ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

যৌন হয়রানির প্রতিবাদ ও গ্রেফতার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১৯:১১, ২৯ এপ্রিল ২০১৮

মার্কেটে গেলেন।
দূর থেকে একজোড়া জুতা খুব মনে ধরলো।
দূর থেকে তো অনেক কিছুই পছন্দ হয়। আপনি কাছে গিয়ে নেড়েচেড়ে দেখলেন যেমনটা ভেবেছিলেন, জুতার ডিজাইন তেমন নয়। তবুও কৌতুহলী হয়ে দাম জানতে চাইলেন। ৩০০ টাকার জুতা চাইছে ৭০০ টাকা। আপনি বিরক্ত হয়ে বললেন, ‘এর দাম তো ৩০০ টাকাও না। রাখেন।’
জুতা রেখে চলে যাচ্ছেন, কেননা দাম ও ডিজাইন- কিছুই পছন্দ হয়নি। কিন্তু আপনি যেতে পারলেন না। দোকানি ততোক্ষণে জুতা প্যাকেট করে ফেলেছে। আপনি কিনতে বাধ্য।
ভালো বিপদ তো! ভাবলেন, সোলটা যদি ভালো হয় তবে নিয়েই নেবেন। ক্যাচালে যাবেন না। হাতে নিয়ে দেখলেন প্লাস্টিক রাবারের সোল। আপনি এটা পছন্দ করেন না। আপনার অপছন্দের কথা জানাতেই শুরু হলো অকথ্য গালি।
ও হ্যাঁ, বলাই হয়নি, আপনি একজন নারী। একা পেয়ে আপনাকে হেনন্থা করাই এখন দোকানির কাজ। মুহুর্তেই আপনি হয়ে গেলেন রাস্তার... (অকথ্য ভাষায় গালি)।
এক জীবনে না শোনা এমন অকথ্য গালি ও অপমানের প্রতিবাদ করবেন, তাই তো? পরিস্থিতি আরও ভয়ানক হলো এতে। এবার আপনাকে মারতে তেড়ে আসল দোকানি। আপনি ফোন বের করে ভিডিও করার হুমকী দিয়ে কোনো মতে বেঁচে ফিরলেন।

কি, ভাবছেন নারী হয়রানি নিয়ে কোনো শর্ট ফিল্মের কাহিনী?
হ্যাঁ, গল্পই তো। এ গল্প দেশের প্রতিটি নারীর নিত্য শিকার হওয়া হয়রানির। ঘটনাগুলো একই, শুধু চরিত্র আর স্থানটা কেবল বদলে যায়। গল্পের মতো করে বলা এই ঘটনাটিও বাস্তব সত্য। এবারের ঘটনাটি চট্টগ্রামের। মেয়েটি অনার্স ও মাস্টার্স করেছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গত ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রামের রেয়াজুদ্দিন বাজারে জুতা কিনতে গেলে এমন হয়রানির মুখে পড়েন তিনি।

লজ্জায়, অপমানে, মেয়ে হয়ে জন্মানোর ঘৃণায় কুণ্ঠিত মেয়েটি একবার ভাবলো মেনেই নেবে। পর মুহুর্তেই মনে হলো, এই মেনে নেওয়া মানে আরও অসংখ্য নারীকে হয়রানির সুযোগ করে দেওয়া। এই সুযোগ সে দিতে চাইলো না।

মেয়েটি খুঁজলো দোকান মালিক সমিতির সভাপতিকে। পাওয়া গেল না তাকে। অফিসে তালা। দেয়ালে লেখা নাম্বারে কল দিলে কামরুল নামের এক ছেলে রিসিভ করে বলল ‘ওই দোকানদার খুবই বেয়াদব’। কিছুই নাকি করার নেই।

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া মার্কেটকেন্দ্রীক হয়রানির ঘটনাগুলোয় একজন ভূক্তভোগীর আসলে করণীয় কী- ফেসবুকের মাধ্যমে তা আগেই জেনেছে মেয়েটি। ফলে বাসায় ফিরে একটি অভিযোগ লিখল। গেল কোতোয়ালি থানায়।

ডিউটি অফিসার বললেন, ‘এগুলো কোনো ঘটনাই না। দোকানদাররা এমন করে। জিডি করলে করতে পারেন, কিন্তু কাজ হবে কি না বলতে পারছি না!’

বিচার চাইতে গিয়ে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে থাকা মেয়েটি এবার সত্যিই মুষড়ে পড়ে। থানার অফিসার যেহেতু এভাবে বলছে, বিচার পাওয়ার আর সম্ভাবনাই সে দেখল না। কেননা ডিউটি অফিসার নিজেও একজন নারী!

বাসায় ফিরে রাতভর শুধু কাঁদল আর ভাবলো, কী পাপ যে সে করেছিল, এইভাবে পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে!

নানা যায়গায় ব্যর্থ হয়ে মেয়েটি যখন আমাকে ঘটনাটি বললো এবং পাঠালো ছোট্ট ভিডিও (যেটি সে ঘটনার একেবারে শেষ মুহুর্তে ধারণ করেছে) তখন আমার মনেও বিরাট এক সংশয়! কেননা, ঢাকা শহরে হয়রানির শিকার নারীকে সাহায্যের জন্য পুলিশের বড় কর্তারা যেভাবে এগিয়ে আসেন, বিভাগীয় বা জেলা শহরের ক্ষেত্রেও কি তেমনটা আসবেন?

সংশয় নিয়েই গতকাল চট্টগ্রামের কোতোয়ালি সার্কেলের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) জাহাঙ্গীর আলম ভাইকে ফোন করলাম। অনুরোধ করলাম মেয়েটিকে সাহায্যের। এও বললাম, আজ যদি বিচারপ্রার্থী এই মেয়ে ফিরে যায় তবে সারা জীবন এই দেশ ও সামাজকে সে দুষবে।
আন্তরিক জাহাঙ্গীর ভাই মেয়েটিকে আজ সকাল ১১টায় পাঠাতে বললেন।

আমি তবু আরেকটু ভরসা পেতে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের এসি এবং ওনারই ব্যাচমেট সুদিপ্ত সরকার রনিকে জানালাম। রনি দা আমার ডিপার্টমেন্টের বড় ভাই। তিনিও জাহাঙ্গীর ভাইকে ফোন করলেন।

ফলাফল হলো দারুণ। সব শুনে ও লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ফোর্স পাঠিয়ে সঙ্গে সঙ্গে মাসুদ নামের ওই দুষ্টু দোকানিকে ধরে এনেছেন জাহাঙ্গীর ভাই। এসব ক্ষেত্রে যা হয় আর কি- হাত-পা ধরে মাফ চাওয়া, মার্কেট কমিটির সুপারিশ, সবই হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটি দৃঢ়ভাবে আইনি শাস্তির পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। ফলে মামলার প্রস্তুতি চলছে।

বলি কি, মার্কেট এলাকায় প্রতিনিয়ত হয়রানির শিকার নারীদের মধ্যে যারা ফেসবুকে চিল্লাপাল্লা না করে সত্যি সত্যিই অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে চান, তারা নিয়মতান্ত্রিক এই প্রতিবাদের পথটা অনুসরণ করুন।
দেখুন সারা দেশেই কিন্তু এই প্রতিবাদটা শুরু হয়ে গেছে। আপনি চুপ করে থাকবেন কেন?
মনে রাখবেন, আপনার প্রতিবাদটি অন্য কেউ এসে করে দিয়ে যাবে না। শুরুটা অন্তত আপনাকেই করতে হবে। এই মেয়েটি কিন্তু একাই বিরাট এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। আমরা শুধু তাকে প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনাটুকু দিয়েছি।

এই দেশে কিছু হয় না বলে যারা পাশ কাটিয়ে যান, যারা প্রতিবাদের বদলে প্রতিনিয়ত অন্যায়কে মেনে নেন, তাদের প্রতি অনুরোধ, নিজের যায়গা থেকে একটুখানি আওয়াজ তুলুন। জনারণ্যে শুরুতে সেই আওয়াজ বড় ক্ষীণ আর বেমানান ঠেকলেও ধীরে ধীরে দেখবেন আরও সহস্র আওয়াজ আপনার দিকে ছুটে আসছে। গণমানুষের সম্মিলিত সেই আওয়াজের সামনে দাঁড়ায়, এমন অপশক্তি কোথায়?

নিয়মতান্ত্রিক প্রতিবাদের এই ধাপগুলো অনুসরণ করুন:

ক. এমন হলে সঙ্গে সঙ্গে ৯৯৯ এ কল করুন।

খ. ঘটনার বিস্তারিত উল্লেখ করে একটি দরখাস্ত লিখুন। চলে যান নিকটস্থ থানায়।

গ. সম্ভব হলে ঘটনার ভিডিও করুন বা ছবি তুলুন। প্রমাণ রাখুন। না থাকলেও অসুবিধা নেই।

ঘ. থানায় ডিউটি অফিসার বা এসআই নয়, সরাসরি ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (ওসি) সঙ্গে দেখা করুন। আরও ভালো হয় যদি সংশ্লিষ্ট এলাকার এসি বা এএসপির সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

ঙ. যেসব এলাকায় নিয়মিত যান, সেসব এলাকার গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার নিজের সংগ্রহে রাখুন। সারা দেশের পুলিশ কর্মকর্তাদের ফোন নাম্বার পেতে Bangladesh Police Phonebook

অ্যাপসটি ইন্সটল করুন।

চ. যদি ওপরে উল্লিখিত ওসি, এসি বা এএসপি আপনার আপনাকে সহযোগিতা না করে তবে সরাসরি জেলা হলে পুলিশ সুপার (এসপি) মেট্রোপলিটন শহর হলে উপ-পুলিশ কমিশনারের (ডিসি) সঙ্গে দেখা করুন। বিচার পাবেনই।


লেখক: লেখক ও সাংবাদিক।

এসএইচ/


** লেখার মতামত লেখকের। একুশে টেলিভিশনের সম্পাদকীয় নীতিমালার সঙ্গে লেখকের মতামতের মিল নাও থাকতে পারে।
Ekushey Television Ltd.










© ২০২৪ সর্বস্বত্ব ® সংরক্ষিত। একুশে-টেলিভিশন | এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি