ঢাকা, রবিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৫

Ekushey Television Ltd.

‘যোগ্যতা ও মানসিক দৃঢ়তায় নারীর মুক্তি’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৪:৩০, ৮ মার্চ ২০১৮

ফরিদা ইয়াসমিন

ফরিদা ইয়াসমিন

Ekushey Television Ltd.

একমাত্র যোগ্যতা আর মানসিক দৃঢ়তাই পারে নারীকে মুক্তি এনে দিতে। কারও করুণা বা দয়ায় নয় বরং নারীকে এগিয়ে যেতে হবে তার নিজের যোগ্যতা দিয়ে, প্রমাণ করতে হবে নিজেকে, যে নারী পারে। নারীর আজকের অবস্থানও কেউ তৈরি করে দেয়নি, তাই আগামীর অবস্থানও কেউ তৈরি করে দিবে না। তাই নারীকে নিজের পথ নিজেই তৈরি করতে হবে।

নারীকে প্রমাণ করতে হবে, নারী পারে, নারী পেরেছে এবং আগামীতেও নারী পারবে। এই মূলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়েই নারীকে সামনে চলার সিঁড়ি রচনা করতে হবে।  আর এর জন্য নারীর দরকার, কেবল দৃঢ়তা আর যোগ্যতা। পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন-ই নারীকে তার যোগ্য সম্মান দিতে পারে বলে মনে করেন জাতীয় প্রেস ক্লাবের ৬৩ বছরের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন।  

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে একুশে টিভি অনলাইনকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, একটি সুন্দর, শান্তিময়, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক পৃথিবী গড়ার কাজে পুরুষের সমান অবদান রাখার প্রত্যয় নিয়ে নারীরা এগিয়ে চলছে। তবে এখনো সমাজে বিদ্যমান রয়েছে নানা সঙ্কট, নানা সমস্যা। বিশেষ করে নারীরা আজও কর্মস্থল, পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে পিছিয়ে আছে। হেনস্তা হচ্ছেন রাস্তা-ঘাটে, যানবাহনে। এমনকি পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে নারীদের জন্য পৃথিবী ক্রমেই চ্যালেঞ্জিং হয়ে উঠছে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন একুশে টেলিভিশনের প্রতিবেদক মোহাম্মদ জুয়েল।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে নারীরা আজও নির্যাতনের শিকার। কিন্তু কেন, সমস্যা কোথায়?

ফরিদা ইয়াসমিন: একবিংশ শতাব্দীর মূল প্রতিপাদ্য হলো নারী পুরুষ সমান অধিকারের ভিত্তিতে হাতে হাত রেখে সামনে এগিয়ে যাবে। এগিয়ে নেবে দেশকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, আজও আমাদের প্রতিদিনই শুনতে হচ্ছে, দেশের কোথাও না কোথাও নারী ধর্ষণের শিকার হচ্ছেন, কোথাও না কোথাও নারী শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন, কোথাও না কোথাও যৌতুকের বলি হয়ে নারী আত্মঘাতী হচ্ছেন। এটা আমাদের জন্য সুখকর নয়। নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণ করে দেখলে দেখা যায়, নারীরা প্রধানত পরিবারেই সবচেয়ে বেশি নির্যাতিত। যতোটা না শারীরিকভাবে নির্যাতিত, তারচেয়ে অনেক বেশি নির্যাতিত হয় মানসিকভাবে। নারী নির্যাতনের ঘটনার জন্য আমাদের গোড়ায় যেতে হবে। একজন ছেলে যেমন বড় হয়ে তার পরিবারে অবদান রাখতে পারবে, একজন নারীও তা পারবে। এ ধরণের দৃষ্টিভঙ্গি না আসা পর্যন্ত নারী নির্যাতনের ঘটনাগুলো বাড়তেই থাকবে। নারী নির্যাতনের অন্যতম কারণ নারীদের অজ্ঞতা। যে নারী যতবেশি অজ্ঞ, সে ততবেশি নির্যাতিত। হোক সেটা অজপাড়া গা, মফস্বল কিংবা শহুরে জীবন। নারী নির্যাতনের আরেক কারণ পরনির্ভরশীলতা। নারী যত পরনির্ভর হবে, সমাজে-পরিবারে তার অবস্থান তত তলানিতে থাকবে। তাই নারীদের আত্মনির্ভরশীল ও ব্যক্তিত্ববান হতে হবে। একইসঙ্গে পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারী নির্যাতন বন্ধে এবং নারীদের সম অধিকার নিশ্চিতে পুরুষের কি ভূমিকা রাখা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

ফরিদা ইয়াসমিন: আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। তাই নারীকে বাদ দিয়ে দেশের উন্নয়ন কখনো সম্ভব না। নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ দিতে হবে রাষ্ট্রকে। কিন্তু জনসংখ্যার অর্ধেক পুরুষ। সমাজে একটা ধারণা আছে, পুরুষরাই কেবল অর্থনীতিতে তাদের ভ্যালু যোগ করছেন, দেশের অর্থনীতি সচল রাখতে তারা কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। কিন্তু নারীরা যে কর্মস্থলসহ পরিবারের সব কাজ করছেন সেটাকে মূল্যায়ণ করা হচ্ছে না। পুরুষদের মনে রাখতে হবে, আপনি কেবল বাইরে কাজ করছেন। এরপরই আপনি বিরতিতে যাচ্ছেন। অথচ একজন নারী ঘরের বাইরে যেমন কাজ করছেন, তেমনি ঘরেও করছেন। পাশাপাশি সন্তান লালন-পালন করছেন তারা। একইসঙ্গে তারা যেমন বর্তমান অর্থনীতিতে ‘ভ্যালু অ্যাড’ করছেন। অন্যদিকে সন্তানদের যোগ্য নাগরিক করে গড়ে তোলার মাধ্যমে আগামী প্রজন্মের জন্য যোগ্য-দক্ষ-কর্মক্ষম নাগরিক তৈরি করছেন।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের সম অধিকার নিশ্চিতে এবং সমাজে নিজেদের পুরুষের সমকক্ষ করে গড়ে তুলতে হলে নারীদের কি কি পদক্ষেপ নেওয়া উচিত?

ফরিদা ইয়াসমিন: নারীদের মনে রাখতে হবে পৃথিবীর কেউ কাকে কোন সিঁড়ি তৈরি করে দেয়নি। বিশেষ করে নারীদেরকে তো নয়-ই। তাই নারীদের নিজেদেরই সেই সিঁড়ি তৈরি করতে হবে। সেই সিঁড়ি তৈরি করতে হলে নারীদের সবার আগে যেটা করতে হবে, তা হলো যোগ্যতার্জন। যোগ্যতা, মেধা একজন নারীকে সমাজের সর্বোচ্চ পদে নিয়ে যেতে পারেন। তারই উৎকৃষ্ট উদাহরণ জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তাই নারীদের সবার আগে দরকার যোগ্যতা ও মেধা অর্জন করা।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নির্যাতনের শিকার নারীরা বিচার পাচ্ছে না, এমন অভিযোগ শুনা যায় এটা কতটুকু সত্য? আর কিভাবে নারী নির্যাতন বন্ধ করা সম্ভব?

ফরিদা ইয়াসমিন: আমাদের দেশে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। শুধু তাই নয়, এ আইনের আওতায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে। সেখানে দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি করা হয়। কঠোর আইন থাকার পরও নারীরা নির্যাতিত হচ্ছেন সেটা সত্য। তবে সংখ্যাটা আগের তুলনায় কিছুটা কমেছে। আমি বলবো, গ্রামের নারীদের ক্ষেত্রে নির্যাতনের মাত্রা বেশি। সেখানে নারী ও তার পরিবার অসচেতন হওয়ায় আইনি ঝামেলায় যেতে চান না। তাই নির্যাতনকারী পক্ষের সঙ্গে দফারফায় লিপ্ত হন। কিন্তু এটা কোন সমাধান নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে ভিন্নতাও আছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল কার্যকর হওয়ার পর কিছুটা হলেও নির্যাতনের মাত্র কমেছে। তবে নির্যাতন পুরোপুরি বন্ধ করতে প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটাতে পারলেই সব ধরণের নির্যাতন বন্ধ হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: বরাবরই কর্মস্থলে পুরুষের তুলনায় নারীদের কম মজুরি দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে। হোক সেটা তৈরি পোষাকখাত কিংবা গণমাধ্যম, আপনি কি বলবেন?

ফরিদা ইয়াসমিন: এটা সত্য নারীদের কর্মের অবমূল্যায়ণ করা হয়। তবে এ সমস্যাটা কেবল বাংলাদেশে নয়, পুরো বিশ্বেই নারীর কর্মের মূল্যের অবমূল্যায়ণ করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিবিসির বেশ কয়েকজন নারী কর্মী অভিযোগ এনেছেন, তাদেরকে পুরুষের তুলনায় কম বেতন দেওয়া হয়। দুই নারী সাংবাদিক বিবিসি থেকে পদত্যাগও করেছেন। আমাদের দেশেও নারীদের পুরুষের তুলনায় কম মজুরি দেওয়া হয়। ধারণা করা হয়, পুরুষরা বলবান। তাই তাদের বেতন বেশি। কিন্তু বাস্তবে এবং কয়েকটি গবেষণায় দেখা গেছে নারীরা পুরুষের চেয়ে কর্মে বেশি মনোযোগী। শুধু তাই নয়, তারা পুরুষের চেয়েও কখনো কখনো বেশি পরিশ্রম করতে পারেন। তাই নারীকে নারী নয়, একজন পুরুষকর্মীর মতোই সম্মান দেখাতে হবে, মূল্য দিতে হবে এবং মজুরির ক্ষেত্রে এই নীতি মেনে চলতে হবে। গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি নির্যাতনের শিকার নারীরা। সেখানে প্রচণ্ড খাটুনির পরও তাদের কাজকে মূল্যায়ণ করা হচ্ছে না । কিন্তু এভাবে চলতে পারে না, তাই গার্মেন্টস খাতসহ সব খাতে নারীর কাজকে মূল্যায়ন করতে হবে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: নারীদের উন্নয়নে তাদের কি করা উচিত? আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে আপনার মন্তব্য কি?

ফরিদা ইয়াসমিন: প্র্রথমেই বলেছি, নারীদের যোগ্যতা অর্জন করতে হবে। যোগ্যতা ছাড়া কোনো জায়গায় টেকা সম্ভব না। এরপর দরকার দৃঢ়চেতা হওয়া। কারণ  জীবনে শত বাধা আসবে, কিন্তু মনে রাখতে হবে পিছিয়ে যাওয়া মানে হেরে যাওয়া। যে কোন পরিস্থিতিতে পিছিয়ে যাওয়া যাবে না। তাই নারীকে দৃঢ়চেতা হতে হবে। প্রচণ্ড মেধাবী হতে হবে তাকে। গোটা বিশ্বের সঙ্গে তাকে আপ টু ডেট থাকতে হবে। পরিবারে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরতে হবে। এ ছাড়া নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিতে ব্যক্তিত্বের মাধ্যমে নিজের চারপাশে একটি ব্যক্তিত্বের দেওয়াল তৈরি করতে হবে। যাতে টুনকো ধাক্কায় সেই ব্যক্তিত্ব ভেঙ্গে না পড়ে।

একুশে টেলিভিশন অনলাইন: একুশে পরিবারের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ।

ফরিদা ইয়াসমিন: একুশে পরিবারের প্রতিও শুভ কামনা।

/ এআর /

 


Ekushey Television Ltd.

© ২০২৫ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি