যত দোষ নন্দ ঘোষ, সব মহার্ঘ ভাতার দোষ?
প্রকাশিত : ১৮:৪৬, ২৪ জানুয়ারি ২০২৫
জনগন তার সার্বভৌম সত্তার দেখাশোনা ও নিজেকে আইনের দ্বারা শাসিত হওয়ার শর্তে রাষ্ট্রের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে। সাধারণত মনে করা হয়, জনগণের সুষ্ঠু জীবনধারণের সুযোগ ও ব্যবস্থা রাষ্ট্রই করবে। আধুনিক রাষ্ট্রের ধারণায় রাষ্ট্রকে এই দায়িত্ব প্রদান করা হয়েছে জনগণের পক্ষ থেকে। সেই হিসেবে রাষ্ট্র জনগণের অভিভাবক। এতে কোনো দ্বিমত থাকার কথা না। এটাও চরম সত্য যে, রাষ্ট্র যদি জনগণের অভিভাবক হয়ে থাকে তবে রাষ্ট্র সরকারি কর্মচারীদের ডাবল অভিভাবক। কারণ তারা সরকারের হয়ে কাজ করে এবং একইসাথে তারা এই রাষ্ট্রেরই জনগণ!
তাই সরকারি কর্মচারীদের জীবন ও জীবিকার মান যেন এমন পর্যায়ে পৌঁছে না যায়, যাতে তার পরিবারের ভরণপোষণ চালাতে নাভিশ্বাস না উঠে। সেই চিন্তা রাষ্ট্রকেই করতে হয়৷ এবং সেই অনুযায়ী বেতন ভাতাদি নিশ্চিত করতে হয়। দুনিয়া জুড়ে সেটাই হয়ে আসছে। এমনকি সিরিয়ায় স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের পতনের পর সিরিয়ান গণকর্মচারীদের বেতন ৪০০ শতাংশ বাড়িয়ে তাদের জীবনমানের খরচের সমন্বয় করা হয়েছে। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক বিষয় হচ্ছে আফগানিস্তানের একজন সর্বনিম্ন বেতনের সরকারি কর্মচারী বাংলাদেশ ২০ গ্রেডের একজন কর্মচারীর চেয়ে বেশি বেতন পান৷
আমরা জানি, রাষ্ট্র একটা যন্ত্রের মতো কাজ করে, রাষ্ট্র যন্ত্রের হয়ে জনগণকে যথাযথ সেবা পৌঁছে দিতে কাজ করে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী নামক বিশাল কর্মিবাহিনী। এই কর্মিবাহিনীর সংখ্যা ২০২২ সালের হিসেব অনুযায়ী প্রায় সাড়ে ১৫ লাখ। এই সাড়ে ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারী রাষ্ট্রের হয়ে জনগণকে সেবা পৌঁছে দেয় এবং রাষ্ট্র জনগণের হয়ে এই কর্মচারীদের বেতন-ভাতাদি প্রদান করে থাকে। এই সাড়ে ১৫ লাখ কর্মীর বেতন ভাতাদি প্রদান করা হয় একটা ‘বেতন ও ভাতাদি আইন বা পে-স্কেল’-এর মাধ্যমে।
সময়ের পরিক্রমায় মূল্যস্ফীতির কারণে অর্থের মান কমে যায় তথা অর্থের ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়। তাই সময়ে সময়ে সরকারি কর্মচারীদের বেতন পে স্কেলের মাধ্যমে সমন্বয় করা হয়। যেমন, ১৯৭৩ সালে প্রথম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়। এরপর নিয়মিত বিরতিতে গড়ে ছয় বছরের ব্যবধানে পরবর্তী পে-স্কেলগুলো ঘোষিত হয়ে আসছিল। সর্বশেষ ২০১৫ সালে অষ্টম পে-স্কেল ঘোষণা করা হয়েছি। এরপর ১০ বছরে আমরা একটা বৈশ্বিক মহামারি ও মহামারি-পরবর্তী বৈশ্বিক আর্থিক মন্দা পাড়ি দিয়েছি। একইসঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সংকট সৃষ্টিকারী যুদ্ধ পার করছে বিশ্ব।
২০১৫ সালের সেই পে-স্কেল বর্তমানে যে সম্পূর্ণ অকার্যকর হয়ে পড়েছে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখেনা। কীভাবে এই ২০১৫ সালের অষ্টম পে-স্কেল চরমভাবে অকার্যকর হয়ে পড়েছে, তা স্বল্প কথায় আলোচনা করা যাক। ২০১৫ থেকে ২০২৫ এই ১০ বছরের বাজার দরের সঙ্গে বেতনের ক্রয়ক্ষমতার তুলনা করে একটা ‘প্রাইস বাস্কেট’ যদি আমরা কল্পনা করি, তাহলে বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা একজন প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মকর্তার চাকরি শুরুর বেতনকে ভিত্তিমূল্য হিসাবে বিবেচনা করব। ২০১৫ সালের পে-স্কেল অনুসারে প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তা যোগদানকালে আনুমানিক ৩৩ হাজার ৫০০ টাকা বেতন পান।
প্রথমে আমরা ২০১৫ সালের বেতনকে ২০২৫ সালের প্রেক্ষাপটে গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডে তুলনা করলে দেখতে পাই, ২০১৫ সালে ২২ ক্যারেটের সোনার দাম ভরিপ্রতি ছিল ৪৩ হাজার ২৭৩ টাকা। সে হিসাবে ২০১৫ সালের এক মাসের বেতন ছিল প্রায় ৯ গ্রাম সোনার দামের সমান। ২০২৫ সালের শুরুতে এসে সোনার দাম হয়েছে এক লাখ ৩৮ হাজার টাকা। সে হিসাবে ২০২৪ সালের এক মাসের বেতন হচ্ছে ২ দশমিক ৮ গ্রাম সোনার দামের সমপরিমাণ। সুতরাং গোল্ড স্ট্যান্ডার্ডের হিসাবে ২০১৫ সালের পে-স্কেলে ঘোষিত বেতন ২০২৫ সালের শুরুতে এসে ৬৮ দশমিক ৮ শতাংশ কার্যকারিতা হারিয়েছে।
এবার বিশ্বব্যাপী প্রচলিত ডলার স্ট্যান্ডার্ড হিসেব করলে দেখতে পাই, ২০১৫ সালে ডলারের বিনিময় হার ৭৬ টাকা হিসাবে বেতন ছিল ৪৪০ ডলার। আর বর্তমানে ডলারের বিনিময় হার গড়ে ১১৯ টাকা হিসাবে বেতন হয় ২৮১ ডলার। মানে ২০১৫ সালে একজন কর্মকর্তা যে বেতনে চাকরি শুরু করেছিলেন, বর্তমানে ২০২৫ সালের শুরুতে এসে প্রথম শ্রেণির একজন কর্মকর্তা সেই একই পদে একই চাকরির শুরুতে তার চেয়ে ১৫৯ ডলার কম বেতন পাচ্ছেন। এ হিসাবে বর্তমানে বেতন কমেছে ৩৬ শতাংশ।
এমন বৈষম্যমূলক বেতন স্কেলেও সরকারি কর্মচারীরা সেবা দিয়ে যাচ্ছিল৷ কিন্তু ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী যদি গদ্যময় হয়, তবে পূর্ণিমার চাঁদকেও ঝলসানো রুটি মনে হবে। বিখ্যাত মার্কিন মনোবিদ আব্রাহাম মাসলো মানুষের চাহিদাকে ৫ ভাগে ভাগ করে সেটাকে প্রেষণার সাথে তুলনা করে দেখিয়েছেন। সেখানে সর্বনিম্ন স্তরে আছে জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদা। এই দুইটা চাহিদা মেটাতে মানুষ হিমসিম খেলে সে অন্যকে সেবা দেয়ায় কতটুকু মনযোগ দিতে পারবে তা আরেক বিখ্যাত মনোবিশারদ ডগলাস ম্যাকগ্রেগর প্রশ্ন করে গিয়েছেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার আসার পরে কর্মচারীদের পে-স্কেল দিয়ে জীবনযাপন খরচ সমন্বয় করা হবে বলে সবাই আশা করে ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মহার্ঘভাতার ঘোষণাকল্পে কমিটি করা হয়েছিল। সেই কমিটির পক্ষ থেকে দ্রুত মহার্ঘভাতা ঘোষণার কথা জানানো হলেও আজ ‘সমকাল’ পত্রিকার বরাতে জানা গিয়েছে মহার্ঘভাতা নাকি দেয়া হচ্ছে না!
বাকি জনগণের জন্য মূল্যস্ফীতি আসলে তা সরকারি কর্মচারীদের জন্যও আসে। তাই মূল্যস্ফীতিকে বাধা হিসেবে দেখে মহার্ঘভাতাকে ফাইল চাপা দিলে সেটা সামষ্টিক ভাবে কল্যাণ বয়ে নিয়ে আসতে পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক: শিক্ষক, বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।