজি ও ফলমূল পর্যাপ্ত পরিমাণে রাখলে শরীরের অনাকাঙ্ক্ষিত ওজন কমানোর পাশাপাশি হট ফ্লাস ও অনেকটা কমে যাবে।
ক্রুসিফেরাস জাতীয় সবজি যেমন- ব্রকলি, ফুলকপি,বাঁধাকপি, চাইনিজ ক্যাবেজ ইত্যাদি সবজি মেনোপজ এর সময়কার জটিলতা অনেকটাই কমাতে সাহায্য করে। এই জাতীয় সবজি ইস্ট্রোজেন হরমোনের লেবেল বাড়িয়ে দেয় ফলে মহিলাদের ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঝুঁকিও অনেকটা কমে যেতে পারে।
ব্লুবেরি, ব্ল্যাকবেরি, চেরি, সবুজ আঙ্গুর, কালো আঙ্গুর, আপেল, মালটা, কমলা, বাতাবি লেবু, আনারস, কালোজাম, জামরুল, লটকন ইত্যাদি দেশী বিদেশি ভিটামিন সি যুক্ত ফল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শারীরিক ও মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। তাই মেনোপজ এর এই সময়টাতে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক ও মানসিক সমস্যা দূর করার জন্য দৈনিক খাদ্য তালিকায় পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন সি যুক্ত টাটকা শাকসবজি ও ফলমূল রাখতে হবে।
*উন্নত মানের প্রোটিনঃ
মেনোপজের সময় সীমিত ইস্ট্রোজেন হরমোনের জন্য মাংসপেশী ও হাড়ের গঠনে ব্যাঘাত ঘটে। অর্থাৎ মাংসপেশী ও হাড় দিনকে দিন দুর্বল হতে থাকে। তাই এই ধরণের শারীরিক সমস্যা দূর করতে হলে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে উন্নত মানের (ফার্স্ট ক্লাস) প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। আমেরিকান ডায়েটারি গাইড লাইন অনুযায়ী, ১-১.২ গ্রাম/কেজি বডি ওয়েট-এর সমান প্রোটিন গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ ২৫ থেকে ৩০ গ্রাম উচ্চমানের প্রোটিন জাতীয় খাবার প্রতি খাবারে নিতে হবে। এ সময়ে শারীরিক জটিলতা দূর করতে হলে মধ্য বয়সী মহিলাদের খাদ্য তালিকায় অন্তত করে একটি করে ডিম এক গ্লাস দুধ বা দুধের তৈরি খাবার কিংবা এককাপ টকদই, মাছ, মুরগির মাংশ, বাদাম, ডাল থাকতে হবে।
তবে যাদের রক্তে ইউরিক এসিড বেশি তারা অরগ্যান মিট, যেমন- কলিজা,মগজ, লিভার, ভুড়ি এছাড়াও ডাল, বিচি জাতীয় খাবেন না। এমন কি যারা ক্রোনিক কিডনি ডিজিজে ভুগছেন তারা পুষ্টিবিদের পরামর্শ অনুয়ায়ী অল্প পরিমাণে প্রোটিন গ্রহণ করবেন।
*ফাইটোইষ্ট্রোজেন যুক্ত খাবারঃ
কিছু কিছু খাবার আছে যেগুলো এই মেনোপজের সময় হরমোনের সামঞ্জস্য বজায় রেখে শারীরিক জটিলতা দূর করতে পারে অনেকাংশে। তাই এই সময়ে মধ্য বয়স্ক মহিলাদের দৈনিক খাদ্য তালিকায় পরিমিতভাবে সয়াবিন, সয়া দুধ, চিনাবাদাম, বেরি, আঙ্গুর, গ্রিন টি, ব্ল্যাক কফি ইত্যাদি খাবার রাখতে হবে। এইসব খাবার গ্রহণে মেনোপজ এর জটিলতা যেমন- হট ফ্ল্যাশ, খিটখিটে মেজাজ, ঘুমের অসুবিধা, ওজনাধিক্য অনেকটাই কমে যাবে।
মেনোপজের সময় শারীরিক জটিলতা দূর করার জন্য কিছু কিছু উপকারী খাবার যেমন খাদ্যতালিকায় রাখতে হবে ঠিক তেমনি কিছু কিছু খাবার খাদ্য তালিকা থেকে বাদ দিতে হবে খুশিমনে। সেসব খাবার যতই প্রিয় হোক না কেন;
*চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার
*অতিরিক্ত লবণ ও লবণাক্ত খাবার যেমন- চিপস, চানাচুর
*কোমল পানীয়
*ফ্রোজেন ফুড
*অতিরিক্ত তেলে ভাজা খাবার ও মসল্লা যুক্ত খাবার
*রেড মিট বিশেষ করে অরগান মিট
*অতিরিক্ত দুধ চা, দুধ কফি ইত্যাদি।
#সারসংক্ষেপঃ
মেনোপজের সময় বিপাক ক্রিয়া ধীর গতিতে হওয়ার কারণে ওজনাধিক্য বেড়ে যায়, হাড় ও পেশীর ও ঘনত্ব কমে যেতে থাকে, হাড়ের ভঙ্গুরতা বৃদ্ধি পায়, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগের ঝুঁকিও বেড়ে যেতে পারে। এছাড়াও কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় মুড সুইং হয়ে থাকে, ঘুমের ব্যাঘাত ঘটে থাকে অর্থাৎ সাউন্ড স্লিপ হয়না, হট ফ্লাসও হয়ে থাকে। তাই এই সময় মহিলাদের নিজেদের প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হতে হবে। খাওয়া-দাওয়ার সময় সঠিক খাদ্য নির্বাচন করতে হবে। দুশ্চিন্তা মুক্তভাবে বিশ্রাম নিতে হবে, পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমাতে হবে এবং সর্বোপরি হাসিখুশি আনন্দে থাকতে হবে।
মেনোপজের এই ম্যানেজমেন্ট একটি পরিবারের সবাই মিলে করতে হবে। শুধুমাত্র একজন মহিলার একার পক্ষে কখনোই সঠিক যত্ন নেয়া সম্ভব না। তাই আসুন, সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে জীবনের এই সময়টুকুও আমরা সুন্দরভাবে উপভোগ করি।
লেখক- ক্লিনিক্যাল নিউট্রিশনিষ্ট এন্ড ডায়েটিশিয়ান, উত্তরা ক্রিসেন্ট হসপিটাল এন্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, উত্তরা, ঢাকা।
এনএস//