মেলায় কর কার্ড-ই ছিল জাদুর কাঠি
প্রকাশিত : ২৩:৫১, ৭ নভেম্বর ২০১৭ | আপডেট: ১১:০৪, ৮ নভেম্বর ২০১৭
সপ্তাহব্যাপী চলতে থাকা আয়কর মেলার শেষ হচ্ছে আজ মঙ্গলবার (৭ নভেস্বর)। মেলায় করদাতাদের অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে আজ শেষ দিন হওয়ায় মেলার সময় রাত ১১ টা পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
এবারের কর মেলায় বিশেষ আকর্ষণ কর কার্ড। কর মেলায় বার্ষিক আয়কর বিবরণী জমা দিলে কর কার্ড দেওয়া হচ্ছে। তাই কর কার্ড পেতে প্রতিদিন হাজারও করদাতা মেলায় যাচ্ছেন, রিটার্ন জমা দিচ্ছেন। রিটার্ন জমা শেষে কর কার্ডের জন্য দীর্ঘ লাইন দিয়ে অপেক্ষা করছেন তাঁরা।
আজ মেলার সময় বাড়িয়েও ভিড় সামাল দেওয়া যাচ্ছে না। গতকাল সোমবার রাজধানীর কর মেলার ভিড় অন্য দিনের ভিড়কেও ছাড়িয়ে গেছে। করদাতারা বলছেন, এবারের মেলার প্রধান আকর্ষণ কর কার্ড পেতেই এই ভিড়। আর হয়রানিমুক্ত রিটার্ন জমা তো আছেই।
রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণাধীন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) ভবনে চলমান কর মেলার গতকালের চিত্র ছিল এমনই। দুপুরে সরেজমিনে মেলা প্রাঙ্গণে গিয়ে দেখা গেছে, হাজার হাজার করদাতা রিটার্ন দিতে এসেছেন। পুরো মেলা প্রাঙ্গণই লোকে-লোকারণ্য।বেশি ভিড় থাকায় বিভিন্ন বুথ থেকে সেবা দিতে বেশি সময় লাগছে। ভিড়ের কারণে গতকাল রাত ১০টা পর্যন্ত মেলার সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিলো।
‘সুখী স্বদেশ গড়তে ভাই আয়করের বিকল্প নাই’ স্লোগানে গত ১ নভেম্বর থেকে শুরু হয় সপ্তাহব্যাপী আয়কর মেলা। শুরু থেকেই মেলায় নারী-পুরুষ নির্বিশেষ সাধারণ করদাতারা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেছেন।এবারের মেলায় ১০২টি বুথ আছে। প্রতিবন্ধী, বয়স্ক, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য রয়েছে আলাদা আলাদা বুথ।
এনবিআর সদস্য আবদুর রাজ্জাক ইটিভি অনলাইনকে বলেন, `এ বছর আমাদের প্রত্যাশার বাহিরে কর দাতা মুতিভেটেড হয়েছে।এবার প্রথম আমরা করদাতদের একটি ইনকাম ট্যাক্সের আইডি কার্ড দিচ্ছি। কর দাতারা এটাকে এক ধরণের স্বীকৃতি হিসেবে দেখছে।
মেলার আয়োজনকে কেন্দ্র করে মানুষের কাঙ্খিত চাওয়া পূরণ হয়েছে কি না জানতে চাইলে? তিনি বলেন- আমার মনে হয় রাজস্ব বোর্ড সফল হয়েছে। মানুষের চাপ সামলানো কঠিন হয়ে পরেছে। আগামি বছর থেকে আরও বড় পরিসরে এ মেলার আয়োজন করা হবে।``
কর প্রদানে কীভাবে জনগণকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা যায় এ বিষয়ে আপনাদের আর কি কি পদক্ষেপ রয়েছে জানতে চাইলে? তিনি বলেন-‘কর প্রদানে আমরা জনগণকে উৎসাহিত করে যাচ্ছি নানান ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে।
‘এছাড়াও প্রতিটি কর অফিসে কর পরামর্শ কেন্দ্র রয়েছে। সেখানে করদাতারা সারা বছরই পরামর্শ নিতে পারেন। আমরা সব সময় তাদের সেবা দিতে প্রস্তুত রয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘যারা মেলায় আয়কর জমা দিতে পারবেন না তাদের জন্য আমরা এবারও এ মাসের শেষ সপ্তাহ আয়কর সপ্তাহ পালনের উদ্যোগ নিয়েছি। ২৪ থেকে ৩০ নভেম্বর সারাদেশের প্রত্যেক কর অঞ্চলের অফিসে এ আয়কর সপ্তাহ পালিত হবে। করদাতারা আয়কর রিটার্ন জমাসহ করসংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য মেলার মতই সেখানেও সুযোগ-সুবিধা পাবেন।’
আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত ৯০ হাজার ৪৩৫ জনকে ইনকাম ট্যাক্স কার্ড প্রদান করতে পেরেছি।এছাড়া এবার সারে ৩ লাখেরও বেশি কর দাতা কর প্রদান করেছে বলে মেলার প্রধান সমন্বয়কারী এনবিআরের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক এ তথ্য জানিয়েছেন।
গত ৬ দিনে সারাদেশে দুই লাখ ৬৯ হাজার ১৫৪টি রিটার্ন দাখিল হয়েছে। এক হাজার ৭৯১ কোটি ১২ লাখ ৭৩ হাজার ৩১০ টাকার কর আদায় হয়েছে। এছাড়া,৯ লাখ ৪৪ হাজার ৯০ মানুষ আয়কর সেবা নিয়েছেন।
গত বছর আয়কর মেলার ৬ষ্ঠ দিনে ৩১০ কোটি ৫৯ লাখ ৬৩ হাজার ৯০৬ টাকার কর আদায় হয়েছিল। রিটার্ন জমা দিয়েছিলেন ২৮ হাজার ৮৬৩ জন। সেবা নিয়েছিলেন এক লাখ ৩৯ হাজার ১৭৮ জন।
সে হিসাবে এ বছর আয়কর মেলার ৬ষ্ঠ দিনে ৭ কোটি ২৮ লাখ ৯১ হাজার ৩৭২ টাকা বেশি কর আদায় হয়েছে।
উল্লেখ্য,এবছর নভেম্বরের প্রথম সাত দিন ঢাকাসহ বিভাগীয় শহরে সাত দিন, ৫৬টি জেলা শহরে চার দিন, তৃতীয়বারের মতো ৩৪টি উপজেলায় দুই দিন এবং ৭১টি উপজেলায় একদিনের ভ্রাম্যমাণ আয়কর মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
আয়কর প্রদানের শেষ দিনে কর দিতে আসা মোহাম্মদ আনিস উল্যাহ বলেন- `এ বছরই প্রথম আয়কর দিচ্ছি, তাই একটু বাড়তি উৎসাহ কাজ করছে।আমি টেক্সটাইলে কাজ করি।সর্বনিম্ন ৪৮০০ টাকা দিয়েছি।সরকারের রাজস্ব বিভাগকে এই টাকা দিতে পেরে ভালো লাগছে। কর দিয়ে দেশের উন্নয়নের অংশীদার হতে চাই।এছাড়া আমার কাছে মনে হয় কর দেয়া মানে নিজের আয়কে বৈধ করে নেয়া।`
আমজাদ হোসেন বলেন, ‘এবারই প্রথমবারের মতো মেলায় রিটার্ন দিতে এলাম। কর কার্ড পেয়ে ভালো লাগছে। এদেশের একজন সাধারণ জনগণ হিসেবে এই কার্ড এক ধরনের স্বীকৃতি।`
বেসরকারি চাকুরীজীবী নাজিয়া ইফা মনি বলেন- `ভেবেছিলাম অনেক সময় লাগবে, মহিলাদের জন্য আলাদা বুথ থাকায় খুব সহজে কর দিতে পেরেছি। আজ থেকে কর দাতা হিসেবে নিবন্ধিত হলাম। ভালো লাগছে।`
ঢাকা আহসানিয়া মিশনের সিনিয়র হিসাব রক্ষক মোহাম্মদ মারুফ বলেন- অনলাইন ট্যাক্স পদ্ধতি থাকলেও, এর সনদ অনলাইন ভিত্তিক করা উচিত । যেহেতু আমরা কর দাতা আমাদের প্রতি রাজস্ব বোর্ড এই টুকুন সম্মান দেখানো উচিত।
শতাধিক রোভার স্কাউটের সদস্যরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছেন।শান্তি শৃঙ্খলা বজায় ও বুথ সম্পর্কে দিক নির্দেশনা প্রদানে সাহায্য করছেন করদাতাদের ।এছাড়া এ মেলায় হেলথ কেয়ার পার্টনার হিসেবে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল।
এদিকে আজ মেলার শেষ দিন। এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যাঁরা আসবেন, সবার রিটার্ন জমা নিয়ে মেলা শেষ করা হবে। প্রয়োজনে রাত ১০-১১টা বাজলেও তাঁদের রিটার্ন নেওয়া হবে।
সব বিভাগীয় শহর, জেলা শহর ও উপজেলা শহর পর্যন্ত এই মেলা হচ্ছে। এর মধ্যে রাজধানীসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে সাত দিনব্যাপী মেলা হয়েছে।
মেলায় করদাতারা আয়কর বিবরণীর ফরম থেকে শুরু করে কর পরিশোধের জন্য ব্যাংক বুথও পাচ্ছেন। করদাতাদের সহায়তা করার জন্য সহায়তাকেন্দ্র আছে। একই ছাদের নিচে ই-টিআইএন, পুনর্নিবন্ধন, রিটার্ন জমা সব সেবা মিলছে। করদাতা শুধু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সঙ্গে আনলেই হবে। এ ছাড়া নারী, প্রতিবন্ধী, মুক্তিযোদ্ধা, প্রবীণ করদাতাদের জন্য আলাদা বুথ আছে। এ ছাড়া অনলাইনে রিটার্ন জমা বা ই-ফাইলিংয়ের সুবিধাও মিলছে কর মেলায়।
প্রথমবারের মতো করদাতাদের এবার ইনকাম ট্যাক্স আইডি কার্ড বা স্মার্ট কার্ড ও ট্যাক্সপেয়ার স্টিকার দেওয়া হচ্ছে। মেলায় ১০টি বুথ থেকে দেওয়া হচ্ছে স্মার্ট কার্ড। আর ১০২টি বুথ থেকে করসেবা দেওয়া হচ্ছে। আয়কর সংক্রান্ত সব ধরনের ফরম বিনামূল্যে দেওয়া হচ্ছে এই মেলায়।
মেলার শেষ দিনে রাত নয়টায় সমাপনী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।এতে রাজস্ব বোর্ড এর চেয়ারম্যান নজিবুর রহমান সভাপতিত্ব করেন।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথির মন্ত্রী পরিষদ সচিব সফিউল আলম বক্তব্যে বলেন- ``কানাডা প্রবাসী এক শিল্পপতিকে
জিজ্ঞেস করেছিলাম- আপনি কানাডায় বিনিয়োগ করেন না কেন? উত্তরে তিনি আমাকে জানালেন- ওখানে বিনিয়োগ করলে যে পরিমান কর কর্তন করে সেটা অকল্পনীয় ।`
সেই তুলনায় আমাদের দেশ অনেক মানবিক ও কল্যাণ মুখী। এছাড়া রাষ্ট্র কে কর দেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। এটা শুধু রাষ্ট্রীয় ব্যাপার নয়,এটা রাষ্ট্রের অধিকার।`
বক্তারা বলেন- জাতীয় রাজস্ব যদি জমা না পরে, তবে দেশের উন্নয়ন কীভাবে হবে সে বিষয়ে সবাই কে আরও বেশি সচেতন হতে হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, অর্থ জমা দেয়ার জন্য মেলা হতে পারে, তাও আবার উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। মানুষের জীবন মান উন্নয়নের জন্য আয় কর প্রদানের বিকল্প নেয়। সবাই এসে আয় কর জমা দিচ্ছে এটি যুগান্ত কারি সফলতা।মানুষের মধ্যে দিন দিন আয় কর দেয়ার প্রবণতা বাড়ছে এটা প্রশংসনীয়। আয় কর প্রদানে জনগণকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করা গেলে আমাদের রূপকল্প ২০২১ ও ২০৪১ বাস্তবায়িত হবে।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন- মিস সুরাইয়া বেগম (সিনিয়র সচিব) প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, ড. আসলাম আলম (সিনিয়র সচিব), বাংলাদেশ লোক প্রশাসন, সামসুল আরিফিন (সিনিয়র সচিব),দুর্নীতি দমন কমিশন, মাইন উদ্দিন আব্দুল্লাহ (সিনিয়র সচিব) বাংলাদেশ কৃষি মন্ত্রণালয়।নমিতা হাওলাদার ( ভারপ্রাপ্ত সচিব) প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়, আব্দুর রাজ্জাক সদস্য, রাজস্ব বোর্ডসহ প্রমুখ।
মেলায় হেলথ ক্যাম্প পরিচালনা করে করদাতাদের সহায়তা করায় ইউনিভার্সালের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আশিষ চক্রবর্তীকে সম্মাননা দেওয়া হয়।
এবছর থেকে ঢাকা ও বিভাগীয় শহর ও উপজেলায় সেরা কর দাতা ৬০ পরিবারের মধ্যে `কর বাহাদুর পরিবার` উপাধি দেয়া হবে। এছাড়া আগামিকাল দেশের সেরা কর দাতাদের সম্মাননা প্রদান করা হবে । মঙ্গলবার মেলার সমাপনী দিনে হেলথ ক্যাম্প পরিচালনাসহ নানা সহযোগিতায় যারা এগিয়ে আসেন তাদের সম্মাননা দেওয়া হয়।
উল্লেখ্য, বুধবার (১ নভেম্বর) রাজধানীর আগারগাঁওয়ে সপ্তাহব্যাপী এ মেলার উদ্বোধন করেন অর্থ প্রতিমন্ত্রী এ এ মান্নান।
আরকে//
আরও পড়ুন