ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২১ নভেম্বর ২০২৪

মেয়েদের পায়ে পায়ে ‘সাইকেল-বিপ্লব’

শিউলি শবনম

প্রকাশিত : ১৭:০৮, ৩০ জুলাই ২০২৩

সাইকেলের মতো সহজ, স্বচ্ছন্দ একটা বাহনকে আমাদের দেশে মেয়েদের জন্য কেন যেন অপাংক্তেয় করে রাখা হয়েছে। কোলকাতায় নেমেই দেখি, শাড়ি, শাখা-সিঁদুর পরা নারী, তরুণ, তরুণী, বিভিন্ন বয়সী মানুষ সাইকেলে নির্বিঘ্নে যাতায়াতসহ বাজারের ব্যাগ বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, প্রশস্ত রাস্তা ধরে আরামসে চালিয়ে।  তবে আমাদের দেশের উত্তরবঙ্গে স্কুল পড়ুয়া মেয়েদের সাইকেল চালাতে দেখেছি। তারা কোচিংয়ে, স্কুলে কিংবা মক্তবেও সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করে। যাতে সময় এবং অর্থ দুটোই বাঁচে। কিন্তু একটু বয়েস বাড়তেই বন্ধ হয়ে যায় মেয়েদের সাবলীল এসব পথচলা। ফলে স্পোর্টস হিসেবে মেয়েরা সাইক্লিংকে বেছে নিতে পারে সে সম্ভাবনার আলোও এখন পর্যন্ত যথেষ্ট ক্ষীণ। জাতীয় প্রতিযোগিতাগুলোতে এখনো একক আধিপত্য বিভিন্ন বাহিনীর পেশাদার নারী সাইক্লিস্টদের। শুধুমাত্র সামাজিক ট্যাবুর কারণেই পুরুষদের তুলনায় এখনো অনেক পিছিয়ে আমাদের সাইক্লিস্টসহ বিভিন্ন নারী অ্যাথলেটরা।  

সাইক্লিংকে স্পোর্টস হিসেবে নিতেই হবে এমনও কথা নেই। মেয়েরা যদি সাধারণ বাহন হিসেবে হলেও সাইকেল ব্যবহারের সুযোগ পেত তাহলেও শারীরিক মানসিক সুস্থ, সবল বিশাল একটা জনগোষ্ঠী পেতাম আমরা। থাকত না অল্প বয়সেই বুড়িয়ে যাওয়ার, রোগে শোকে কাতর হওয়ার ভয়। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, অতিরিক্ত ওজনের চাপ, দুর্বল পেশী নিয়ে অকর্মণ্য জীবন কাটাতে হতো না। শুধু রাস্তা ঘাটে সহজভাবে সাইক্লিং করতে পারলে, যাতায়াত করতে পারলেই অনেক অসুখ থেকে মিলত মুক্তি। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে।

কোলকাতায় এলেই ছবির মতো পুরনো বাড়ি ঘর, উল্লেখযোগ্য ঘন গাছপালা এবং মোড়ে মোড়ে প্রচুর ভাস্কর্য আমাকে নেশার মতো টানে। সবচেয়ে বড় কথা হলো গুণীর কদর করতে জানেন এঁরা। চোখ ফেরালেই চোখে পড়বে রবীন্দ্র মোড়, সুকান্ত মোড়, নেলী সেন বিদ্যাপীঠের মতো বিশিষ্টজনদের নামে বিভিন্ন স্থাপনা, সড়ক
নানা কিছু।

রোববার সাপ্তাহিক ছুটি হওয়াতেই হয়তো রাস্তাঘাট ছিল প্রায় ফাঁকা। নাকি কোলকাতায় আদতেই যানজট কম সেটা আগামী একমাস এখানে অবস্থানকালীন নিশ্চয় বুঝতে পারব। কোলকাতা বিমানবন্দরে কথা হচ্ছিল একই ফ্লাইটের যাত্রী বাংলাদেশে প্রথমবার ভ্রমণে যাওয়া গুজরাটের আইটি বিশেষজ্ঞ ড. অনন্তের সাথে। তিনি বললেন, বাংলাদেশে জীবনযাপন অনেক ব্যয়বহুল। হাসতে হাসতে বললেন, তবে, বাংলাদেশিদের আতিথিয়েতায় তিনি মুগ্ধ। আমরা যেন আগ্রায় তাজমহল দেখতে যাই চলে যাওয়ার আগে সে কথা বলতেও ভুল করলেন না। 

যাই হোক, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু বিমানবন্দরে আমরা পৌঁছানোর আগেই সত্যজিত রায় ফিল্ম এন্ড টেলিভিশন ইনস্টিটিউটের বাস আমাদের রিসিভ করতে অপেক্ষায় ছিলেন। বিমানবন্দর থেকে ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিটের মাথায় আমাদের বাস পৌঁছে যায় ঘন গাছপালা, জঙ্গলে সুশোভিত, প্রকৃতির পরম আদরে জেগে থাকা দারুণ এই ইনস্টিটিউটে। উষ্ণ আন্তরিকতায় আমাদের বরণ করে নিলেন এসআরএফটিআইএ'র শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ এখানকার স্টাফরা।

আমি মনে করি নিজেকে ফিট রাখতে, শরীরকে চাঙ্গা রাখতে মেয়েদের সাইকেল চালানো উচিত। নিয়মিত সাইকেল চালানোর স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে সবারই কমবেশি ধারণা আছে। কঠিন সব রোগ সারে সাইকেল চালালে। প্রতিদিন সাইকেল চালালে যেমন আপনার খরচ বাঁচবে; ঠিক তেমনই শরীর থাকবে সুস্থ। এবার আসুন জেনে নিন সাইকেল চালানোর যত উপকারিতা- 

বিশেষজ্ঞদের মতে, সাইক্লিং একটি দুর্দান্ত ওয়ার্কআউট, যা আপনাকে সক্রিয় রাখে। এটি শারীরিক এবং মানসিক উভয়ভাবেই স্বাস্থ্যকর জীবনধারণ করতে ও ফিট থাকতে সাহায্য করে। শরীরের অতিরিক্ত ওজন কমাতেও সাইক্লিং করার বিকল্প নেই। এ ছাড়াও এর বিশেষ কিছু উপকার আছে। যেমন সাইক্লিং করার মাধ্যমে আপনার বিপাক ক্রিয়া বেড়ে যায় এবং পেশি তৈরি হয়।

এমনকি আপনি যখন বিশ্রাম নিবেন তখনও দেহ ক্যালোরি পোড়াতে ব্যস্ত থাকবে। এ ছাড়াও সাইকেল চালালে শরীর কীভাবে সুস্থ থাকবে। পায়ের শক্তিও বাড়ে সাইক্লিং করলে। এতে আপনার পায়ের পেশি শক্তিশালী হয়। সাইক্লিংয়ের কর্মক্ষমতা আরও বাড়াতে প্রতি সপ্তাহে কয়েকবার স্কোয়াট, লেগ প্রেস এবং লুঞ্জের মতো ভারোত্তোলন অনুশীলন করুন।

সাইকেল চালানোর উপকারিতা

১। নিয়মিত সাইকেল চালালে ওজন কমে। সাইকেল চালালে ক্যালোরি খরচ বৃদ্ধি পায় এবং মেটাবলিজম বা বিপাকের হার বৃদ্ধি করে, যার ফলে ওজন কমতে সাহায্য করে।
২। সাইকেল চালালে হাইপারটেনশনের রোগীদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে।
৩। সাইকেল চালালে বিশ্রামকালীন হৃদস্পন্দন কমায়। উচ্চ বিশ্রামের হৃদস্পন্দন কারডিওভাস্কুলার রোগীদের মৃত্যুহার বৃদ্ধির সাথে সম্পর্কিত।
৪। সাইকেল চালালে HDL বা ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে LDL বা খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
৫। নিয়মিত সাইকেল চালালে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি কমে যা মালয়েশিয়ার প্রধান ৩টি রোগের একটি। এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে যারা সপ্তাহে ২০ মাইল সাইকেল চালায় তাদের মারাত্মক ও মারাত্মক নয় এমন হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি ৫০ শতাংশ কমে যায়।
৬। সাইকেল চালানো স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। গবেষণায় দেখা গেছে যে, স্ট্যাটিক সাইকেল চালনার ব্যায়াম নিয়মিত করলে হার্ট ফেইলিউরের রোগীদের কার্ডিয়াক ফাংশন উন্নত হয় (Lancet 1990).
৭। ডায়াবেটিস কমায়, গবেষণায় পাওয়া গেছে, ব্যায়াম করলে ডায়াবেটিস মেলাইটিসের হার কমে। যাদের ডায়াবেটিস মেলাইটিস আছে তারা নিয়মিত ব্যায়াম করলে রক্তের সুগার নিয়ন্ত্রণ করে এবং টাইপ ২ ডাইয়াবেটিস মেলাইটিস এর সূত্রপাতকে প্রতিহত করে।
৮। মাংসপেশির গঠনে চমৎকার কাজ করে সাইক্লিং। বিশেষ করে শরীরের নীচের অংশের গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে সাইক্লিং।
৯। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করে।
১০। মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি ঘটায় সাইকেল চালানো।
১১। ডিপ্রেশন, স্ট্রেস ও অ্যাংজাইটি কমায় নিয়মিত সাইক্লিং।
১২। মহিলাদের কোলেসিস্টেকটেমির (অপারেশনের মাধ্যমে পিত্তথলির অপসারণ)হার কমায়।
১৩। সমন্বয়ের দক্ষতা বৃদ্ধি করে সাইকেল চালানো।
১৪। শ্বাস যন্ত্রের পেশীকে ট্রেইন করে সাইক্লিং।

মেয়েদের সাইকেল চালালে কি হয়?

মেয়েদের সাইকেল চালালে হরমোনাল কোন ক্ষতি হয় না, বা খারাপ কোন প্রভাব পড়ে না। অনেকের ক্ষেত্রে হাইমেন বা সতিচ্ছেদ পর্দা ছিড়ে যেতে পারে , তবে এটা এমনিতে বা অন্য কারণেও ছিড়ে যেতে পারে। সাধারণভাবে সাইকেল চালানো শরীরের জন্য ভাল।

সাইকেল চালানোর নিয়ম

বাইসাইকেল চালানোর নিয়ম জেনে তবেই সাইকেল চালানো উচিত। সাইকেল চালানোর সময় কার্যক্ষমতা, সুরক্ষা ও স্বাছ্যন্দ্যের কিছু উপায়- এমন একটি মাঠ খুঁজুন যেখানে ঘাস রয়েছে এবং প্রায় ৩০ গজ এর মত মসৃণ ঢালু রাস্তা রয়েছে যা আবার পরে যেয়ে সমতল হয়ে যায়, বা সামান্য উপর দিকে ওঠে।

যদি প্যাডেল খোলা থাকে, তাহলে প্যাডেল আবার লাগিয়ে নিন (হাত দিয়ে প্যাডেল লাগিয়ে নিতে পারেন, যেন একটা আরেকটার জায়গায় না বসে, এটি বেশ সহজ কাজ) এখন চালককে বলুন প্যাডেল এ পা রেখে চালাতে। প্রথমে শুধু এক প্যাডেল, এবং পরবর্তীতে দুই প্যাডেলে একত্রে। কয়েকবার এভাবে চালানোর পরে চালককে বলুন চলার সাথে প্যাডেলিং করা শুরু করতে। একটি মাঠের সমতল স্থান বা একটি খালি, অব্যবহৃত পার্কিং লটে যান, সেখানে সোজা একটি লাইনে চালানো, বসে ভারসাম্য রাখা, থামানো ও ঘুরানোর চর্চা করতে পারবেন।

একটি প্যাডেল হাতলের দিকে মুখ করে রাখুন (ঘড়ির কাঁটার ২টার দিকে) এর ফলে চালক দৃঢ় ভাবে প্যাডেলে চাপ দিতে পারবে, যার ফলে সাইকেল সামনে এগিয়ে যাবে এবং যতক্ষন আরেক পা প্যাডেলের উপর না আসে ততক্ষন চালক ভারসাম্য রাখতে পারবেন।

দুই ব্রেক একসাথে চাপতে হবে (সাইকেলের সামনে ও পেছনে উভয় পাশে যদি ব্রেক থাকে) শুধুমাত্র সামনের ব্রেক চাপলে, পেছনের চাকা উঁচু হয়ে চালক পড়ে যেতে পারেন, আর শুধুমাত্র পেছনের চাকা ব্যবহার করার ফলে মাত্র ২০-৩০ থামানোর শক্তি কাজে লাগে, ফলে সাইকেল এর পেছনের চাকা পিছলে যেতে পারে। 

মেয়েদের সাইকেল চালানো এখন সামাজিক বিপ্লবে রুপ নিয়েছে। এটি মূলত দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার। একজন নারী তাঁর পরিবার থেকে শুরু করে কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত যদি সাইকেলিং করতে পারে তাহলে জীবনের গতিতে নিজেকে আরও বেশি সামিল করতে পারবে। তাই আসুন মেয়েদের সাইকেল চালানোকে আরও উৎসাহিত করি এবং দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করি। 

লেখক-সাংবাদিক 
কেআই//


Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি