যেভাবে হাঁটা সম্ভব হল তিন প্যারালাইজড রোগীর
প্রকাশিত : ১২:২৯, ২ নভেম্বর ২০১৮
প্যারালাইজড বা পক্ষাঘাতগ্রস্ত তিনজন মানুষ যাদেরকে বলা হয়েছিল যে তাদের বাকি জীবনটা হুইলচেয়ারেই কাটিয়ে দিতে হবে। কিন্তু সেই মানুষদের পক্ষেই আবারও হাঁটা সম্ভব হয়েছে। আর এ কাজে তাদের সহায়তার জন্য ধন্যবাদ প্রাপ্য সুইজারল্যান্ডের চিকিৎসকদের।
পক্ষাঘাতগ্রস্ত এই ব্যক্তিদের মেরুদণ্ডে ইলেক্ট্রিক্যাল ডিভাইস যুক্ত করে দেওয়া হয়েছে, যার মাধ্যমে তাদের মস্তিষ্ক থেকে পা পর্যন্ত সংকেত পৌঁছানোর কাজ জোরালো করেছে। এটি মেরুদণ্ডের স্নায়ুবিক যে ক্ষতি হয়েছিল তার পুনর্গঠনে সহায়তা করেছে।
গবেষকরা মনে করছেন, এই অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি পক্ষাঘাতগ্রস্ত মানুষদের স্বাধীনভাবে চলাফেরার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সক্ষম করে তুলবে। যে রোগীদের ওপর এই পরীক্ষা চালানো হয়েছে বিবিসি তাদের সঙ্গে যোগাযোগের বিরল সুযোগ পেয়েছিল এবং এর ফলাফল নেচার জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রথম চিকিৎসা দেওয়া ব্যক্তি ৩০ বছর বয়সী সুইস নাগরিক ডেভিড এম’যি। খেলাধুলা সংক্রান্ত এক দুর্ঘটনায় মেরুদণ্ডে গুরুতর আঘাত পেয়ে সাত বছর ধরে তিনি ইনজুরিতে ভুগছিলেন।
ডেভিড এর চিকিৎসক বলেছিলেন, তিনি কোনদিন হাঁটতে পারবেন না। যাইহোক, ধন্যবাদ প্রাপ্য ইকোল পলিটেকনিক ফেদেরার ডি লাওসানের একটি দলের যারা এই বৈদ্যুতিক ইমপ্ল্যান্ট প্রস্তুত করেছে, যার সাহায্যে ডেভিড আধা মাইলের বেশি হাঁটতে পারেন।
বিবিসির বিজ্ঞান বিষয়ক সংবাদদাতা পল্লব ঘোষকে ডেভিড বলেন, কিভাবে তার হাঁটার প্রচেষ্টা ও সামর্থ্য তার জীবন বদলে দিয়েছে।
‘আমার কাছে এর গুরুত্ব অনেক। যা করতে পেরেছি তাতে আমি অনেক বিস্মিত। আমি ভেবেছিলাম অসম্ভবকে সম্ভব করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা ভীষণভাবে আনন্দের, সত্যিই এই অনুভূতি খুব ভাল’।
তবে তার আহত হওয়ার পরের কিছু ভয়াবহ স্মৃতিও আছে। পুনর্বাসিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর সে রাজি হয় ডক্টর গ্রেগরি কার্টিনের ক্লিনিকাল পরীক্ষায় অংশ নিতে। হাঁটার জন্য ডেভিডের প্রচেষ্টা ও একাগ্রতার কথা তুলে ধরেন চিকিৎসক ডক্টর কার্টিন।
‘আমি আমার মেয়ে শার্লটের সঙ্গে আসি, সে সময় তার বয়স ছিল একমাস। আমরা যখন ডেভিডকে প্রস্তাব দিলাম, সে তখন আমার মেয়ের দিকে তাকিয়ে গভীরভাবে বলল `আমি তোমার আগে হাঁটবো’।
এরপর শার্লট তার বয়স যখন ১৪ মাস তখন প্রথম পা ফেলতে শুরু করলো। আর ততদিনে ডেভিড জেনেভা লেক পর্যন্ত হাঁটা শুরু করেছে।
মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপন চিকিৎসককে বিস্মিত করে দিয়ে ডেভিডকে শুধু হাঁটা নয় আরও অনেক পরিবর্তন এনে দিয়েছিল।
সুইজারল্যান্ডের নেতৃস্থানীয় স্নায়ুবিজ্ঞানীদের একজন লাউসান ইউনিভার্সিটি হাসপাতালের ডক্টরর জোকলেন ব্লোচ ডেভিডের মেরুদণ্ড প্রতিস্থাপন করেছিলেন। ডেভিডের উন্নতি দেখে তিনিও বিস্মিত।
ডেভিড এখন তার ইমপ্ল্যান্ট যন্ত্র বন্ধ থাকলেও আট কদম হাঁটতে পারে, ক্রনিক মেরুদণ্ডের জখমের ক্ষেত্রে এই ধরনের ঘটনা ঘটলো।
ল্যাবের বাইরে বাস্তব জীবনে ডেভিডেও জন্য অল্প কয়েক কদম হাঁটাও কঠিন। ইমপ্ল্যান্ট থেকে আসা সংকেত অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে এবং তাই সব সময় ব্যবহার করা যায় না।
এই প্রক্রিয়াটি ব্যয়বহুলও এবং গবেষণাগারের বাইরে নিত্যদিনের ব্যবহারের জন্য যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য নয়। তাই এটি পুরোপুরি নিরাময় হওয়া এখনও অনেক দূরের ব্যাপার।
তবে দাতব্য সংস্থা চ্যারিটি স্পাইনাল রিসার্চের বৈজ্ঞানিক পরিচালক ডক্টর মার্ক বেকনের মতে, এটা প্রমাণ করেছে যে, পক্ষাঘাত নির্মূল করা যায়, অন্তত কিছু ক্ষেত্রে।
‘বর্তমানে এটি রোগীদের জন্য বিকল্প উপায় কিনা সেটা নিয়ে সন্দেহ থাকতে পারে। কিন্তু এটা প্রমাণ করে যে, আমাদের সামনে কার্যকর একটি মডেল আছে।
এই চিকিৎসা সুবিধা লাভ করা প্রথম ব্যক্তি ডেভিড। আরও দু’জন হাঁটতে সক্ষম হয়েছেন। ৩৫ বছর বয়সী একজন প্রকৌশলী নেদারল্যান্ডসের জার্টান ওসকান, যিনি সাত বছর আগে গাড়ির ধাক্কায় আহত হন।
সেদিন ছিল তার জন্মদিন যেদিন চিকিৎসক তাকে জানালেন যে, সারাজীবনের জন্য তিনি প্যারালাইজড হয়ে গেছেন।
সেবাস্তিয়ান টোবলার ৪৮ বছর বয়সী জার্মান নাগরিক। দুর্ঘটনায় পক্ষাঘাত গ্রস্ত হওয়ার আগে সাইকেল চালাতে ভালবাসতেন এবং চলে যেতেন দূরে।
এখন সে বিশেষভাবে তৈরি একটি সাইকেল চালাতে পারে যেখানে মূলত তার হাতের শক্তি প্রয়োগ করতে হয়, আর সামান্য পায়ের অংশ। গবেষকরা বিশ্বাস করেন তাদের পদ্ধতি আরও উন্নত হবে এবং যে সমস্ত মানুষ আবারও হাঁটার সব আশাই ছেড়ে দিয়েছে তাদের মধ্যে চলাফেরার স্বাধীনতা আনবে।
গবেষকরা তিন বছরের মধ্যে ইউরোপ এবং আমেরিকাতে বড় পরিসরে এই ক্লিনিকাল পরীক্ষার পরিকল্পনা করছে। সব ঠিকমত চলতে থাকলে এই পদ্ধতি আরও ব্যাপকভাবে সুলভ হবে, আশা করছেন গবেষকরা।
সূত্র: বিবিসি
একে//