‘যদি কিন্তু তবুও’ আমার ক্যারিয়ারে প্লাস পয়েন্ট: শিহাব শাহীন
প্রকাশিত : ১৭:৪২, ২৫ এপ্রিল ২০২১ | আপডেট: ২১:২৮, ৩ মে ২০২১
দেশে ও দেশের বাইরে রীতিমত হৈচৈ ফেলে দিয়েছে রোমান্টিক ওয়েভ ফিল্ম ‘যদি কিন্তু তবুও।’ গত ১ এপ্রিল থেকে ছবিটি দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ ওটিটি প্ল্যাটফর্ম জিফাইভে। জিফাইভ অরিজিনাল ‘যদি কিন্তু তবুও’ পরিচালনা করেছেন জনপ্রিয় পরিচালক শিহাব শাহীন।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র পরিচালক শিহাব শাহীনের সাথে কথা হয় ওয়েব ফিল্ম ‘যদি কিন্তু তবুও’ নিয়ে। পাশাপাশি তিনি জানিয়েছেন জিফাইভের সাথে তাঁর কাজের অভিজ্ঞতার কথা। তাঁর মতে, এখনকার সময়ে ওয়েব ফিল্ম একটি বাস্তবতা। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘জি-ফাইভের এ প্রজেক্টটিকে আমি আমার ক্যারিয়ারে একটা ভালো প্লাস পয়েন্ট হিসেবে যোগ করব।’
প্রশ্ন: জিফাইভের সাথে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
শিহাব শাহীন: জিফাইভের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা খুবই ভালো। একটা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম। কোটি টাকার ওপর বাজেট নিয়ে কাজ করছি আমরা। এটা আমাদের বাংলাদেশের পরিচালকদের জন্য খুবই সৌভাগ্যের বিষয়। আমরা আন্তর্জাতিক মানের ছবি করতে পারছি। এ সুযোগটা জিফাইভ আমাদের জন্য এনে দিয়েছে। আমাদের তরুণ নির্মাতাদের জন্য এটা একটা বড় সুযোগ। আমরা যারা ভালো ভালো গল্প নিয়ে বসে আছি, যারা ভালো প্রতিষ্ঠান পাচ্ছে না, ভালো প্লাটফর্ম পাচ্ছে না, তাদের জন্য একটি বড় সুযোগ জিফাইভ। আমি সেই দায়িত্বটা নিয়েই কাজ করেছি যাতে আমাদের নির্মাতাদের পথ সুগম থাকে। কোনো প্ল্যাটফর্ম বা প্রতিষ্ঠান যেন বলতে না পারে যে বাংলাদেশের নির্মাতাদের সাথে কাজ করে আনন্দ পাইনি বা ঠিক হয়নি। সেই দায়িত্ব নিয়েই আমি কাজটা করেছি।
সব মিলিয়ে আমি বলব জিফাইভ পেশাদার একটি প্রতিষ্ঠান। ফিল্ম নির্মাণের প্রত্যেকটি পর্যায় তারা চমৎকার পেশাদারিত্বের সাথে সম্পাদন করেছেন। কমপ্লিট একটা ফিল্ম মেকিং জার্র্নি আমরা করেছি। তাদের এই এটিচিউটটা আমার খুব ভালো লেগেছে। স্টেজ, লাইট, কাস্টিং কস্টিউম কোনো জায়গায়ই ওরা ছাড় দেয়নি। সব কিছুই পেশাদার উপায়ে হয়েছে। কোনো পর্যায়ে এমন ছিল না যে, কী হবে জানি না। সব কিছুই আগে থেকে প্রি-প্ল্যান নিয়ে হয়েছে। খুব ভালো কম্বিনেশন ছিল। এটাই দরকার। একজন ভালো প্রডিউসারের কাছ থেকে এটাই প্রয়োজন। এটাই আমরা চেয়েছি যাতে আমাদের নির্মাতারা ভবিষ্যতে আরো ভালো সুযোগ পান।
প্রশ্ন: গত ১ এপ্রিল মুক্তি পেয়েছে আপনার ‘যদি কিন্তু তবুও’। এটা নিয়ে আপনার প্রত্যাশা কেমন?
শিহাব শাহীন: এটা যেহেতু ফ্রি তাই সবাই দেখতে পাবেন। শুধু জিফাইভ অ্যাপটা ডাউনলোড করলেই হয়ে যাচ্ছে। তারা ধরতে পারবেন। ফ্রি কনটেন্ট হিসেবে যে কেউ যে কোনো সময় দেখতে পারবেন যে কোনো ডিভাইস থেকে।
জিফাইভের এ প্রজেক্টটিকে আমি আমার ক্যারিয়ারে একটা ভালো প্লাস পয়েন্ট হিসেবে যোগ করব। আমার আশা দর্শকরা একটা ভালো গল্প দেখতে পাবেন। তারকাদের নতুন কম্বিনেশন দেখতে পাবেন এখানে। ভালো অভিনয় উপভোগ করতে পারবেন তারা। এটার একটা সুফল আমি আশা করছি।
প্রশ্ন: ওয়েব ফিল্ম এবং প্রচলিত ফিল্মের মধ্যে পার্থক্যটা কী রকম মনে হয় আপনার কাছে?
শিহাব শাহীন: এখন ডিজিটাল মিডিয়ার যুগ। এখনকার পৃথিবীতে, এখনকার সময়ে ওয়েভ ফিল্ম একটি বাস্তবতা। এখানে প্রডাকশন স্কেলের জায়গা থেকে খুব একটা পার্থক্য আজকাল কেউ রাখবেও না যে, কম বাজেটে ওয়েব ফিল্ম করে ফেলি। ব্যাপক আয়োজন নিয়ে, ব্যাপক ইনভেস্টমেন্ট নিয়ে, ভালো গল্প, ভালো নির্মাতাদের দিয়ে ফিল্ম হচ্ছে। থিয়েটার প্রজেকশন এবং ড্রয়িং রুমে বসে ডিভাইসে দেখা, এই পার্থক্য ছাড়া আর কোন পার্থক্য আমরা ওয়েব ফিল্মে দেখতে পাচ্ছি না।
আরেকটি সুবিধা হলো আমরা নির্মাতারা স্বাধীনভাবে গল্প বলতে পারছি। দর্শকদের গ্রহণযোগ্যতার সীমা কতটা আছে, কতটা তারা নিতে পারবে সেটা বিবেচনা করে আমরা নির্মাতারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি। সেই জায়গা থেকে সেন্সরবিহীন অবস্থায় হলেও আমরা আমাদের সংস্কৃতি, দর্শকদের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি মাথায় রেখে কাজ করছি। এই জায়গা থেকে ওয়েব ফিল্মে কাজ করা অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যদায়ক। দর্শকদের সাথেও তাৎক্ষণিকভাবে যোগাযোগ হয়ে যাচ্ছে আমাদের। সব মিলিয়ে ওয়েব ফিল্ম এবং ফিল্মে পার্থক্য আমি একটাই দেখি প্রজেশন সাইট এবং থিয়েটার প্রজেকশন। প্রডাকশন স্কেল এবং এটিচিউড এর দিক দিয়ে আমি এটাকে ফিল্ম হিসেবেই নির্মাণ করি। তবে এটা যাচ্ছে ওয়েবে। এই হলো পার্থক্য।
প্রশ্ন: এবার ঈদুল ফিতরে আপনি দর্শকদের কী উপহার দিতে যাচ্ছেন?
শিহাব শাহীন: টেলিভিশনের জন্য বেশ কিছু প্ল্যাটফর্মে কাজ করছি। বেশ কিছু গল্প নিয়ে অপূর্ব, নিশো, মেহজাবিন, সাবিলা, তারিন এদের সবাইকে নিয়ে কাজ করছি। বেশ কিছু গল্প করছি। আশা করছি প্রজেক্টগুলো দেখতে পাবেন দর্শক। সময় আসলে প্রচারিত হবে। অন্যান্য কাজও আছে।
প্রশ্ন: বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিনোদনের ক্ষেত্রে ওটিটি প্ল্যাটফর্ম কী ধরনের প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে ?
শিহাব শাহীন: আমরা যে ধরনের বিনোদনে অভ্যস্ত, আমাদের নাটকের দর্শক যারা আছেন তাদের জন্য ইউটিউবও একটি অনলাইন প্লাটফর্ম। সেখানে ছোট স্কেলে, খুবই অল্প বাজেটে, তোড়জোড় করে আমরা আমাদের গল্পগুলো বলেছি। সেগুলোকে ফুললেংথ ফিচার ফিল্ম বলাই যায় না। খুবই সীমিত বাজেটে ৪০/৪৫ মিনিটের নাটক আমরা করেছি। সীমাবদ্ধ লোকেশন। কিছুটা ছাঁচেবাঁধা কাজ করতে হয় আমাদের। কিন্তু ওটিটি বিষয়টা দর্শকদের জন্য বিনোদন জগতে নতুনভাবে এসেছে। আমার এই ফিল্মটা যারাই দেখেছেন তারা বলেছেন, বাহ! দেখতে তো পুরো ফিল্মই লাগছে, বলিউডই লাগছে। কেউ বলেছেন, মালায়ান লাগছে, কেউ বলেছেন তামিল লাগছে। নানাভাবে দর্শকরা এটাকে বিশেষায়িত করছেন।
তারা ফ্রি দেখতে পাচ্ছেন। ফলে বিরাট একটা পরিবর্তন আসবে যদি ভালো ভালো গল্প সবাই নির্মাণ করতে পারেন। যদি ভালো বাজেট পাওয়া যায় ইজিলি কাজ করতে পারবেন সবাই। বিনোদন জগতের চিত্রটাই বদলে যাবে তখন।
প্রশ্ন: ডিজিটাল বিনোদনে যদি আরো ভালো করতে চাই, আমাদের ইন্ডাস্ট্রিকে আরো ভাল করতে চাই সেক্ষেত্রে নতুনদের প্রতি আপনার পরামর্শ কী?
শিহাব শাহীন: ভালো গল্প বলতে হবে। নিজের গল্প, মৌলিক গল্প, বাংলাদেশের গল্প বলতে হবে। ভাবনাকে মুক্ত রেখে স্বাধীনভাবে কাজ করার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। ধীরে ধীরে এ পথ উন্মুক্ত হচ্ছে, আরো হবে। আমরা যারা এখন কাজ করছি আর বেশি দিন হয়তো করতে পারব না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে চাই না যে কারো পথ বন্ধ হোক আমার কাজের কারণে, মুখ ফিরিয়ে চলে যাক কোনো প্ল্যাটফর্ম। নির্মাতাদের কাছে আমার একটাই অনুরোধ, ভালো গল্প, মৌলিক গল্প নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। রুচির চেঞ্জ দরকার। বাংলাদেশের কনটেন্ট সারা বিশ্বের ৩৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষীর কাছে আদর্শ হয়ে থাকে যেন। মার্কেটে আমরা যেন ভাল কিছু দিতে পারি। সম্পূর্ণ মেধাকে বিনিয়োগ করে আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে। সে সুযোগ আসছে এবং সেই সততা নিয়ে কাজ করতে হবে। এটাই আমার পরামর্শ।
প্রশ্ন: আপনি বলেছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে আপনি ‘যদি কিন্তু তবুও’ ফিল্ম করেছেন। ২০১৯ সাল থেকে আপনি কাজ করছেন এটা নিয়ে। এ ফিল্ম করার ক্ষেত্রে আপনার কী কী চ্যালেঞ্জ ছিল?
শিহাব শাহীন: মূল চ্যালেঞ্জ ছিল কোভিড-১৯। প্রডাকশনটা ক্লোজ করাটাই মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রডাকশনের এক পর্যায়ে সমস্ত কিছু বন্ধ হয়ে যায় লকডাউনের কারণে। শুটিংয়ের প্রথম দিনই আমাদের কাজ বন্ধ করে দিতে হয় লকডাউনের কারণে। তখন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায় আদৌ ফিল্মটি হবে কিনা। তারপর অপূর্ব, ফারিয়া, আমি নিজেও করোনো আক্রান্ত হলাম। বারবার আমাদের শুটিং বন্ধ করতে হয়েছে। এ কারণে অর্থনৈতিকভাবেও চাপের মধ্যে পড়তে হয়। তারপর পোস্ট প্রডাকশনে গিয়েও- ঢাকা, কোলকাতা মুম্বাই- তিন জায়গায় তিনভাবে, তিন স্টেজে কাজ করতে হয়েছে। এডিটিং বাংলাদেশে হয়েছে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক মুম্বাইয়ে হয়েছে। কালার কালেশন, সাউন্ড মিক্সিং, সাউন্ড ডিজাইন কোলকাতায় হয়েছে। অনলাইনে এসব কাজ কোঅর্ডিনেট করা আমার জন্য একটি চ্যালেঞ্জ ছিল। এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন অভিজ্ঞতাও হয়েছে। অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছি ফিল্মটি করতে গিয়ে। সর্বশেষ ছবিটি মুক্তির ঠিক আগে দুই তিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়া ডাউন। এটাও আমাদের প্রমোশনের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। যতরকম আছে সব চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়েই আমরা এগিয়েছি। ক্যামেরা ভেঙ্গেছে, সেটের সমস্যা হয়েছিল। একটা কথা আছে। যত বাধা আসবে তত হিট। দর্শক এটা এখন ভালভাবে গ্রহণ করবে এই বিশ্বাসটা আছে। দেখা যাক।
প্রশ্ন: ১৯০টি দেশে এক সাথে ছবিটি দেখা যাচ্ছে। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কী?
শিহাব শাহীন: আমি খুবই অভিভূত, খুবই আপ্লুত যে, সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ আমাদের কনটেন্টটা দেখতে পারছেন। হয়তো ইন্ডিয়া ছাড়া সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষ এটা দেখতে পাবেন। ফিল্ম বানালে হয়তো এটা সম্ভব হতো না। আমাদের বিপণন অবস্থা এখনো সেই পর্যায়ে যায়নি যে এক সাথে সারা বিশ্বের হলে ছবি মুক্তি দেয়া সম্ভব। কিন্তু ডিজিটাল মিডিয়ায় এখন এটা সম্ভব। ১৯০টি দেশের মানুষ একসাথে দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু ১৯০টি দেশের সিনেমা হলে আমরা ফিল্ম মুক্তি দিতে পারতাম না।
আমি খুবই আনন্দিত যে, একসাথে এত মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের কাজ। আশা করি তারা দেখবেন এবং সবাই উপভোগ করবেন।
প্রশ্ন: আপনার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা বিশেষ করে জিফাইভের সাথে যদি আপনার আরো কাজের সুযোগ হয় সেক্ষেত্রে আপনি আরো ভালো কী উপহার দিতে চান?
শিহাব শাহীন: আমি অবশ্যই আশা করি ভালো কাজের সুযোগ আসবে। জিফাইভ আমার সাথে আরো কাজ করবে কিনা সেটা তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়। তবে আমি আশা করছি আমরা ভবিষ্যতে আরো কাজ করতে পারবো একসাথে। ভালো গল্প নিয়ে আসতে পারব।
আরকে//