যে মানুষ প্রচণ্ড শীতেও রাস্তার পাশে ঘুমায়
প্রকাশিত : ২২:৪৮, ৯ জানুয়ারি ২০২৩
একটি মানবিক ছোঁয়া আমায় বার বার এসে ধাক্কা মারে। প্রায়ই দেখি মিন্টু রোড়ের দু'পাশে অনেক মানুষ এই প্রচন্ড শীতে ঘুমিয়ে রাত পার করছে। মগবাজার মোড় দিয়ে হাঁটা ধরলে আইডিবি মিলনায়তন বা কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত যেতে কম করে হলেও ২৪ থেকে ৩০ জন নর নারীকে শুয়ে থাকতে দেখা যাবে। দেখা যাবে হাতির ঝিল রাস্তা ধরে হাঁটলেও একই অবস্থা।
এদের মধ্যে কেউ কেউ একদম সুস্থ মানুষ তাও বলা যাবে না।কেউ নেশায় বুদ হওয়া,কেউ বা মাথায় ঝাঁকড়া চুল নিয়ে পাগলভাব নিয়ে শুয়ে।কেউ বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে স্বামীটিকে সাথে করে ঘুমে,বিস্ময়কর কোনো কোনো যুবক যুবতীও আছেন রাতকে সম্বল করে জীবন
জীবিকার তালে।
এই সব মানুষের সাথে আমরা কেউ কেউ কথা বলতেও ভয় পাই। ভয় পাওয়া স্বাভাবিক বটে।কোন দিক দিয়ে আবার কোন অপবাদে জড়িয়ে পড়ে। আসলে সব সময় মানুষ যে ঘটনা বা দৃশ্যের মধ্য দিয়ে দিনরাত পার করে, তার মধ্যে তাঁকে খুব বেশি বিচলিত করে না বললেই চলে। আমি এই দু'টি পথে প্রায়ই হেঁটে পথ চলি। হেঁটে চলার কারণও একটাই হাঁটা ব্যায়ামটি কার্যকর রাখা।তখন তাদের দুয়েক জনের সাথে আমার কথাও হয়েছে। কারো বাড়ি কিশোরগন্জ,কারো বাড়ি জামালপুর, কারো বাড়ি দিনাজপুর, আবার কেউবা গোপালগঞ্জ। পাঁচ সাত বছর এই সব জায়গায় বরিশালের মানুষ পেতাম।এখন তাঁরা নেই, আছে হবিগন্জ,রংপুরের মানুষ।
এই সব মানুষ কোনো রাজনীতি বোঝে না,তাঁরা হাসিনা -খালেদা, মুজিব - জিয়া, বা তারেক - জয়,কিংবা মেয়র আতিক- তাপস নিয়ে কথা বলে না।তাদের এ সব বিষয় নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হলে জবাব দেয় ' আমি নৌকার মাঝি জাহাজের খবর দিয়ে কী করুম? আমি একদা তাদের দু চার জনকে বাসায় এনে খাওয়াতে চাইলে রাজি হলো না।সাফ সাফ জবাব, সাহেব আপনার বাসার কাছে যাঁরা আছেন, তাঁদের খাওয়ান।এতোদূর আসার কী দরকার?
এইসব মানুষগুলো রাশিয়া কার সাথে যুদ্ধে জড়িয়ে, তাতে তেলের দাম,ডালের দাম,চাল আটা ময়দার দাম বাড়া যৌক্তিক নাকি অযৌক্তিক তা কক্ষনো জানতে চায় না।তাঁরা শুধু এক বেলা খাওয়া আর পুলিশ কর্তৃক ধাওয়া না খেলেই সুখী। অথচ দেখেন, এই সব মানুষগুলো আমাদের কারো না কারো অনেক কাছের মানুষ। আমার জেলা উপজেলার মানুষ এঁরা। দিলু রোডের মাঝার মসজিদের কাছে এক বুড়ো মানুষ ঘুমায়।রাস্তার পাশে মশারি টানিয়ে ঘুমায়।আমি একদিন জানতে চাইলাম বাড়ি কই? জবাব মাদারীপুর। আমি বলি, আপনি তো আমার বাড়ির কাছের মানুষ। আমার বাড়ি পিরোজপুর। পুরে পুরে মিল, মারবো নাকি ভালোবাসার কিল? উভয়ে হাসলাম।
বুড়ো জানালেন ছেলে মেয়ে সবাই ভালো আছে, কিন্তু কেউ আমার খোঁজ খবর নেয় না। তাই তাঁদের কষ্ট থেকে মুক্তি দিতে আমি পথে এসে বসে পড়েছি। আমার চিন্তা চেতনা মাঝে মাঝে ভোতা হয়ে যায়। আসলে আমরা কে বা কারা? আমরা কী মানুষ হয়ে এই সব মানুষদের
বাঁচাতে, ভালোভাবে বাঁচতে কিছুই করতে পারি না? নাকি করি না?
মিল্টন সমদ্দার। একজন খ্রিস্টান। কী ভীষণ মায়া মমতায় প্রায় ১৫০/২০০ লোকের দেখভাল করেন কল্যাণপুরের মতো জায়গায়। থাকার জায়গা দিচ্ছেন, খাওয়া-দাওয়া, চিকিৎসাও। ভাবুন, তিনি একা। তাঁর সর্বস্ব দিয়ে এই মহৎ কাজ করে যাচ্ছেন। এখন মিল্টন বলেন, আমার দুইশ জন মা -বাবা। আমি তাঁদের একমাত্র ছেলে। এই কর্মযজ্ঞ-আমাদের কী কিছু শেখায়? না-কি আমরাও সেই সব মানুষদের দলে চলে যাবো যাঁরা আয় একটা রাতের জন্য জমা করে রাখেন, ইচ্ছে মতো খরচ করেন, আবার টাকা শেষ হলে আয়ের পথ খোঁজেন।
একটা মানুষ। কখনোই সত্যিকার মানুষ নয়, যদি তাঁর আয়ের অংশটিতে গরীব-দুঃখীর অংশ না থাকে? আমরা ভালোবাসা চাই, প্রচার চাই না। মানুষের অসহায় মুহূর্তে যেন প্রকৃত সহায়ক হতে পারি। স্রষ্টা আমাদের সেই শক্তি, সাহস দান করুন।
(ফেসবুক থেকে পাওয়া)
কেআই//