যে ৮ নারী মহাত্মা গান্ধীর ছায়াসঙ্গী ছিলেন
প্রকাশিত : ১৬:৩০, ৪ অক্টোবর ২০১৮
মহাত্মা গান্ধী ১৫০তম জন্মদিন গেল ২ অক্টোবর। এদিন উপলক্ষে গান্ধীকে নিয়ে চর্চা শুরু হয়েছে। উঠে আসছে গান্ধীর জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। আট নারীর অনুপ্রেরণা ছিলেন মহাত্মা গান্ধী।
মহাত্মা গান্ধীর বহু ছবি ভাইরাল হয়েছে। বেশিরভাগ ছবিতেই দেখা যায় তাঁর পাশে অনেক মানুষ রয়েছেন। এঁদের মধ্যেও আবার জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল বা মহাত্মা গান্ধীর স্ত্রী কস্তুর্বা গান্ধীর ছবিই বেশি দেখা যায়।
গান্ধীর এমন কয়েকজন ঘনিষ্ঠ ছিলেন, যাঁদের সাধারণত ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না। সেরকমই কয়েকজন নারীকে নিয়েই এই প্রতিবেদন।
এই নারীদের প্রত্যেকের জীবনেই মহাত্মা গান্ধীর আদর্শ একটা বড়সড় প্রভাব ফেলেছে, যে রাস্তায় চলে পরবর্তী জীবনে তাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে এগিয়েছেন।
তাঁদেরই মধ্যে একজন মেডেলিন স্লেড ওরফে মীরাবেন। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল স্যার এডমন্ড স্লেডের কন্যা। উচ্চপদস্থ এক ব্রিটিশ অফিসারের মেয়ে হওয়ার কারণে তাঁর প্রথম জীবনটা ছিল কঠোর অনুশাসনে বাঁধা।
স্লেডের লেখা মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সেই জীবনী মেডেলিন স্লেডের জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল, যে তিনি গান্ধীর পথেই চলার সিদ্ধান্ত নেন।
এতটাই রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন মেডেলিন যে, গান্ধীকে নিজের মনের কথা জানিয়ে একটা চিঠি লেখেন। সেই চিঠিতেই জানিয়েছিলেন যে, গান্ধী-আশ্রমে আসতে চান তিনি। মদ ছেড়ে দিয়েছিলেন, চাষবাসের কাজ শিখতে শুরু করেছিলেন, এমন কি নিরামিষাশীও হয়ে গিয়েছিলেন মেডেলিন স্লেড। নিয়মিত পড়তে শুরু করেছিলেন গান্ধীর সম্পাদিত কাগজ `ইয়ং ইন্ডিয়া`। অবশেষে, ১৯২৫ সালের অক্টোবর মাসে মুম্বাই হয়ে আহমেদাবাদে পৌঁছিয়েছিলেন মেডেলিন স্লেড।
জন্মসূত্রে বাঙালী ছিলেন আভা গান্ধী। তাঁর বিয়ে হয়েছিল মি. গান্ধীর সম্পর্কে নাতি কানু গান্ধীর সঙ্গে। গান্ধীর সব প্রার্থনা সভায় ভজন গাইতেন আভা আর ছবি তুলতেন তাঁর স্বামী কানু। শেষমেশ, যখন নাথুরাম গডসে গান্ধীকে গুলি করে হত্যা করে, তখনও পাশেই ছিলেন আভা গান্ধী। ভারতের স্বাধীনতার সময়ে দাঙ্গা বিধ্বস্ত নোয়াখালীতে আভা গান্ধীর আর মনু গান্ধীই ছিলেন গান্ধীর ছায়াসঙ্গী। গান্ধীর যে অতি পরিচিত ছবিগুলো দেখতে পাওয়া যায়, তার অনেকগুলিতেই গান্ধী যে দুই নারীর কাঁধে ভর দিয়ে চলতেন, সেই দুজন ছিলেন আভা গান্ধী আর মনু গান্ধী।
একবার গান্ধীর বিরোধীরা তাঁর যাওয়ার রাস্তায় মল-মূত্র ফেলে রেখে দিয়েছিল। ঝাড়ু হাতে সেগুলো পরিষ্কার করতে এগিয়ে গিয়েছিলেন আভা আর মনু গান্ধীই। মনু গান্ধীর ডায়েরীর পাতাগুলোয় মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনের শেষ কয়েক বছরের পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা পাওয়া যায়।
মহাত্মা গান্ধীর ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন আরেক বিদেশিনী নীলা ক্র্যাম কুক। আদতে মার্কিন নাগরিক মিজ কুক মাইসোরের রাজকুমারের প্রেমে পড়েছিলেন। সেখানে থাকার আগে রাজস্থানের মাউন্ট আবুতে এক ধর্মীয় গুরুর কাছেও থাকতেন তিনি।
১৯৩২ সালে প্রথমবার নীলা চিঠি লেখেন মহাত্মা গান্ধীকে। ব্যাঙ্গালোর থেকে পাঠানো সেই চিঠিতে তিনি অস্পৃশ্যতা বিরোধী আন্দোলন নিয়ে সেখানে ঠিক কী হচ্ছে, তার বিস্তারিত বর্ণনা জানিয়েছিলেন। তারপর থেকে শুধু চিঠিতেই দুজনের যোগাযোগ ছিল। গান্ধীই তাঁকে সবরমতী আশ্রমে পাঠানোর বন্দোবস্ত করেছিলেন। উদার চিন্তাভাবনার মিজ কুকের পক্ষে গান্ধী-আশ্রমের পরিবেশে বেশী দিন মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হয় নি। একদিন হঠাৎই তিনি আশ্রম থেকে পালিয়ে যান। পরে তাঁকে বৃন্দাবনে খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইঝি সরলা দেবী চৌধুরাণী গান্ধীর ভক্ত ছিলেন। উচ্চ শিক্ষিত, সৌম্য দর্শন সরলা দেবী বিভিন্ন ভাষাচর্চা, সঙ্গীত আর লেখালেখির মধ্যেই থাকতে পছন্দ করতেন।
তাঁর স্বামী, স্বাধীনতা সংগ্রামী রামভূজ দত্ত চৌধুরী যখন জেলে ছিলেন, সেই সময়ে একবার লাহোরে গিয়ে গান্ধী তাঁর বন্ধু ও ঘনিষ্ঠ মি. দত্ত চৌধুরীর বাড়িতেই উঠেছিলেন। সেই সফরের সময়েই সরলাদেবীর সঙ্গে গান্ধীর ঘনিষ্ঠতা শুরু হয়।
সরলাদেবীকে নিজের `আধ্যাত্মিক পত্নী` বলে মনে করতেন গান্ধী। পরে নিজেই স্বীকার করেছিলেন গান্ধী, যে ওই সম্পর্কের কারণে তাঁর বিবাহ ভেঙ্গে যাওয়ার পর্যায়ে চলে গিয়েছিল। শেষমেশ অবশ্য গান্ধীর বিয়ে ভাঙ্গেনি। কিন্ত দুজনের সম্পর্ক নিয়ে নানা কথা পৌঁছতে শুরু করেছিল গান্ধীর ঘনিষ্ঠদের কানেও। হঠাৎই নিজেকে সরলাদেবীর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেন মি. গান্ধী।
গান্ধীর আরেক ঘনিষ্ঠ নারী ছিলেন সরোজিনী নাইডু। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম নারী সভাপতি ছিলেন তিনি। দুজনের প্রথম সাক্ষাত হয়েছিল লন্ডনে। সেই বিষয়ে সরোজিনী নাইডু লিখেছিলেন, একজন ছোটখাটো চেহারার মানুষ। মাথায় একটাও চুল নেই। মেঝেতে কম্বল পেতে বসে তিনি তেলে ভেজানো টম্যাটো খাচ্ছিলেন তখন। সারা পৃথিবীর মানুষ তখন গান্ধীকে চেনে। সেই মানুষটাকে ওইভাবে দেখে আমি হেসে ফেলেছিলাম। উনি চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, `নিশ্চয়ই আপনিই মিসেস নাইডু? এতটা অশ্রদ্ধা আর কে-ই বা করতে পারে আমাকে? আসুন, আমার সঙ্গে খাবার শেয়ার করুন। এইভাবেই সরোজিনী নাইডু আর মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল।
রাজকুমারী অমৃত কৌর পড়াশোনা করেছেন ইংল্যান্ডে। ১৯৩৪ সালে প্রথমবার দেখা হওয়ার পর থেকে গান্ধী আর রাজকুমারীর মধ্যে অসংখ্য চিঠি চালাচালি হয়েছে। অমৃত কৌরকে লেখা চিঠিগুলো গান্ধী শুরু করতেন এইভাবে- ‘আমার প্রিয় পাগলী আর বিদ্রোহী’ বলে। অমৃত কৌরকে গান্ধীর সবথেকে ঘনিষ্ঠ সত্যাগ্রহীদের মধ্যে একজন বলে মনে করা হত। লবণ সত্যাগ্রহ বা ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলনে জেলেও যেতে হয়েছে রাজকুমারী অমৃত কৌরকে। পরে স্বাধীন ভারতের প্রথম স্বাস্থ্য মন্ত্রী হয়েছিলেন অমৃত কৌর।
ডা. সুশীলা নায়ার (১৯১৪-২০০১) ছিলেন গান্ধীর ব্যক্তিগত সচিব পেয়ারেলালের বোন। দীর্ঘদিন সচিবের কাজ সামলিয়েছেন যে মহাদেব দেশাই, তাঁর পরে পাঞ্জাবী পরিবার থেকে আসা পেয়ারেলাল গান্ধীর সচিব হয়েছিলেন। নিজেদের মায়ের অনেক বিরোধিতার সত্ত্বেও দুই ভাই বোন হাজির হয়েছিলেন গান্ধীর কাছে। দুই ছেলে মেয়ে গান্ধীর কাছে চলে গেছে বলে যে মা প্রথমে কাঁদতেন, পরে অবশ্য সেই তিনিও গান্ধীর কট্টর সমর্থক হয়ে গিয়েছিলেন।
ডাক্তারী পাশ করে সুশীলা গান্ধীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক হয়ে গিয়েছিলেন। মনু আর আভা ছাড়া গান্ধী আর যে একজনের কাঁধে ভর দিয়ে বিভিন্ন সভায় বা প্রার্থনায় যেতেন, তাঁদের অন্যতম ছিলেন সুশীলা।
ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ে যখন গান্ধীর স্ত্রী কস্তুর্বা মুম্বাইতে গ্রেপ্তার হলেন, তখন একই সঙ্গে কারাবরণ করেছিলেন সুশীলাও। পুনেতে কস্তুর্বার শেষ সময়েতেও পাশে ছিলেন সুশীলাই। আর ব্রহ্মচর্যের যে অভ্যাস করতেন গান্ধী, তাতেও সাহায্য করতেন সুশীলা।
সূত্র : বিবিসি।
/ এআর/